ইসলামের মৌলিক ভিত্তিগুলোর মধ্যে জাকাত অন্যতম। ইসলামী শরিয়তে জাকাত প্রদান করাকে ফরজ বলা হয়েছে। কারণ জাকাত প্রদানের মাধ্যমে সমাজে ধনী-গরিবের ভেদাভেদ দূর হওয়ার পাশাপাশি বৈষম্যহীন একটি অর্থনৈতিক রাষ্ট্র বিনির্মাণ করা সম্ভব। জাকাতের মাধ্যমে বান্দার সম্পদ পবিত্র হয়। এমনকি সম্পদ বৃদ্ধি পায়। তাই পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় সামর্থ্যবানদের জাকাত দেয়ার নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ ঘোষণা করেন- ‘তোমরা নামাজ প্রতিষ্ঠা করো, জাকাত দাও।’
যে সম্পদের ওপর জাকাত ফরজ, তার ৪০ ভাগের এক ভাগ (২.৫ শতাংশ) জাকাত দেয়া ফরজ। সম্পদের মূল্য নির্ধারণ করে শতকরা আড়াই টাকা বা হাজারে ২৫ টাকা হারে নগদ অর্থ কিংবা ওই পরিমাণ টাকার কাপড়চোপড় বা অন্য কোনো প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনে দিলেও জাকাত আদায় হবে। তবে লক্ষণীয় বিষয় হলো- উপরোক্ত জাকাত প্রদানের হার চান্দ্রমাস হিসাবে, যদি কেউ সৌরমাস হিসাবে দিতে চায় তাহলে তাকে ২.৬ শতাংশ হারে জাকাত দিতে হবে।
জাকাতের গুরুত্ব : জাকাত ইসলামের বিধিবদ্ধ ইবাদত। মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে জাকাতের কথা নামাজের মতোই বারবার উল্লেখ করা হয়েছে। মহান রবের ইরশাদ- ‘তোমরা সালাত আদায় করো এবং জাকাত প্রদান করো। তোমরা যে উত্তম কাজ নিজেদের জন্য অগ্রে প্রেরণ করবে তা আল্লাহর কাছে পাবে। নিশ্চয়ই তোমরা যা করো আল্লাহ তা দেখছেন।’ (সূরা বাকারা-১১০)
জাকাত না দেয়ার শাস্তি : জাকাত আদায় না করার শাস্তি সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘যেদিন জাহান্নামের অগ্নিতে তা (জাকাতের সম্পদ) উত্তপ্ত করা হবে আর এটি দিয়ে তাদের ললাট, পার্শ্বদেশ ও পৃষ্ঠদেশে দাগ দেয়া হবে সেদিন বলা হবে, ‘এটিই তা যা তোমরা নিজেদের জন্য পুঞ্জীভূত করতে। সুতরাং তোমরা যা পুঞ্জীভূত করেছিলে তার স্বাদ আস্বাদন করো।’ (সূরা তাওবাহ-৩৫)
হাদিসে বর্ণিত হয়েছে- আল্লাহ তায়ালা যাকে ধন-সম্পদ দান করেছেন সে যদি ওই সম্পদের জাকাত আদায় না করে, তাহলে তার সম্পদকে কিয়ামতের দিন টাক পড়া বিষধর সাপের রূপ দান করা হবে। যার চোখের উপর দু’টি কালো দাগ থাকবে যা কিয়ামতের দিন তার গলায় বেড়ির মতো পেঁচিয়ে দেয়া হবে। অতঃপর সাপটি তার চোয়ালে দংশন করে বলতে থাকবে আমিই তোমার সম্পদ, আমিই তোমার কুক্ষিগত মাল।’ (বুখারি-১/১৮৮)
জাকাতের সম্পদ : মূলত পাঁচ প্রকার সম্পদের জাকাত দেয়া ফরজ- ১. বিচরণশীল উট, গরু, ছাগল ইত্যাদি গৃহপালিত পশু; ২. সোনা-রুপা; ৩. নগদ টাকা; ৪. ব্যবসায় বা বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে রক্ষিত দ্রব্য; ৫. কৃষি উৎপাদিত ফল ও ফসল।
স্বর্ণে জাকাত ফরজ হবে যদি শুধু স্বর্ণ স্বতন্ত্রভাবে সাড়ে সাত তোলা বা ৮৭.৪৫ গ্রাম বা এর বেশি থাকে। রৌপ্যে জাকাত ফরজ হবে যদি শুধু রৌপ্য স্বতন্ত্রভাবে সাড়ে ৫২ তোলা বা ৬১২.৩৫ গ্রাম বা এর বেশি থাকে। তখন স্বর্ণ ও রৌপ্যের সরাসরি ৪০ ভাগের এক ভাগ অথবা মূল্যের ৪০ ভাগের এক ভাগ জাকাত হিসেবে আদায় করতে হবে।
টাকা- এটি কয়েকভাবে আমাদের কাছে থাকতে পারে-
১. নগদ টাকা ২. কারো কাছে আমানত রাখা টাকা ৩. ভবিষ্যতের উদ্দেশ্যে জমানো টাকা। যেমন- হজ, বিয়েশাদী, ঘর নির্মাণের উদ্দেশে জমানো টাকা ৪. ব্যাংকে জমানো টাকা বৈদেশিক মুদ্রা হলে তার বাজার মূল্য ৫. বীমা-ইন্স্যুরেন্সে জমানো টাকা ও প্রাইজবন্ড ৬. কর্জ টাকা যা ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা আছে ৭. যেকোনো ফেরতযোগ্য টাকা। যেমন- অ্যাডভান্স সিকিউরিটি, জামানত রাখা টাকা যার মূল্য বা বিকল্প আসবে ৮. মুদারাবা স য়ী ফান্ডে অংশীদারিত্বের চুক্তিতে যে পুঁজি বিনিয়োগ করা হয় তার মূল পুঁজি ও মুনাফাসহ হালাল টাকা ৯. স্বর্ণ-রৌপ্য যদি স্বতন্ত্রভাবে উল্লিখিত পরিমাণের কম হয় তাহলে এর মূল্য নগদ টাকা হিসেবে ধর্তব্য; ১০. গাড়ি, বাড়ি, দোকান ইত্যাদির ভাড়া।
জাকাতের খাত : জাকাতের খাত আল্লাহ তায়ালা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করে দিয়েছেন, এর বাইরে কেউই তা গ্রহণ করতে পারবে না। মহান রবের ইরশাদ- ‘প্রকৃতপক্ষে জাকাত- ১. ফকির ও ২. মিসকিনদের হক এবং ৩. সেই সব কর্মচারী যারা সদকা উসুলের কাজে নিয়োজিত এবং ৪. যাদের মনোরঞ্জন করা উদ্দেশ্য তাদের। ৫. তা ছাড়া দাসমুক্তিতে ৬. ঋণগ্রস্তের ঋণ পরিশোধে এবং ৭. আল্লাহর পথের মুজাহিদ ও ৮. মুসাফিরদের সাহায্যেও (তা ব্যয় করা হবে)। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদত্ত বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।’ (সূরা তাওবাহ-৬০) এখানে আট শ্রেণীর লোকের কথা উল্লেখ রয়েছে, যারা জাকাত গ্রহণের অধিকার রাখে, তবে তৃতীয় ও প ম শ্রেণীর প্রথা বর্তমানে প্রচলন না থাকায় এটি স্থগিত আছে। আর চতুর্থ শ্রেণীর খাত হজরত ওমর রা:-এর যুগ থেকে, ফকিহ সাহাবিদের সমন্বিত সিদ্ধান্তে স্থগিত করা হয়েছে। সুতরাং বর্তমানে শুধু পাঁচ শ্রেণীর লোকেরাই জাকাত গ্রহণের অধিকার রাখে।
যাদেরকে ও যে স্থানে জাকাত দেয়া যাবে না : ১. নিজ পিতা-মাতা, দাদা-দাদী, নানা-নানী, অর্থাৎ জাকাত দাতার সব পিতৃকুল ও মাতৃকুলের সব ঊর্ধ্বতন নারী-পুরুষকে জাকাত দেয়া যাবে না। ২. ঔরসজাত ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনী, পরনাতি-পরনাতনী, অর্থাৎ নিজের অধঃস্তন সব নারী-পুরুষকে জাকাত দেয়া যাবে না। ৩. হানাফি মাজহাবের ফতোয়া অনুযায়ী স্বামী স্ত্রীকে এবং স্ত্রী স্বামীকে জাকাত দিতে পারবে না। তবে হানাফি মাজহাবের অনেক ফকিহ শুধু স্ত্রী কর্তৃক স্বামীকে জাকাত দেয়ার অনুমতি দিয়েছেন। এ ছাড়া অন্য সব দরিদ্র আত্মীয়-স্বজনকে জাকাত দেয়া যাবে। যেমন- ভাইবোন, চাচা-ফুফু, মামা-খালা, শ্বশুর-শাশুড়ি, সৎমা-সৎবাবা, জামাতা, পুত্রবধূ ইত্যাদি। জাকাত দেয়ার ক্ষেত্রে জাকাত গ্রহণের উপযুক্ত নিকটাত্মীয়দের জাকাত দেয়া উত্তম। ৪. অমুসলিমদেরকে জাকাত দেয়া যাবে না। সতর্কতাবশত একটি বিষয় জানা একান্ত দরকার। বর্তমানে অনেক অমুসলিম সংস্থা যারা বিভিন্ন মাধ্যমে জাকাত সংগ্রহ করছে, এদেরকে জাকাত দিলে জাকাত আদায় হবে না। ৫. নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক। ৬. নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিকের নাবালক সন্তান। ৭. মসজিদ-মাদরাসা, পুল, রাস্তা, হাসপাতাল বানানোর কাজে এবং মৃতের দাফনের কাজে জাকাতের টাকা দেয়া যাবে না।
যাদেরকে জাকাত দেয়া উত্তম : ১. দ্বীনি জ্ঞানার্জনরত ছাত্র এবং শিক্ষাদানরত শিক্ষক যদি জাকাতের হকদার হয় তাহলে তাদের জাকাত দেয়া সবচেয়ে উত্তম হবে। ২. নিজের আত্মীয়স্বজনের মধ্যে যারা জাকাত পাওয়ার যোগ্য তারা। ৩. তারপর বন্ধু-বান্ধব প্রতিবেশী মধ্যে যারা জাকাত পাওয়ার যোগ্য তারা। ৪. তারপর জাকাতের অন্যান্য হকদার। সুতরাং আমাদেরকে সার্বিক বিষয় লক্ষ করেই জাকাত দিতে হবে যাতে করে তা মহান রবের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় এবং জাকাতের প্রকৃত উদ্দেশ্য অর্জিত হয়। লেখক : সিনিয়র শিক্ষক, ডক্টর আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রহ. প্রতিষ্ঠিত, জামেয়াতুস সুন্নাহ, ঝিনাইদহ সদর