‘আমার স্বামী মারা গেছে। টাকার অভাবে দুই মেয়েকে আর পড়াতে পারিনি। অনেক পাত্র এসেছে। মেয়ে দেখে পছন্দ হলেও আমার বাড়ি ঘর দেখে তারা ফিরে যায়। স্বামী মারা যাওয়ার সময় এই গরুটা রেখে গেছে। অনেক কষ্টে গরুটিকে মানুষ করেছি (লালন-পালন করেছি)। রোজার ঈদে ছেলেমেয়েদের জামাকাপড় না কিনে গরুর জন্য খাবার কিনি সেই টাকা দিয়ে। এবার কোরবানির ঈদে গরুটি বিক্রি করতে পারলে সেই টাকা দিয়ে মেয়েদের বিয়ে দেবো। ছোট্ট একটি ঘর তুলবো। কিন্তু গরুটি বিত্রি হবে কি না জানি না।’
কাঁদতে কাঁদতে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার দিগনগর ইউনিয়নের হড়রা গ্রামের মৃত ছনু মিয়ার স্ত্রী মর্জিনা খাতুন। গত বুধবার (১৪ জুন) দুপুরে মর্জিনা খাতুনের বাড়িতে গিয়ে জানা যায়, পাঁচ শতক জমির ওপর পুরোনো একটি আধাপাকা ঘর। ভিটেবাড়ি ছাড়া চাষাবাদের কোনো জমি নেই তাদের। অন্যের জমি লিজ নিয়ে আবার কখনো শ্রম বেচে স্ত্রী, দুই মেয়ে আর এক ছেলেকে নিয়ে সংসার চলছিল ছনু মিয়ার। তবে অভাবের মধ্যেও ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করাতেন।
একদিন বাড়ির গাভিটি একটি বাছুর প্রসব করে। তার নাম রাখা হয় ‘বুড়ো’। হঠাৎ একদিন ছনু মিয়া অসুস্থ হলে চিকিৎসকের কাছে নেওয়া হয়। ছনু মিয়ার ক্যানসার ধরা পড়ে। পরে ছনু মিয়া তার তিন সন্তানকে ডেকে বলেন, ‘এই গরুটি ছাড়া কিছুই দিতে পারলাম না। তোমরা এটা ভালোভাবে বড় করো।’
এর কিছুদিন পর মারা যান ছনু মিয়া। এরপর থেকে খেয়ে না খেয়ে চলছে মর্জিনা খাতুনের সংসার। তবে সংসারে অভাব থাকলেও তিন বছর ২ মাস বয়সী বুড়োর যতেœর কোনো ত্রুটি করেননি মর্জিনা। নিজে ও তিন সন্তানরা না খেয়ে থাকলেও বুড়োর জন্য প্রতিদিন ৮০০ টাকার খাবার ঠিকই দিয়েছেন। দেশীয় খাবার খড়, ভুসি, খৈল ও ঘাস খাইয়ে বড় করে তুলেছেন।
ফ্রিজিয়ান জাতের ষাঁড়টির ওজন আনুমানিক ৩৩ মণ। মর্জিনা খাতুন এর দাম চাচ্ছেন ১৫ লাখ টাকা। ঈদে ষাঁড়টি বিক্রি হলে সেই টাকা দিয়ে দুই মেয়েকে বিয়ে দেবেন। কিন্তু ষাঁড়টি বিক্রি নিয়ে চিন্তায় রয়েছেন মর্জিনা খাতুন।
মর্জিনা খাতুন বলেন, ‘স্বামী ক্যানসারে মারা যাওয়ার পর সংসারে অভাব নেমে আসে। খুব কষ্টে দুই মেয়ে অনার্স পাস করলেও টাকার অভাবে আর পড়াতে পারেনি। ছেলেটা এখন অনার্সে পড়ছে। জানি না তাকেও পড়াতে পারবো কি না। অভাবের মধ্যেও অনেক কষ্ট করে গরুটি সন্তানের মতো লালন-পালন করেছি।’ তিনি বলেন, ‘কিছুদিন পর কোরবানির ঈদ। গরুটি বিক্রির জন্য ঢাকায় নিয়ে যাবো তেমন টাকাও নেই আমাদের কাছে। আমি চাচ্ছি কেউ আমার বাড়ি থেকে গরুটি কিনে নিয়ে যাক। গরুটি বিক্রি করতে পারলে সেই টাকা দিয়ে আমার দুই মেয়েকে বিয়ে দেবো। গরুটি বিক্রি না হলে মেয়েদের বিয়ে দিতে পারবো না।’
মর্জিনা খাতুনের মেজ মেয়ে সাথী খাতুন বলেন, ‘বাবা অসুস্থ হওয়ার পর আমাদের ডেকে বলেন, আমারতো কিছই নেই। এই গরুটা লালন- পালন করবি। এটাই তোমাদের দিয়ে গেলাম। এরপর বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে গরুটাকে আমরা লালন-পালন করছি। অনেকদিন এমনও গেছে আমরা না খেয়ে গরুটাকে খাবার দিয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘সামনে কোরবানির ঈদকে ঘিরে গরুটা বিক্রি করে দিতে চাচ্ছি। যেহেতু আমার বাবা নেই তাই গরুটা বাইরে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। বাড়ি থেকেই এটি বিক্রি করবো। গরুটার দাম চাচ্ছি ১৫ লাখ টাকা। তবে আলোচনার সুযোগ থাকবে।’ মর্জিনা খাতুনের প্রতিবেশী ইয়াসমিন খাতুন ও রুহুল আমিন বলেন, পরিবারটি অনেক কষ্ট করে গরুটি লালন-পালন করেছে। তারা রান্না করে অনেক সময় ভাত না খেয়ে গরুকে খেতে দিয়েছে। আল্লাহ যেন ওদের আশাটা পূরণ করে।’