বৃহস্পতিবার, ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:৩৯ অপরাহ্ন

‘ভারতে হিন্দু-মুসলিম সহিংসতার মূল হোতা মনুকে পুলিশ খুঁজে পায় না’

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় শনিবার, ৫ আগস্ট, ২০২৩

ভারতের হরিয়ানায় ভয়াবহ ধর্মীয় সহিংসতার কেন্দ্রে ২৮ বছরের যুবক মনু মানেশ্বর। তিনি ওয়ান্টেড বা দাগী আসামী। তিনি টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন। অথচ পুলিশ তাকে খুঁজে পাচ্ছে না। তিনি অনলাইনেও সক্রিয়। এ খবর দিয়ে অনলাইন বিবিসি বলছে, রাজধানী দিল্লির সীমান্ত লাগোয়া একটি অভিজাত শহর গুরুগ্রাম। আগে এর পরিচিতি ছিল গুরগাঁ নামে। গত সপ্তাহ থেকেই এই শহরের কিছু অংশ ও অন্য কিছু জেলায় রাস্তায় রাস্তায় সহিংস লড়াই দেখেছে মানুষ। দোকানে, গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। এতে কমপক্ষে ৬ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে আছেন মুসলিমদের একজন ধর্মীয় নেতাও।
আহত হয়েছেন কয়েক ডজন মানুষ। এর মধ্যে আছে পুলিশও। আসলে এই সংঘর্ষ হয়েছে হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে। পুলিশ বলেছে, গত সোমবার হিন্দু জাতীয়তাবাদী বজরং দল এবং বিশ্ব হিন্দু পরিষদ একটি ধর্মীয় র‌্যালি বের করে নুহ জেলায়। সেখানে ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। এতে সহিংসতা শুরু হয়। এই সহিংসতার কেন্দ্রে মোহিত যাদব, যিনি মনু মানেশ্বর হিসেবেই বেশি পরিচিত, তাকে অভিযুক্ত করে রিপোর্ট প্রকাশ করছে ভারতের মিডিয়া। বলা হচ্ছে, হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধনে উত্তেজনা সৃষ্টির কেন্দ্রে এই মনু মানেশ্বর। নুহ জেলাবাসী ও বেশ কিছু মুসলিম রাজনীতিক বলেছেন, মনু মানেশ্বরের একটি ভিডিওকে কেন্দ্র করে এই উত্তেজনা। তিনি র‌্যালির ঠিক দু’দিন আগে ওই ভিডিও প্রকাশ করেন। তাকে কেন্দ্র করেই উত্তেজনা থেকে সংঘর্ষ সৃষ্টি হয়। ভারতীয় মিডিয়াকে অনেক মুসলিম অধিবাসী বলেছেন, যদি ওই ভিডিওটা প্রকাশ না হতো তাহলে নুহ জেলাকে জ্বলতে হতো না।
মনু মানেশ্বরের ওই ভিডিওতে দেখা যায় তিনি সোমবারের র‌্যালিতে বিপুল সংখ্যক হিন্দুকে যোগ দেয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন। তার ভাষায়- এই র‌্যালিতে সমর্থক ও টিমের সঙ্গে আমিও থাকবো। মনু মানেশ্বর বলেছেন, এই ভিডিও তো স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। এতে দোষের কি আছে? একজন বাস ও ট্রাক চালকের ছেলে মনু মানেশ্বর। তার তৈরি কিছু জায়গা শ্রমিকদের কাছে ভাড়া দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। কিন্তু রাজনৈতিক কর্মকা-ের কারণে মাঝে মাঝেই তিনি সংবাদ শিরোনাম হন। এক দশক আগে তিনি যোগ দিয়েছেন উগ্র কট্টর হিন্দুত্ববাদী গ্রুপ বজরং দলে। বছরের পর তার পদোন্নতি হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তিনি আগ্নেয়াস্ত্রসহ পোজ দিয়ে ছবি তুলে তা পোস্ট করেছেন। এর মধ্যে আছে মেশিনগানও। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, পুলিশের সিনিয়র কর্মকর্তা ও শক্তিধর মন্ত্রীদের সঙ্গে আছে তার সেলফি। হরিয়ানা সরকারের ‘কাউ প্রটেকশন টাস্কফোর্সে’র একজন সদস্য তিনি। নুহ অঞ্চলে বজরং দলের গরু রক্ষা ইউনিটের প্রধানও তিনি। বলেছেন, গরুকে বহু হিন্দু পবিত্র হিসেবে বিবেচনা করেন। তাই হিন্দুত্ববাদ এবং গরুকে রক্ষার সত্যিকার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
রাজস্থান, হরিয়ানা সহ ভারতের অনেক রাজ্যেই গরু জবাই নিষিদ্ধ। কয়েক বছরে গরু জবাই বা স্থানান্তরের সন্দেহে বহু মুসলিমকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে সেখানে। সমর্থকদের কাছ থেকে ব্যাপক জনপ্রিয়তা উপভোগ করেন মনু মানেশ্বর। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আছে তার অনেক ফ্যান পেজ। তারা মনে করেন, মনু ও তার টিমের প্রচেষ্টায় কমপক্ষে ৫০টি গরুকে রক্ষা করতে পেরেছেন। নুহ এলাকায় তারা ‘কাউ ভিজিল্যান্টিস’ বা গরুর ওপর নজরদারিকারী গ্রুপ বলে পরিচিত। ওই এলাকার মুসলিমদের অভিযোগ, কোনো প্রমাণ ছাড়াই এসব গ্রুপ মুসলিমদের ওপর হামলা চালায়। তাদেরকে অপদস্ত করে।
মনু মানেশ্বর সব সময়ই বলেন তিনি এবং তার দল প্রশাসনের সঙ্গে এবং আইন মেনে কাজ করছেন। তার ভাষায়- গরু এবং হিন্দুত্ববাদ রক্ষা করা আমাদের কর্তব্য। কিন্তু আমরা সব সময় প্রশাসনের সঙ্গে কাজ করি। যখন আমরা গরু পাচারকারীকে ধরতে পারি, তাদেরকে পুলিশের কাছে সোপর্দ করি। কিন্তু তার এই দাবির বিপক্ষ যুক্তি আছে। তা হলো কয়েক বছর ধরে মনু মানেশ্বর নিজে ও তার সমর্থকরা নিয়মিতভাবে গরু পাচারকারী এবং ট্রাক আটকে তাদেরকে প্রহারের ছবি ও ভিডিও পোস্ট করেছেন। এসব ভিডিওর কয়েকটিতে তিনি নিজে নির্যাতিত একজন মুসলিম হিসেবে পোজ দিয়েছেন। তার শরীরে, মুখে রক্ত লেগে আছে। লোকজনকে জয়শ্রীরাম এবং মাদার কাউ স্লোগান দিতে বাধ্য করেছেন তিনি। এমন ভিডিও শেয়ার দিয়েছেন। ফেব্রুয়ারিতে জুনায়েদ ও নাসির নামে দু’জন মুসলিমকে হত্যার জন্য অভিযুক্ত তিনি। তার বিরুদ্ধে আছে অপহরণ, অপদস্ত করা এবং হত্যার অভিযোগ। তবে মনু এসব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন। পার্শ্ববর্তী রাজস্থান রাজ্যের আদালতের ডকুমেন্ট অনুযায়ী, গরু ব্যবসার অভিযোগে গরু রক্ষা ইউনিটের বজরং দল ১৫ই ফেব্রুয়ারি নুহ এলাকায় মুসলিমদের অপহরণ করে। তাদেরকে নৃশংসভাবে নির্যাতন করা হয়। একদিন পরে, হরিয়ানায় একটি পুড়ে যাওয়া গাড়ির ভিতর পুড়ে ভষ্ম হয়ে যাওয়া অবস্থায় উদ্ধার করা হয় ওইসব মুসলিমের মৃতদেহ। এ ঘটনার পর হরিয়ানা পুলিশ বলেছে, মনু মানেশ্বর পলাতক। তিনি কোথায় আছেন পুলিশ তা জানে না। এরই মধ্যে তাকে গ্রেপ্তার করতে হরিয়ানা সফরে যায় রাজস্থান পুলিশ। তাকে খুঁজে পায়নি তারা। কিন্তু মনু মানেশ্বরের নতুন নতুন ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিয়মিত প্রকাশ হচ্ছে। তার একাউন্টে, সমর্থক ও ভক্তদের একাউন্টে শেয়ার হচ্ছে।
সোমবারের সহিংসতার পর থেকে ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলোতে বেশ কয়েকটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন মনু মানেশ্বর। সেখানে সহিংসতায় তার ভূমিকার কথা বেমালুম অস্বীকার করেছেন। বলেছেন, বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতাদের পরামর্শে তিনি ওই ইভেন্টে অংশ নেননি। সহিংসতার জন্য স্থানীয় কিছু মুসলিম নেতাকে দায়ী করেছেন তিনি। বলেছেন, হিন্দুরা তাদের ধর্ম বা গরুর ওপর যেকোনো রকম আক্রমণ সহ্য করে না। হত্যার অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, ঘটনার সময় তিনি সেখানে ছিলেন না। এ থেকেই বহু প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। যেমন ভারতীয় মিডিয়া যদি তাকে খুঁজে পায়, তার সঙ্গে সাক্ষাৎকার নিতে পারে, তাহলে দুটি রাজ্যের পুলিশ কেন তাকে খুঁজে পায় না? এ বিষয়ে রাজস্থান ও হরিয়ানার পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিবিসি। কিন্তু তারা কোনো জবাব দেননি। অন্যদিকে স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমগুলো তাকে গ্রেপ্তারের জন্য অব্যাহতভাবে চাপ দিয়ে যাচ্ছে। এর প্রেক্ষিতে বুধবার রাতে একটি হিন্দি নিউজ চ্যানেলকে মনু মানেশ্বর বলেছেন, মামলা থেকে তার নাম বাদ দিতে শিগগিরই হরিয়ানা ও রাজস্থান পুলিশের কাছে শতকরা ১০১ ভাগ ধরা দেবেন নিজে।
বৃহস্পতিবার সকালে হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী এমএল খাত্তার বলেন, নিজের রাজ্যে মানেশ্বর কোনো ওয়ান্টেড ব্যক্তি নন। তার বিষয়ে রাজস্থান পুলিশকে সহায়তা করবে তার সরকার। পুলিশ বলেছে ৬ই ফেব্রুয়ারি সহিংসতা সহ দাঙ্গা ও আরও সহিংসতার অভিযোগ আছে মনু মানেশ্বরের বিরুদ্ধে। একজন পুলিশ কর্মকর্তা ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেছেন, মনু একটি অ্যাটেম্পট টু মার্ডার কেসে অভিযুক্ত। পার্শ্ববর্তী একটি স্পট থেকে ভিডিওতে তাকে দেখা গেছে বন্দুক থেকে গুলি ছুড়তে। ক্রাইম ব্রাঞ্চ সহ পুলিশের বেশ কয়েকটি টিম তাকে শনাক্ত করতে কাজ করছে। এখনও তিনি কোথায় আছেন তা চিহ্নিত করা যায়নি।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com