জেলার সদর উপজেলার তাজপুর গ্রামে অবস্থিত রামসাগর দিঘী। যা সারা বছর পর্যটকদের পদ চারণায় মুখরিত থাকে। শীতের আগমন বার্তায় হেমন্তের শুরু থেকে দেশি বিদেশি পর্যটকদের আগমন বেড়ে গেছে।রামসাগরের বন বিভাগের নিয়োাজিত সংরক্ষক আব্দুর রহিম জানান, গত ১৫ অক্টোবরের পর থেকে জাতীয় উদ্যান রামসাগরের নান্দনিক দৃশ্য, উপভোগ করতে পর্যটকদের ভীড় বাড়তে শুরু করেছে। তিনি বলেন, রামসাগরের গেস্ট হাউজে পর্যটকদের থাকার জন্য ৮টি রুম রয়েছে। পর্যটকদের আগমন বেড়ে যাওয়ায় গেস্ট হাউজের কোন রুম খালি থাকে না। আগাম মোবাইল ফোনে গেস্ট হাউজের রুমগুলো বুকিং দিয়ে রাখছেন পর্যটকরা। তিনি সহ ১৫ জন বন বিভাগের দায়িত্বে রয়েছেন।
ভিআইপি পর্যটকেরা এখানে এসে দেশের সর্ববৃহৎ বড়দিঘী ও মনমুগ্ধকর জলরাশি নান্দনিক পরিবেশ উপভোগ করার জন্য গেস্ট হাউসে কয়েকদিন অবস্থান করেন। পর্যটকরা তৃপ্তি সহকারে রামসাগর এলাকায় বিচরণ করে আবার ফিরে যান। পর্যটকদের অবস্থান কালীন তাদের সেবার মান ঠিক রাখা হয়েছে। ফলে এখানে হেমন্তে কার্তিকের শুরু থেকে বসন্তে ফাগুন-চৈত্র মাস পর্যন্ত পর্যটকদের আগমন বেশি থাকে।
এছাড়া প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে শিক্ষা সফর ও বিভিন্ন প্রশিক্ষণে ঘুরতে আসেন অনেকে। এসব ঘুরতে আসা বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ ও শিক্ষার্থীরা সারাদিন রামসাগরে অবস্থান করে, এখানকার মনোরম পরিবেশ উপভোগ করে ফিরে যান।
পিকনিকের মৌসুম শুরু হওয়ায় এখন প্রায় ১০ থেকে ১২টি বাস ভর্তি লোকজন বিভিন্ন এলাকা থেকে এখানে পিকনিক করতে আসছেন। পিকনিকে আসা লোকজন এখানে আনন্দ সহকারে রামসাগরে গোসল করে তৃপ্তি নিচ্ছেন। তারা অনেকেই বলছেন রামসাগরে গোসল করাটা স্মৃতি হয়ে থাকবে।
রামসাগরের বিশাল জলরাশির পাশাপাশি, এখানে রয়েছে মিনি চিড়িয়াখানা। এতে প্রায় ৬০ থেকে ৬৫টি হরিণ রয়েছে। পর্যটক ও পিকনিকে আসা দর্শনার্থীরা হরিণ দেখে মুগ্ধ হচ্ছেন। চিড়িয়াখানায় হরিণসহ অন্যান্য পশুপাখি রামছাগল, বাঁদর, উটপাখিদের খাবার দিয়ে পর্যটকরা খুশী হচ্ছেন।
কৃত্রিম পশু পাখি উট, হরিণ, হাতি, গাধা, বাঘ, সিংহ, সহ অনেক দৃশ্যমান অবস্থান এখানে রয়েছে। এসব কৃত্রিম দৃশ্য মানের সাথে ছবি তুলে তারা স্মৃতি সংরক্ষণ করছেন।
রামসাগরে ঘুরতে আসা দর্শনার্থী বগুড়া সদর উপজেলা হাবিবুর রহমান জানান, তিনি তার স্ত্রী ও পরিবারসহ ৫ জন এখানে এসেছেন। এখানকার মনোমুগ্ধকর পরিবেশ দিকে তিনি অভিভূত। রামসাগরের জলরাশির পাশে স্থাপন করা হয়েছে দর্শনাথীদের বসার জন্য স্থায়ী ব্যবস্থা। এসব স্থানে বসে রামসাগরের পানির মনোরম দৃশ্য উপভোগ করে আনন্দিত হচ্ছেন তারা।রামসাগরে ঘুরতে আসা পর্যটক মানিকগঞ্জ জেলার আরিফুজ্জামান জানান,তারা ৪ জন এখানে গত দু’দিন গেস্ট হাউসে থেকে এখানকার মনমুগ্ধকর পরিবেশ উপভোগ করছেন।
রামসাগরের চারিদিক ঘুরেফিরে দেখছেন নান্দনিক পরিবেশ ও মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। তারা বলছেন, জাতীয় উদ্যান ঘোষণা হলে তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। আরো নতুন কিছু সংযোজন করা হলে পর্যটকদের আগমন আরো বাড়বে।
তিনি বলেন, ৪/৫ জনের স্পিড বোডে দিঘির পানিতে ঘুরার জন্য ব্যবস্থা রয়েছে। দর্শনার্থীরা স্পিড বোর্ডে দিঘির পানিতে ঘুরে তৃপ্তি ও আনন্দ উপভোগ করছেন। এভাবেই দেশি- বিদেশি পর্যটক ও দর্শনাথীরা ঘুরতে এসে রাম সাগরের স্মৃতি বিজড়িত দৃশ্যের ছবি তুলে সংরক্ষণ করে নিয়ে যাচ্ছেন।
রামসাগরের দায়িত্বে নিয়োাজিত ফরেস্টার রুহুল আমিন বলেন, শীত মৌসুম আসার আগেই এবারে দর্শনার্থী ও পর্যটকদের ভীড় বেড়েই চলছে। আশা করা যাচ্ছে শীত মৌসুমে প্রতিদিন পিকনিক পার্টির সংখ্যা বেড়ে যাবে। সে ভাবে পূর্ব প্রস্তুতি রাখা হয়েছে। যাতে রামসাগর জাতীয় উদ্যানে এসে কোন পিকনিক পার্টি ও দর্শনাথীরা মনে কষ্ট নিয়ে ফিরে যান।
রামসাগর জাতি উদ্যানের রেঞ্জার আব্দুস সালাম তুহিন জানান, পর্যটক ও দর্শনার্থীদের জন্য একটি নির্ধারিত টাকা দিয়ে টিকিট কেটে রামসাগর জাতীয় উদ্যানে প্রবেশ করতে হয়। আগত পর্যটক ও দর্শনাথীরা এসব বিষয়ে কোন আপত্তি করেন না। আগতরা মনোরম পরিবেশে এখানকার সৌন্দর্য নান্দনিক পরিবেশ উপভোগ করে তৃপ্তি সহকারে ফিরে যান।
দিনাজপুর জেলা প্রশাসকের রাজস্ব বিভাগের তথ্য অনুযায়ী জানা যায়, ভূমিসহ রামসাগরের আয়তন ৪,৩৭,৪৯২ বর্গমিটার, দৈর্ঘ্য ১,০৩১ মিটার ও প্রস্থ ৩৬৪ মিটার। গভীরতা গড়ে প্রায় ১০ মিটার। পাড়ের উচ্চতা ১৩.৫ মিটার।
সরজমিন গিয়ে দেখা যায়, সদর উপজেলার তাজপুর গ্রামে অবস্থিত রামসাগর দিঘীটির পশ্চিম পাড়ের মধ্যখানে একটি ঘাট ছিল। যার কিছু অবশিষ্ট অংশ এখনও রয়েছে। বিভিন্ন আকৃতির বেলেপাথর স্ল্যাব দ্বারা নির্মিত ঘাটটির দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ ছিল যথাক্রমে ৪৫.৮ মিটার এবং ১৮.৩ মিটার। দিঘীটির পাড়গুলো প্রতিটি ১০.৭৫ মিটার উঁচু।
তাজপুর গ্রামের প্রবীণদের সাথে কথা বলে জানা যায়, রামসাগর নিয়ে অনেক ঐতিহ্য ও কল্প কাহিনীরয়েছে। ঐতিহাসিকদের মতে, দিনাজপুরের বিখ্যাত রাজা রামনাথ (রাজত্বকাল ১৭২২ থেকে ১৭৬০ খ্রিষ্টাব্দ) পলাশীর যুদ্ধের আগে (১৭৫০ থেকে ১৭৫৫ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে) এ রামসাগর দিঘি খনন করে ছিলেন। তার নামানুসারে এর নামকরণ করা হয় রামসাগর। জনশ্রুতি রয়েছে, দিঘীটি খনন করতে তৎকালীন প্রায় ৩০,হাজার টাকা ব্যয় হয়েছিল। দিঘীটি খনন কাজে ১৫ হাজার শ্রমিকের প্রয়োজন হয়েছিল। রামসাগর দিনাজপুর বন বিভাগের তত্ত্বাবধানে ১৯৬০ সালে দেয়া হয়েছে । ১৯৯৫-৯৬ সালে এ দিঘীকে একটি আধুনিক পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হয়। ২০০১ সালের ৩০ এপ্রিল এটিকে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
এলাকার জনসাধারণের জনশ্রুতি মতে, এ দিঘী নিয়ে প্রচলিত আছে বিভিন্ন লোককথা। কথিত আছে, গত ১৭৫০ খ্রিষ্টাব্দে এক খরা দেখা দিলে পানির অভাবে মৃতপ্রায় হয়ে পড়ে হাজার হাজার প্রজা। এসময় দয়ালু রাজা প্রাণনাথ স্বপ্নাদেশ পেয়ে একটি পুকুর খনন করেন। মাত্র ১৫ দিনে এর খনন কাজ সম্পন্ন হয়। কিন্তু সেই পুকুর থেকে পানি না ওঠায় এক সময় রাজা স্বপ্নে দৈববাণী পেলেন যে, তার একমাত্র ছেলে রামকে দীঘিতে বলি দিলে পানি উঠবে। স্বপ্নাদিষ্ট রাজা, দীঘির মাঝখানে একটি ছোট মন্দির নির্মাণ করেন। তারপর এক ভোরে যুবরাজ রামনাথ সাদা পোশাকাচ্ছাদিত হয়ে হাতির পিঠে চড়ে যাত্রা শুরু করলেন সেই দীঘির দিকে। দীঘির পাড়ে পৌঁছে যুবরাজ রাম সিঁড়ি ধরে নেমে গেলেন মন্দিরে। সঙ্গে সঙ্গে দিঘীর তলা থেকে অঝোর ধারায় পানি উঠতে লাগল। চোখের পলকে পানিতে ভরে গেল বিশাল দীঘি। আরও একটি লোককাহিনী শোনা যায়। দিঘি খনন করার পর রাজা রামনাথ পানি না উঠলে স্বপ্ন দেখেন রাজা দিঘীতে কেউ প্রাণ বিসর্জন দিলে পানি উঠবে। তখন রাম নামের স্থানীয় এক যুবক দিঘিতে প্রাণ বিসর্জন দেয়। পরবর্তিতে রাজার নির্দেশে সেই যুবকের নামে দিঘীর নামকরণ করা হয় রামসাগর। এসব মুখোরচক কাহিনী রামসাগরকে ঘিরে অনেক প্রচলিত আছে। তবে রামসাগর একটি দেশের পর্যটক সম্পদ। যা বিগত সময়ে সরকার জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করেছেন। জাতীয় উদ্যান ঘোষণা হলেও সামগ্রিক নির্মাণ কাজ এখনো সম্পূর্ণ হয়নি। মাস্টার প্লান অনুযায়ী নির্মাণ কাজ আর্থিক বরাদ্দ সাপেক্ষে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছেন। এ সম্পদ সংরক্ষণে সরকার তথা সকলকে দয়িত্বভার গ্রহণ করতে হবে। তবে ঐতিহ্যবাহী রামসাগর ফিরে পাবে সৌন্দর্য।