জাতিসংঘের চরম দারিদ্র্য ও মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষ প্রতিবেদক ওলিভিয়ার ডি শ্যুটার বলেছেন, স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) মর্যাদা থেকে প্রত্যাশিত স্তরে উন্নীত হওয়ার পর, একটি অধিকারভিত্তিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে, বাংলাদেশ সরকারকে সস্তা শ্রমের ওপর নির্ভরতা কমাতে হবে। সোমবার (২৯ মে) বাংলাদেশে ১২ দিনের সফর শেষে অলিভিয়ার ডি শ্যুটার এ কথা বলেন। জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদক বলেন, “মানুষকে দরিদ্রতার মধ্যে রেখে, একটি দেশ তার আপেক্ষিক সুফল বা উন্নয়ন ভোগ করতে পারে না। বাংলাদেশের উন্নয়ন মূলত তৈরি পোশাক শিল্পের মতো একটি রপ্তানি খাত দ্বারা ব্যাপকভাবে চালিত, যা সস্তা শ্রমের ওপর অত্যন্ত নির্ভরশীল।”
ডি শ্যুটার, বাংলাদেশ সরকারকে ২০২৬ সালে এলডিসি মর্যাদা থেকে আসন্ন উন্নীতকরনের সুযোগ ব্যবহার করে, তৈরি পোশাক শিল্পের ওপর তার নির্ভরতা পুনর্বিবেচনা করার জন্য আহ্বান জানান। তিনি বলেন, “কারণ এই শিল্প ৪০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি দেশের বর্তমান রপ্তানি আয়ে শতকরা ৮২ ভাগ অবদান রাখছে।”
ডি শ্যুটার আরো বলেন, “বাংলাদেশ যত উন্নীত-করনের পথে এগোচ্ছে, ততই আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের ট্যাক্স-প্রণোদনা প্রদান এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অ ল প্রতিষ্ঠার প্রতি মনোযোগ দিচ্ছে।” জাতিসংঘ বিশেষ প্রতিবেদক আরো বলেন, “ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করা, কর্মীদের শিক্ষিত করা ও প্রশিক্ষণ দেয়া এবং সামাজিক সুরক্ষার উন্নতিতে সরকারকে আরো বেশি সময় এবং সম্পদ ব্যয় করা প্রয়োজন।”
তিনি জানান, “এ জাতীয় উদ্যোগ শুধু সুনামের চিন্তা করে এমন বিনিয়োগকারীদেরই আকৃষ্ট করবে না; এটি বাংলাদেশে উন্নয়নের একটি নতুন রূপরেখা তৈরি করবে; যা বৈষম্যমূলক রপ্তানি সুযোগের পরিবর্তে অভ্যন্তরীণ চাহিদা দ্বারা চালিত হবে।”
বিশেষ প্রতিবেদক স্বাধীনভাবে কাজে বিশ্বাসী সুশীল সমাজের ওপর সরকারের এনজিও বিষয়ক ব্যুরো এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নানাবিধ প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি উল্লেখ করেন, উক্ত আইনের অধীনে সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী, বিরোধী রাজনীতিবিদ এবং শিক্ষাবিদদের তাদের স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার প্রয়োগের কারণে আটক করা হয়েছে।
ডি শ্যুটার বলেন, “এই বিষয়গুলো, দেশটি যে বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে চাচ্ছে, কেবল তাদেরই শঙ্কিত করবে না; বরং দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করবে।” তিনি বলেন, “আপনি জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত না করে, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা বা সামাজিক সুরক্ষা দিতে পারবেন না।”
সফরকালে ডি শ্যুটার সারা বাংলাদেশ ভ্রমণ করেন এবং দারিদ্র্যসীমায় থাকা জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।তিনি উল্লেখ করেন, “দেশটি সামগ্রিক আয়ের বৈষম্য হ্রাসে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করলেও, এখনো বহুমাত্রিক দারিদ্র্য রয়ে গেছে এবং বিশেষ করে, শহরা লে আয়-বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে।”
জাতিসংঘ বিশেষ প্রতিবেদক বলেন, “সামগ্রিক অর্থনৈতিক অগ্রগতি অসম হয়েছে; আদিবাসী, দলিত, বেদে, হিজরা এবং ধর্মীয় ও ভাষাগত সংখ্যালঘু যেমন; বিহারীদের সুযোগ বি ত করা হয়েছে। সরকার উন্নয়নের নামে অনানুষ্ঠানিক বসতিগুলোতে উচ্ছেদ চালিয়েছে। এক্ষেত্রে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে বা পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন প্রদান না করে, বাসস্থানের অধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছে।”
ডি শ্যুটার সরকারকে সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থাকে আরো যৌক্তিক করার জন্য আহ্বান জানান; যেটিকে তিনি ‘এডহক বা সাময়িক ভিত্তিতে ১১৯টি স্কিমের একটি সমন্বিত কর্ম হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তবে এগুলো দুর্বলভাবে সমন্বিত, যা বাংলাদেশিদের প্রত্যাশিত আয়ের নিরাপত্তা প্রদান করে না বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
ডি শ্যুটার উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, “কর থেকে প্রাপ্ত আয় ও জিডিপি-এর অনুপাত উল্লেখযোগ্য হারে কম হয়েছে (প্রায় ৭ দশমিক ৮ শতাংশ)। আর, সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিতকরনে অর্থায়নের জন্য প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ সরকারি রাজস্ব আসে পরোক্ষ কর থেকে। অথচ, প্রত্যক্ষ কর থেকে আয় আসে মাত্র এক-তৃতীয়াংশ।”
তিনি বলেন, “চিত্রটি উল্টো হওয়া উচিত। উচ্চ-আয় উপার্জনকারী মানুষ এবং বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে জনসাধারণের পরিষেবা এবং সামাজিক সুরক্ষার অর্থায়নে অবদান রাখতে হবে, গ্রাহকদের নয়। আর, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট নতুন এবং উল্লেখযোগ্য ঝুঁকি থেকে জনসংখ্যাকে রক্ষা করার জন্য সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি তৈরি করা উচিত।”
বিশেষ প্রতিবেদক উল্লেখ করেন, “শুধুমাত্র ২০২২ সালে, ৭১ লাখ লাদেশি নদীভাঙন, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা এবং অন্যান্য বিপর্যয়ের কারণে বা জলের লবণাক্তকরণের কারণে অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়ে ও তাদের জীবিকা হুমকির সম্মুখীন হয়।”
জাতিসংঘ বিশেষ প্রতিবেদকের মিশনের অংশ হিসেবে কক্সবাজার সফর অন্তর্ভুক্ত ছিলো। ডি শ্যুটার সেই শরণার্থী শিবিরসমূহ পরিদর্শন করেন, যেখানে ৯ লাখ ৭৭ হাজার ৭৯৮ জন রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছে। যাদের বেশিরভাগই ২০১৭ সালে তাদের মাতৃভূমিতে গণহত্যার আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে পালিয়ে এসেছে। প্রায় ১০ লাখ শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়ার জন্য, ইতোমধ্যে জনাকীর্ণ বাংলাদেশের সরকারকে অভিবাদন জানান তিনি। পাশাপাশি আশ্রয় শিবিরের বসবাস-অনুপযোগী অবস্থার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন।
জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞ বলেন, “প্রত্যাবাসনের শর্ত পূরণ না হওয়া পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের একটি স্বচ্ছন্দ্য ও মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপনের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় উভয়েরই ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে হবে।”
বিশেষ প্রতিবেদক জানান, এটি অনভিপ্রেত যে ২০২৩ সালে রোহিঙ্গা শিবিরে জরুরি মানবিক প্রয়োজন মোকাবেলায় ৮৭ কোটি ৬০ লাখ ডলারের যৌথ পরিকল্পনার উদ্যোগে আন্তর্জাতিক দাতারা এতোই কম অবদান রেখেছে যে, চাহিদার মাত্র ১৭ শতাংশ জোগাড় হয়েছে। ২০২৩ সালের মার্চ থেকে, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচিকে তার খাদ্য ভাউচারের মূল্য প্রতি মাসে ১২ ডলার থেকে কমিয়ে ১০ ডলার করতে হয়েছে এবং এটি আগামী জুনে আরো কমিয়ে ৮ ডলার করা হবে।
ডি শ্যুটার সতর্ক করেন, “অপুষ্টি এবং যথেষ্ট পুষ্টির অভাব বৃদ্ধি পাবে, বিশেষ করে শিশুদের পরিণতি ভয়াবহ হবে। তার ভাষায়, “পরিবারগুলো মরিয়া হয়ে উঠছে। বাংলাদেশ সরকার যদি রোহিঙ্গাদের কর্মসংস্থানের অধিকারকে স্বীকৃতি দেয় এবং মানবাধিকার আইন অনুযায়ী তাদেরকে আয়-উপার্জনের সুযোগ করে দেয়, তবে অন্তত তাদের কিছুটা কষ্ট লাঘব হবে।” ২০২৪ সালের জুনে বিশেষ প্রতিবেদক তার বাংলাদেশ বিষয়ক সর্বশেষ প্রতিবেদন মানবাধিকার কাউন্সিলে পেশ করবেন।