শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:৪৫ অপরাহ্ন
শিরোনাম ::

স্মার্ট বাংলাদেশে ৩৯ শতাংশ ‘নিরক্ষতার’ চ্যালেঞ্জ

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় শনিবার, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

সাক্ষরতায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান তুলনামূলক ভালো। আটটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ তিন নম্বরে, ভারতের চেয়েও এগিয়ে। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখনও বৃহৎ সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে সাক্ষরতার বাইরে রেখে ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ একটি বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে। আন্তর্জাতিক সংস্থা ম্যাক্রোট্রেন্ড-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান তুলনামূলক ভালো। তবে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২৩ সালের তথ্যমতে, বাংলাদেশে কার্যকরী সাক্ষরতার হার ৬০ দশমিক ৭৭ ভাগ। যদিও বর্তমানে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে— বাংলাদেশে মোট সাক্ষরতার হার ৭৬ দশমিক ০৮ শতাংশ। আর নিরক্ষর রয়েছে ২৩ দশমিক ৯২ শতাংশ। তবে সাক্ষরতার এই হারেও সস্তুষ্ট নয় বাংলাদেশের উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষা ব্যুরো। শিক্ষাবিদ ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে প্রায়োগিক সাক্ষরতা নেই ৩৯ দশমিক ২৩ শতাংশ মানুষের।
জানতে চাইলে শিক্ষাবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসে (৮ সেপ্টেম্বর) যে তথ্য দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশে সাক্ষরতার হার ৭৬ দশমিক শূন্য ৮ ভাগ; এটা নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ রয়েছে। মন্ত্রণালয়ের হিসাবে ২৩ দশমিক ৯২ শতাংশ জনগোষ্ঠীকে সাক্ষরতার আওতায় আনা যায়নি। সেটাও তো অবজ্ঞা করার সুযোগ নেই। সরকারি সংস্থা (বিবিএস) দেখিয়েছে, দেশের ৩৯ দশমিক ২৩ শতাংশ মানুষ প্রায়োগিক সাক্ষরতার মধ্যে নেই। পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যই সঠিক হবে। তবু যদি মন্ত্রণালয়ের তথ্য সঠিক ধরি, তাহলে আমাদের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সময় বাকি আছে সাত বছর (২০৩০)। যা দীর্ঘদিনে পারিনি, তাহলে এই সাত বছরে কীভাবে সাক্ষরতার লক্ষ্য পূরণ করবো?’
রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, উপানুষ্ঠানিক বা বিকল্প শিক্ষার ক্ষেত্রে তিনটি শ্রেণি রয়েছে। একটি প্রাথমিক শেষ করে অথবা প্রাথমিক থেকে যারা ঝরে গেছে, যারা ১১ থেকে ৪৫ বছর বয়সী কখনও শিক্ষার আলো দেখেনি, আর লক্ষ্য পূরণে আমাদের প্রতিশ্রুতি সব নাগরিকের শিক্ষা নিশ্চিত করা।
২০৩০ সালের মধ্যে সব নাগরিকের মৌলিক শিক্ষা নিশ্চিত করার আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতি রয়েছে উল্লেখ করে এই শিক্ষাবিদ বলেন, ‘সাংবিধানিক অঙ্গীকারও সব নাগরিকের জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করা। অষ্টম ও প ম-বার্ষিকী পরিকল্পনার চলমান লক্ষ্যমাত্রাও রয়েছে। এসব লক্ষ্য পূরণ করতে হলে সরকারকে গুরুত্ব দিতে হবে। আর শুধু সাক্ষরতা পৃথিবীতে গ্রহণযোগ্য নয়। সাক্ষরতার সঙ্গে দক্ষতা থাকতে হবে। ২০৩০ সালের লক্ষ্যমাত্রাসহ সব লক্ষ্যমাত্রা পূরণের জন্য রোডম্যাপ করে এগুতে হবে। বেশিরভাগ সাক্ষরতা কর্মসূচি প্রকল্পভিত্তিক। প্রকল্প শেষ হলে আর দুই তিন বছরে শুরু হয় না। এগুলো বিমাতাসুলভ আচরণ। একদিকে এসডিজি, আরেকদিকে স্মার্ট বাংলাদেশ, তাছাড়া ডেমোগ্রাফিক ডিবিডেন্ট রয়েছে। এসবের ফসল আমরা ঘরে তুলতে পারবো। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে আমরা পুরোপুরি অংশ নিতে পারবো না। তাই সরকারকে পরিকল্পনা করে, রোডম্যাপ ঠিক করে বিনিয়োগ করতে হবে।’
‘কার্যকরী সাক্ষরতা’র হার বাড়াতে হবে বলে মনে করেন উন্নয়নকর্মী ও শিক্ষা গবেষক কে এম এনামুল হক। তিনি বলেন, ‘কার্যকরী সাক্ষরতার মধ্যে নতুন করে যুক্ত হয়েছে ডিজিটাল টেকনোলজি ব্যবহার। সাক্ষরতার সংজ্ঞা যেহেতু পরিবর্তন হয়েছে, সে কারণে বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে হলে শুধু লিখতে আর পড়তে পারা এখন সাক্ষরতা নয়। লিখতে-পড়তে পারা, পড়ে বুঝতে পারা, হিসাব করতে পারা ও গণনা করা ইত্যাদি ছাড়াও ডিজিটাল টেক্সট নির্ভর তথ্য খুঁজে বের করা এবং যোগাযোগের দক্ষতাও থাকতে হবে। এগুলো ছাড়া পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে নিজের অবস্থান টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। এই পরিস্থিতিতে গণশিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। কার্যকরী সাক্ষরতা সম্পন্ন জনগোষ্ঠী তৈরি করে তাদের কাজে লাগাতে হবে। এসব ছাড়া এসডিজির লক্ষ্য অর্জন বা ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত স্মার্ট বাংলাদেশ গড়া সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব হবে না।’
সাক্ষরতায় অর্থায়ন বন্ধ: সংশ্লিষ্টদের সুপারিশ—ঝরে পড়া শিশুসহ বয়স্কদের প্রায়োগিক সাক্ষরতা অর্জন করাতে বিনিয়োগ করতে হবে গণশিক্ষায়। অথচ ২০২৩ সালের জুলাই থেকে বিনিয়োগ বন্ধ রয়েছে।
উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষা ব্যুরোর তথ্যমতে, চতুর্থ প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচির (পিইডিপি-৪) সাব-কম্পোনেন্টের আওতায় ৮ থেকে ১৪ বছর বয়সের বিদ্যালয় বহির্ভূত ১০ লাখ শিশুকে উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। ইতোমধ্যে পিইডিপি-৩ থেকে আগত বিদ্যালয় বহির্ভূত ১ লাখ শিশুকে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়া কার্যক্রম শেষ হয়। অবশিষ্ট ৯ লাখের মধ্যে এ পর্যন্ত ৮ লাখ ২ হাজার ৫৩৬ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে এবং ২৫ হাজার ৭১২টি শিখন কেন্দ্রের মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ে পাঠদান কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এই অবস্থায় কর্মসূচিতে অর্থায়ন করা হচ্ছে না জুলাই থেকে।
উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর মহাপরিচালক ড. মো. আবুল কালাম আজাদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাংলাদেশে সাক্ষরতার হার ৭৬ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ। সাক্ষরতার হার বাড়াতে ২০২৫ সাল পর্যন্ত সাক্ষরতা প্রকল্পটির কার্যক্রম বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয় বাড়ায়নি। মাত্র ৮শ থেকে ৯শ কোটি টাকার জন্য প্রোগ্রামটি বন্ধ হয়ে গেলো। ঝরে পড়া ২০ লাখ শিশুর লেখাপড়ার সুযোগ হারাতে যাচ্ছে। ২০৪১ সালের মধ্যে নিরক্ষরমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে কাজ করছি। কারণ দেশের একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠী নিরক্ষর রেখে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়া সম্ভব হবে না।’
সাক্ষরতা ও কার্যকরী সাক্ষরতা: উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর মহাপরিচলক ড. মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘সাক্ষরতা বলতে শুধু অক্ষর বা বর্ণ চেনা নয়; লিখতে, পড়তে ও বলতে পারা। সাক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন ব্যক্তি ন্যূনতম লেখাপড়া করতে পারবে। গণনা করা ও সাধারণ হিসাব করতে পারবে। পত্রিকা পড়তে ও বুঝতে পারবে। শুধু নাম সাক্ষর করতে পারলেই সাক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন বলা যাবে না। ’
বিবিএস এর তথ্যমতে, সাক্ষরতার হার পরিমাপ পদ্ধতি একমুখী নয়। প্রচলিত সংজ্ঞায় পঠন, লিখন ও গণনা বোঝানো হয়েছে। বর্তমানে ইউনেস্কো থেকে সাক্ষরতা বলতে বোঝানো হয়েছে, একটি ডিজিটাল টেক্সট নির্ভর তথ্য খুঁজে বের করা এবং পৃথিবীর দ্রুত পরিবর্তনের সঙ্গে বিভিন্ন জিনিস চিনতে পারা, বোঝানো, ব্যাখ্যা দিতে পারো, কোনও কিছু তৈরি এবং যোগাযোগ দক্ষতাকে সাক্ষরতা বোঝায়।
সাক্ষরতা বলতে পঠন, লিখন, জীবনব্যাপী সংখ্যার ব্যবহার করার মাধ্যমে শিখন এবং দক্ষতা বোঝায়। ডিজিটাল দক্ষতা, সংবাদ সম্পর্কে জ্ঞান, টেকসই উন্নয়নে শিক্ষা, বৈশ্বিক নাগরিকত্ব এবং বিভিন্ন কাজের সঙ্গে সম্পর্কিত দক্ষতা। ডিজিটাল টেকনোলজি ব্যবহার করে সাক্ষরতার দক্ষতা দিন দিন পরিবর্তন হচ্ছে এবং মানুষ তথ্য এবং শিখন প্রক্রিয়ায় নান ধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে।
প্রায়োগিক সাক্ষরতার অবস্থা: বিবিএসএর তথ্যমতে, দেশে ১৫ বছরের বেশি জনগোষ্ঠীর মধ্যে মোট সাক্ষরতার হার ৬০ দশমিক ৭৭। এর মধ্যে পুরুষ ৫৮ দশমিক ২৪ শতাংশ এবং নারী ৬২ দশমিক ৮৪ শতাংশ। আর ৭ থেকে ১৪ বছরের বয়সীদের মোট সাক্ষরতার হার ৭২ দশমিক ৯৭ ভাগ। এই বয়সীদের মধ্যে সাক্ষরতায় পুরুষ ৬৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ এবং নারী ৭৬ দশমিক ৪২ শতাংশ। অন্যদিকে ১৫ বছরের বেশি বয়সী জনগোষ্ঠীর মধ্যে সেমি-লিটারেট ও নিরক্ষর মোট ৩৯ দশমিক ২৩ শতাংশ। সেমি-লিটারেট ও নিরক্ষর এই বয়সী পুরুষ ৪১ দশমিক ৭৬ শতাংশ এবং নারী ৩৭ দশমিক ১৬ শতাংশ।
বিবিএসএর সাক্ষরতার প্রায়োগিক জরিপ অনুয়ায়ী গ্রাম ও শহরের সাক্ষরতার মধ্যে তফাৎ রয়েছে। শহরের চেয়ে গ্রামে সাক্ষরতার হার কম। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে সাক্ষরতার হার আরও কম। জেন্ডারভিত্তিতে নারী ও পুরুষের মধ্যে গড় তফাৎ বেশি না থাকলেও প্রান্তিক পর্যায়ে সাক্ষরতার হার কম। বিবিএস এর তথ্যমতে, কার্যকরী সাক্ষরতায় বাংলাদেশের গ্রাম ও শহর মিলিয়ে ৭ থেকে ১৪ বছর বয়সীদের সাক্ষরতার হার ৭২ দশমিক ৯৭ ভাগ। শহরে সাক্ষরতার হার ৭৬ দশমিক ৪৯ এবং গ্রামে সাক্ষরতার হার ৭১ দশমিক ৪৭ ভাগ। ১৫ বছর বা তার বেশি বয়সী মানুষের মধ্যে গ্রাম ও শহর মিলিয়ে সাক্ষরতার হার ৬০ দশমিক ৭৭ ভাগ। শহরে সাক্ষরতার হার ৭১ দশমিক শূন্য ৬ ভাগ এবং গ্রামে ৫৬ দশমিক ১২ ভাগ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন— এসডিজি লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে গ্রামে সাক্ষরতার হার পিছিয়ে থাকা একটি চ্যালেঞ্জ।
দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান: ম্যাক্রোট্রেন্ড-এর তথ্যমতে, ২০২১ সালের আফগানিস্তানে সাক্ষরতা ৩৭ দশমিক ২৭ শতাংশ, দক্ষিণ এশিয়ায় দেশটির সাক্ষরতায় আট নম্বর অবস্থানে রয়েছে। ২০১৯ সালে পাকিস্তানের সাক্ষরতা ৫৮ শতাংশ, দক্ষিণ এশিয়ায় সাক্ষরতার হারে দেশটির অবস্থান ৭ নম্বরে। ভুটানে ২০২১ সালে সাক্ষরতার হার ৭০ দশমিক ৯৫ শতাংশ, দক্ষিণ এশিয়ায় সাক্ষরতার হারে দেশটির অবস্থান ছয় নম্বরে। ২০২১ সালে নেপালে সাক্ষরতা ৭১ দশমিক ১৫ শতাংশ, দক্ষিণ এশিয়ায় দেশটির অবস্থান ৫ নম্বরে। ভারত দক্ষিণ এশিয়ায় সাক্ষরতার হারে রয়েছে চার নম্বরে, ২০১৮ সালে দেশটিতে সাক্ষরতার হার ৭৪ দশমিক ৩৭ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ায় তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ, ২০২০ সালে বাংলাদেশের সাক্ষরতা ৭৪ দশমিক ৯৭ শতাংশ। যদিও বর্তমানে বাংলাদেশে সাক্ষরতা ৬৭ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে শ্রীলঙ্কা, ২০২০ সালে দেশটিতে সাক্ষরতা ৯২ দশমিক ৩৮ শতাংশ। এই অ লে সাক্ষরতায় প্রথম অবস্থানে রয়েছে মালদ্বীপ, ২০২১ সালে দেশটিতে সাক্ষরতার হার ৯৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com