গাজীপুর কালীগঞ্জের নিম্নঞ্চল গুলোতে বর্ষার পানিতে এখন টৈটুম্বুর। বিশেষ করে উপজেলার বিলগুলোতে এখর ভরা যৌবন। বর্ষার নতুন পানিতে প্রাণ ফিরে পেয়েছে বিল বেলাই, ভাটিরা বিলসহ উপজেলা বেশ কিছু বিল। জেলেদের পাশাপাশি ব্যাস্ততা বেড়ে গেছে বিল পাড়ের মানুষের। জীবন জীবিকার অন্বেষণে তারা চষে বেড়াচ্ছে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। বিলের জলাশয়গুলো স্থানীয় মানুষের আহারের ব্যাবস্থা করে চলেছে বিভিন্ন উপায়ে। সাধারণত বর্ষা মানুষের জীবনে দুর্ভোগ নিয়ে আসলেও বিল পাড়ের মানুষের জন্য বয়ে নিয়ে আসে আশির্বাদ। নতুন পানিতে ফুটে অসংখ্য শাপলা ফুল। ভোরে এসব ফুল একসাথে ফুটে উঠলে মনে হয় যেন শাপলার সাম্রাজ্য। আর এই শাপলাই স্থানীয়দের আহার যোগাতে সহযেীতা করে। জানা গেছে, এখন আর আগের মতো বিলে পানি আসেনা। পানি বেশি হলে শাপলা ফুল ফোটেও বেশি। রাজধানী ঢাকায় শাপলার ব্যাপক চাহিদা থাকায় প্রতিদিন বিল পাড়ের মানুষেরা শাপলা সংগ্রহে ভোর রাতে বেড়িয়ে পড়ে। বছর দশেক আগে এমন অবস্থা ছিলনা। হাতে গুনা কয়েকটা নৌকা দেখা যেত বিলে, যারা শাপলা সংগ্রহ করতো। এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। সকলেরই চাহিদা রয়েছে, মোটামুটি ভালো দামে বিক্রিও করা যায়। তাই কদর বেড়েছে শাপলার। ভোর রাত থেকে সকালের নাস্তা নিয়ে শাপলা তুলতে বের হয়ে যান মো. ইকাবাল হোসেন(৩৫)। তিনি বেলাই পাড়ের বাসিন্দা। পরিবারের বড় ছেলে হওয়ায় কর্তব্যের বোঝা এখন তার ঘাড়েই। পড়ালেখা শেষ করলেও জোটেনি ভালো মানের চাকুরী। সবশেষ বাবা রেখে যাওয়া অল্প জায়গাতে শুকনো মৌসুমে চাষাবাদ এবং বর্ষায় শাপলা বেচে সংসারের আহার যোগাড় করে চলেছেন। ইকবালের মতো আরো অনেকেই প্রকৃতির দান আমাদের জাতীয় ফুল শাপলা বিক্রি করে তাদের সংসার চালিয়ে আসছেন কয়েক দশক ধরে। বেলাই বিল পাড়ের বাসিন্দা মো. শরৎ আলী(৬৫) কথা হয়। তিনি প্রতিবেদকে জানান, শুষ্ক মৌসুমে গভীর নলকূপ স্থাপনের কাজ করেন এবং বর্ষাকালে শাপলা বিক্রি করেন। তিনি সকাল ৯টায় বের হন বিকেল ৫টা পর্যন্ত তিনি শাপলা তোলার কাজ করেন। এতে তিনি প্রতিদিন হাজার তিনেক টাকার শাপলা উত্তোলন করতে পারেন। বিল পাড়ের আরেক বাসিন্দা মো. আজহার মোল্লা (৪৫) বলেন, বর্ষায় আমগো কোন কাম কাইজ থাহেনা। বিলের হাবলা (শাপলা) বেইচ্চা যেই টেহা পাই তাই দিয়া কোনরকমে সংসার চালাইতে পারি। সমস্যা হইলো আগের মত এহন আর হাবলা ফুডে না বিলে। মানুষের সংখ্যা বাড়তাছে, সবাই হাবলা তোলার কারনে হাবলার পরিমাণও কইমা আইতাছে। আর কিছুদিন পরে হয়ত পাওয়াও যাইবোনা। মো. জমির উদ্দিন(৩৭) বলেন, শাপলা বিক্রির জন্য তিনি ঢাকার এক বড় ব্যাবসায়ীর সাথে চুক্তি করেছেন। প্রতিদিন প্রায় ১০০ আটি শাপলা ওই ব্যাবসায়ীকে দিলে তার আয় থাকে প্রায় ৫’শ থেকে ৬’শ টাকা। কিন্তু এত বেশি শাপলা তুলতে অনেক কষ্টসাধ্য ব্যাপার। শাপলা যে শুধু বিল পাড়ের মানুষ তোলে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন তা কিন্তু নয়। এই শাপলা তুলে অনেকে আবার সবজির চাহিদাও মেটান। উপজেলার বক্তারপুর ইউনিয়নের জয়রামবের গ্রামের বাসিন্দা ফুলরানী গমেজ(৫৭) বলেন, আমার মেয়ে ঢাকায় থাকে ওখানে যাবে। তাই কিছু শাপলা তোলে নিলাম মেয়ের জন্য। শাপলা খেতে মেয়ে খুব পছন্দ করে। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবীদ ফারজানা তাসলিম বলেন, শাপলা মানুষ চাষাবাদ করে ফলায় না। প্রাকৃতিক নিয়মেই বর্ষার পানিতে বেড়ে উঠে। কোন ধরনের যতœ ও পরিচর্যাও করা লাগেনা। কিন্তু আমরা যদি আমাদের মাটিকে উর্বর, কিটনাশক মুক্ত রাখতে না পারি তাহলে প্রকৃতির এই উপহার একদিন আমাদের চোখের সামনেই হারিয়ে যাবে। তিনি আরো বলেন, উপজেলার বেশ কয়েকটি জায়গায় থেকে প্রায় শতাধিক কৃষক ১’শ টনের মতো শাপলা সংগ্রহ কের প্রতিবছর। শাপলা অত্যন্ত পুষ্টিকর সবজি। এতে প্রচুর পরিমাণে খনিজ পদার্থ আছে। এছাড়া শর্করা, ক্যালসিয়াম, আমিষ পাওয়া যায়। তাই শাপলা দিন দিন জনপ্রিয় সবজি হয়ে উঠছেও তিনি জানান। কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আজিজুর রহমান বলেন, বর্ষা মৌসুমে এ অঞ্চলের মানুষের আয়ের পথ কমে যায় অনেকাংশে। বর্ষার পানির সাথে নতুন মাছ এবং বিলের শাপলা ২টি উপায়ে মানুষ বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখে। তবে অতিরিক্ত সংগ্রহে যেন আমাদের জাতীয় ফুলের বীজ ধ্বংস হয়ে বিলুপ্তির পথে না যায় সেদিকেও লক্ষ্য রাখাটা জরুরী বলে তিনি মনে করেন।