সীতাকুণ্ডে পরিবেশবান্ধব তালগাছের বিলুপ্ততায় বাড়ছে প্রাকৃতিক দূর্যোগজনিত মৃত্যূঝুঁকি। ৯টি ইউনিয়ন ও ১ পৌরসভা নিয়ে গঠিত সীতাকুণ্ড উপজেলায় রয়েছে ১২০টি গ্রাম। উপজেলার দক্ষিণাঞ্চলে গড়ে উঠা ব্যাপক শিল্প-কারখানায় তালগাছের নিবিড় বনায়নে মাত্রাতিরিক্ত প্রভাব পড়লেও সৈয়দপুর, বারৈয়াঢালা, সীতাকুণ্ড সদর, মুরাদপুর, বাঁশবাড়ীয়া ও কুমিরায় আকাশ ছুঁই-ছুঁই সারি-সারি তালগাছের সেই নিবিড় বনায়ন এখন শুধুই স্মৃতি আর স্মৃতি। তালপাতায় বাবুই পাখির শৈল্পিক বাসা বাতাসে দুলে-দুলে গভীর মুগ্ধতা ছড়িয়ে আদিকাল থেকেই তালগাছ বাড়িয়ে আসছে সীতাকুণ্ডের গ্রাম-বাংলার শোভা ও ঐতিহ্য। চিরকাল ধরেই তালগাছ বজ্রপাতজনিত প্রাকৃতিক দূর্যোগ হতে সীতাকুণ্ডবাসিকে রক্ষা করে আসছে। বজ্রপাত থেকে রক্ষায় উচু তালগাছের কোন বিকল্প নেই। তালগাছ হারিয়ে যাওয়ায় উপজেলায় প্রতিনিয়ত বাড়ছে বজ্রপাতজনিত মৃত্যুহানি। রেহাই পাচ্ছেনা পশু-পাখিরাও। গত আষাঢ়ে ১নং সৈয়দপুরের মহানগর গ্রামের দরিদ্র কৃষক মোঃ মাসুদের ৩টি গরু বজ্রপাতে নিহত হওয়ার ঘটনায় মারাত্বক হতাশা নেমে আসে সীতাকুণ্ডের কৃষক পরিবারে। গত শনিবার বজ্রপাতে ৭নং কুমিরা ইউনিয়নস্থ কাজীপাড়ায় দরিদ্র কৃষক মোঃ হাশেমের ৩টি ও মুরাদপুর, সৈয়দপুরে আরো ৪টি গরু এবং ১টি মহিষের মৃত্যূতে কৃষক পরিবারে বাড়ছে আহাজারি। আমিরাবাদের বাসিন্দা সীতাকুণ্ড আদর্শ ফুটবল একাডেমীর প্রশিক্ষক মোঃ নুরুচ্ছাফা জানান, বর্তমানে সরকারি ভাবে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় তালগাছ রোপনের উদ্যোগে দেশের অন্যান্য স্থানের মতো উপজেলায় হারিয়ে যাওয়া তালগাছের পুনঃ বনায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সমুদ্র-পাহাড়ে অপরূপ উপজেরার প্রকৃতির জীব-বৈচিত্র্য রক্ষায় বাড়ীর আঙ্গিনার পাশে, রাস্তার ধারে, বেড়ীবাঁধ, অনাবাদি কিংবা পতিত জমি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তালগাছ রোপনের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। আলাকুলিপুরের বাসিন্দা চট্টগ্রাম জজ আদালতের সিনিয়র আইনজীবি এডভোকেট হুসাইন মুহাম্মদ আশরাফুদ্দীন জানান, প্রাচীনকাল থেকেই তালগাছ তার রস, ফল ও বীজের শাঁস দিয়ে ভোজনরসিক সীতাকুণ্ডবাসীর রসনাবিলাস করে আসছে। তালে রয়েছে ভিটামিন এ, বি, ও সি, রয়েছে জিংক, পটাসিয়াম, আয়রন ও ক্যালসিয়াম সহ অনেক খনিজ উপাদান। তালের রস দিয়ে গুড়, পাটালি, মিছরি, পায়েস এবং তাড়িসহ ইত্যাদি তৈরি করা হয়। জৈষ্ঠ্য-আষাঢ়ে কাঁচা তালের শাঁস খাওয়ার জন্য গ্রাম বাংলায় চারিদিকে হৈ-চৈ পড়ে যায়। শ্রাবণ মাসে পাকা তালের হলুদ রসে তালের পিঠা, তালের রুটি, তালসত্ব এবং তালের বড়াসহ আরো কতো বাহারি রকম পিঠা স্বাদে-গন্ধে কদর দেশব্যাপী আদি ও অকৃত্রিম। ত্বকের বিভিন্ন সমস্যায় সমাধান, স্মৃতি শক্তি বৃদ্ধি, সু-স্বাস্থ্য রক্ষা, হজম শক্তি বৃদ্ধি, কোষ্ঠ্য-কাঠিন্য দুর, হাড়কে শক্তিশালী করাসহ পাকা তালের রসে রয়েছে বহু পুষ্টিগুন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা পরিবেশের ভারসাম্য হতে রক্ষা করা ছাড়াও তালপাতা দিয়ে ঘর ছাওয়া, চাটাই, মাদুর, আঁকার পট, পুতুল, বিভিন্ন কুটির শিল্প ও হাতপাখা তৈরিতে রয়েছে অপরিসীম ভূমিকা। আর তালের কান্ড দিয়ে তৈরি হচ্ছে ঘরের খূূূূূূূূূূূূূূূূূূূূুঁটি, ভেলা ও নৌকা। পরিবেশবাদী লেখক অধ্যক্ষ মুকতাদের আজাদ খান জানান, তালগাছ অন্যতম পরিবেশবান্ধব, জনপ্রিয়, ঐতিহ্যবাহী ও প্রাকৃতিক দূর্যোগ থেকে রক্ষাকারী পরমবন্ধু। এক সময় গ্রাম-বাংলার অধিকাংশ বাড়ী-ঘর, রাস্তার দু-পাশ, পুকুরপাড়, বেড়িবাঁধ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রচুর তালগাছ ছিল। তখন দুর থেকে কোন বাড়ী বা স্থান চেনাতে তালগাছের ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে সেই দিন আর নেই। কালের পরিক্রমায় আজ হারিয়ে যাচ্ছে পরিবেশবান্ধব ঐতিহ্যবাহী তালগাছ। তালগাছের সাথে হারিয়ে যাচ্ছে পাতায় বাসা তৈরি করে অবস্থান করা হাজার হাজার বাবুই পাখির কিচির-মিচির ডাকের মনোরম দৃশ্য।