প্রবাদ আছে, সকাল দেখলেই বোঝা যায় দিনটা কেমন যাবে। গত শুক্রবার ১৩ অক্টোবর সকালেই দক্ষিণ কোরিয়ার বুসান শহরে বাংলাদেশের জন্য সুখবরের হাওয়া বইতে শুরু করে। ফলে রাতটা দারুণ হয়েই ধরা দিলো। লালগালিচার চাকচিক্য ও জমকালো মে বাংলাদেশের জয়ধ্বনি শোনা গেলো খানিক পরপর। আন্তর্জাতিক আঙিনায় এমন মাহেন্দ্রক্ষণ আর এসেছে কবে! বুসান চলচ্চিত্র উৎসবের ২৮তম আসরের নিউ কারেন্টস বিভাগে পুরস্কার জিতেছে ইকবাল হোসাইন চৌধুরী পরিচালিত দ্য রেসলার (বলী )। তিনি পেয়েছেন ৩০ হাজার ডলার (৩৪ লাখ টাকা)। সমাপনীতে তার হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়। এবারই প্রথম বুসানে বাংলাদেশের কোনও ছবি সেরার স্বীকৃতি পেলো। পুরস্কার গ্রহণের পর ‘বলী’তে স্বল্প উপস্থিতির একটি চরিত্রে অভিনয় করা শাহীনুরকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন ইকবাল হোসাইন চৌধুরী। তিনি শুরুতে বলেন, ‘জীবনে কখনও কিছু জিতিনি। এমনকি স্কুলে রচনা প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েও কিছু পাইনি। আমার জীবনের প্রথম এই পুরস্কার দুই জন বিশেষ মানুষকে উৎসর্গ করতে চাই। তাদের একজন হলেন প্রয়াত অভিনেতা শাহীনুর। অন্য জন হলেন আমার বাবা। তিনি মনে করতেন, চলচ্চিত্র দেখা অপরাধ। এর মাধ্যমে বাবা আমাকে চলচ্চিত্রের প্রতি আরও আগ্রহী করে তুলেছিলেন।’ এরপর ‘আব্বু’ বলতেই ইকবালের চোখ ছলছল করে ওঠে। তার এই আবেগ ছুঁয়ে গেছে কানায় কানায় পূর্ণ বিআইএফএফ আউটডোর থিয়েটারে বসা চার হাজার অতিথি ও দর্শকদের। তারা সবাই করতালিতে তরুণ নির্মাতাকে সাহস জোগান। তখন নিজেকে সামলে বাবার উদ্দেশে তিনি যোগ করেন, ‘আজ এই দিনে পাওয়া পুরস্কারটি তোমার জন্য।’
পুরস্কার বিতরণ শেষে ইকবাল হোসাইন চৌধুরী জানান, তার বাবা করোনাকালে মারা গেছেন। তখন ‘বলী’ চিত্রনাট্য ঘষামাজা করছিলেন তিনি। চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী জব্বারের বলী খেলার প্রেক্ষাপটে নির্মিত ছবিটির গল্প মধ্যবয়সী জেলে মজুকে কেন্দ্র করে। এর চিত্রায়ন হয়েছে চট্টগ্রামের উপকূলীয় এলাকায়। গল্পের প্রয়োজনে এতে চট্টগ্রামের আ লিক ভাষা ব্যবহার হয়েছে। ছবিটি প্রযোজনা করেছেন পিপলু আর খান। সহ-প্রযোজনায় সাইফুল আজিম ও গাউসুল আলম শাওন।
এশিয়ার প্রতিশ্রুতিশীল ও উদীয়মান নির্মাতাদের প্রথম ও দ্বিতীয় চলচ্চিত্রের প্রতিযোগিতা বিভাগ নিউ কারেন্টসে জাপানের মোরি তাতসুয়ার ‘সেপ্টেম্বর ১৯২৩’ ছবিটিও পুরস্কার পেয়েছে। ১৯২৩ সালের ১ সেপ্টেম্বর কান্তো ভূমিকম্পের পটভূমিতে তৈরি হয়েছে এটি। ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দেওয়া হয়। তখন গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, কোরীয়রা কূপগুলোতে বিষ মিশিয়ে দিচ্ছে। এমন তথ্যের ভিত্তিতে জাপানের সশস্ত্র সৈনিকসহ কিছু অস্ত্রধারী মানুষ কোরীয় বংশোদ্ভূত কয়েক হাজার লোকজনকে হত্যায় প্ররোচিত করেছিল। তখন সত্যিই কী ঘটেছিল তা এখনও রহস্য।
নিউ কারেন্টস বিভাগে এবার বিচারকদের প্রধান ছিলেন দক্ষিণ কোরিয়ান চলচ্চিত্র সমালোচক জুং সাং-ইল। তার নেতৃত্বে বিচারক প্যানেলে কাজ করেছেন দক্ষিণ কোরিয়ান পরিচালক হান জুন-হি, ফরাসি সাংবাদিক ও কান চলচ্চিত্র উৎসবের সমান্তরাল বিভাগ ক্রিটিকস’ উইকের আর্টিস্টিক পরিচালক আভা কায়েন, ইন্দোনেশিয়ান পরিচালক এডউইন এবং আমেরিকান প্রযোজক ক্রিস্টিনা ও। ‘বলী’ প্রসঙ্গে তাদের মন্তব্য, ‘এটি আকর্ষণীয় একটি সিঙ্গেল রাউন্ড ম্যাচের মতো, এতে দারুণভাবে গল্প বলা হয়েছে।’
বুসান সিনেমা সেন্টারের সুবিশাল বিআইএফএফ আউটডোর থিয়েটারে লালগালিচায় বাংলাদেশের প্রতিনিধি হয়ে প্রথমে হেঁটেছেন নিউ কারেন্টস বিভাগে নির্বাচিত ‘আগন্তুক’ ছবির পরিচালক বিপ্লব সরকার, অভিনেত্রী সাহানা রহমান সুমি, শিশুশিল্পী সালমান রহমান রাফসান ও প্রযোজক তাজুল হক। এরপর লালগালিচা সম্মান পেয়েছেন ইকবাল হোসাইন চৌধুরী, ‘বলী’র (দ্য রেসলার) অভিনেতা নাসির উদ্দিন খান, সহ-প্রযোজক সাইফুল আজিম। সবশেষে জিসোক বিভাগে নির্বাচিত ‘সামথিং লাইক অ্যান অটোবায়োগ্রাফি’র পরিচালক ও অভিনেতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, অভিনেত্রী-চিত্রনাট্যকার নুসরাত ইমরোজ তিশা ও প্রযোজক রেদওয়ান রনি লালগালিচায় পা মাড়িয়েছেন। প্রতিবারই প্রতিধ্বনিত হয়েছে বাংলাদেশের নাম।
নিউ কারেন্টস বিভাগে নির্বাচিত বাংলাদেশের দুটি ছবিই সরকারি অনুদান পেয়েছে। এগুলোর সঙ্গে ‘সামথিং লাইক অ্যান অটোবায়োগ্রাফি’ও বুসানে প্রশংসিত হয়েছে। বিষয়বস্তু, নির্মাণশৈলী ও দারুণ অভিনয়ের সম্মিলনে বিভিন্ন ভাষাভাষির দর্শকদের মন জয় করেছে বাংলা ভাষার ছবি তিনটি। এশিয়ান প্রজেক্ট মার্কেটে নির্বাচিত হয়েছে ভাষা, যোগাযোগ ও অভিবাসন বিষয়ে রবিউল আলম রবির ‘সুরাইয়া’ ছবির চিত্রনাট্য। কিম জিসোক বিভাগে পুরস্কার জিতেছে শ্রীলঙ্কার প্রসন্ন বীতানাগে পরিচালিত ‘প্যারাডাইস’ এবং কিরগিজস্তানের মিরলান আবদিকালিকভের ‘ব্রাইড কিডন্যাপিং’।
সমাপনী অনুষ্ঠান স ালনা করেন দক্ষিণ কোরিয়ান অভিনয়শিল্পী কো মিন-সি ও হং কায়ুং। সবশেষে রাত ৮টায় দেখানো হয় উৎসবের সমাপনী ছবি চীনের নিং হাও পরিচালিত ‘দ্য মুভি এম্পারার’। গত ৪ অক্টোবর শুরু হয় ১০ দিনের বুসান চলচ্চিত্র উৎসব। এবারের অফিসিয়াল সিলেকশনে স্থান পেয়েছে ৬৯টি দেশের ২০৯টি চলচ্চিত্র। উৎসবের বিভাগগুলো হলো– গালা প্রেজেন্টেশন, আইকনস, জিসোক, অ্যা উইন্ডো অন এশিয়ান সিনেমা, নিউ কারেন্টস, কোরিয়ান সিনেমা টুডে, ওয়ার্ল্ড সিনেমা, ফ্ল্যাশ ফরওয়ার্ড, ওয়াইড অ্যাঙ্গেল, ওপেন সিনেমা, মিডনাইট প্যাশন, অন স্ক্রিন, স্পেশাল প্রোগ্রাম ইন ফোকাস এবং স্পেশাল স্ক্রিনিং। ইন্দোনেশিয়ার ৭টি পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্র, ৫টি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ও ১টি ওয়েব সিরিজ নিয়ে এবার রাখা হয় বিশেষ বিভাগ ‘রেনেসাঁ অব ইন্দোনেশিয়ান সিনেমা’। অফিসিয়াল সিলেকশনের সঙ্গে দেখানো হয়েছে কমিউনিটি বিআইএফএফ-এর ৬০টি ছবি।
নিউ কারেন্টস বিভাগে দুটি সিনেমাকে পুরস্কার দেওয়া হয়। ‘বলী (দ্য রেসলার)’ ছাড়া এ বিভাগে পুরস্কার জিতেছে জাপানের ‘মোরি তাতসুয়া’। দুই সিনেমাই পুরস্কার হিসেবে ৩০ হাজার ডলার পেয়েছে। ‘বলী (দ্য রেসলার)’ সাগরপাড়ের গল্প। সাগরের মতোই সিনেমার মূলত: দুই রূপ। একটি খুবই শান্ত, রহস্যময়। আরেকটি খুবই নিষ্ঠুর, বিধ্বংসী রূপ।
২০২০-২১ অর্থ বছরে বাংলাদেশ সরকারের অনুদানের সিনেমা ‘বলী (দ্য রেসলার)’। সিনেমার প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন নাসির উদ্দিন খান। সাগরপাড়ের এক খ্যাপাটে জেলের চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। সিনেমাটির শুটিং হয়েছে চট্টগ্রামের উপকূলীয় এলাকায়। চলতি বছরের শেষের দিকে সিনেমাটি প্রেক্ষাগৃহে আসতে পারে।