(শংকর এক জন জনপ্রিয় লেখক । তাঁর আসল নাম মণিশংকর মুখোপাধ্যায় বিখ্যাত পরিচালক সত্যজিৎ রায়তাঁর ‘সীমাবদ্ধ’ এবং ‘জনঅরণ্য’ কাহিনী অবলম্বনে ছবি বানিয়েছেন। তাঁর ‘চৌরঙ্গী’ উপন্যাসটিও সিনেমা হয়েছে। মুখ্য ভূমিকায় অভিনয়করেছেন উত্তম কুমার। সেই প্রসঙ্গে শংকর বললেন, ‘সত্যজিৎই আমাকে সকলের কাছে পৌঁছে দিয়েছে, ছড়িয়ে দিয়েছে।’
১৯৩৩ সালের ৭ ডিসেম্বর যশোরের বনগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। আইনজীবী বাবা হরিপদ মুখোপাধ্যায়দ্বিতীয়বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আগেই চলে যান কলকাতার ওপারে হাওড়ায়। সেখানেই শংকরের বেড়ে ওঠা, পড?াশোনা ও সাহিত্য সাধনার শুরু। জীবনের শুরুতে কখনও ফেরিওয়ালা, টাইপরাইটার ক্লিনার, কখনও প্রাইভেট টিউশনি, কখনও শিক্ষকতা অথবা জুট ব্রোকারের কনিষ্ঠ কেরানিগিরি করেছেন। এক ইংরেজের অনুপ্রেরণায়শুরু করেন লেখালেখি। ‘বোধোদয়’ উপন্যাস প্রকাশের পর শংকরকে উৎসাহবাণী পাঠান শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, বলেছিলেন ‘ব্রাইট বোল্ড বেপরোয়া’। ভাবনা বা প্রকাশভঙ্গিতে তাঁর এই উপন্যাস নিজের অন্য লেখালেখি থেকে অন্য রকম হওয়ায় তিনি তা পড়তে দিয়েছিলেন মুম্বইনিবাসী শরদিন্দুকে। শরদিন্দু সেই লেখা পড়ে বলেছিলেন, ‘তোমার এই লেখায়জননী জন্মভূমিকেই আমি সারাক্ষণ উপলব্ধি করলাম।’ পাঠকমহলের ‘নিন্দা ও প্রশংসার ডালি নিয়ে আমি নিজেও এক সময়‘বোধোদয়’কে ভালবাসতে শুরু করেছি’, বলেন মণিশংকর মুখোপাধ্যায়। সম্প্রতি আশি পেরিয়েছেন শংকর। এখনও সমান তালে লিখে চলেছেন। ইদানীং তাঁর আগ্রহের বিষয়বস্তু স্বামী বিবেকানন্দের জীবনী। স্বামীজির জীবনের অনেক না জানা তথ্য প্রকাশিত হয়েছে শংকরের লেখায় আমি বিবেকানন্দ বলছি, অচেনা অজানা বিবেকানন্দ, অবিশ্বাস্য বিবেকানন্দ। শংকরের লেখা বই আজও বেস্ট সেলার।)
ইন্টারনেটের সৌজন্যে খবরপত্রের পাঠকদের জন্য পত্রস্থ করা হলো।- বি.স
(পূর্ব প্রকাশের পর)
শাজাহানের ম্যানেজার সিলভারটনের সঙ্গে আমার খুব আলাপ ছিল। সিলভারটন শেষ পর্যন্ত হোটেলটা কিনেও নিয়েছিলেন। আর্মেনিয়াম খ্রিস্টান গ্রেগরি আপকার একবার শাজাহান হোটেলে এসে উঠেছিলেন। হোটেলের তখন দুর্দিন চলেছে। মালিক কোনো কাজে নজর দেন না, বাড়িটা ভেঙে পড়েছে, জিনিসপত্তরের অভাব। গ্রেগরি আপকার চাকর-বাকরদের সঙ্গে ঝগড়া করেছিলেন। ম্যানেজারকে শাজাহানের চিঠির কাগজেই লিখে পাঠিয়েছিলেন দুনিয়াতে এর থেকেও ওঁচা কোনো হোটেলের নাম যদি কেউ বলতে পারে, তবে তাকে পাঁচশ টাকা পুরস্কার দেব।
সিলভারটন সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এসেছিলেন। আমরা অত্যন্ত দুঃখিত। কিন্তু টাকাকড়ির অভাব। টাকা থাকলে ভালো হোটেল কাকে বলে দেখিয়ে দিতাম।
ইতিহাসে সেই প্রথম বোধহয় কোনো হোটেলের গেস্ট হোটেলের উপর রেগে গিয়ে হোটেলটাই কিনে ফেলেছিলেন। গ্রেগরি আপকারের পয়সার অভাব ছিল না। চেক কেটে পুরো দাম দিয়ে মালিকানা কিনেছিলেনÍ সিলভারটনকে করেছিলেন ওয়ার্কিং পার্টনার।
সিলভারটনকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, বিজ্ঞাপনের ফল কী হল?
সঙ্গে সঙ্গে ফল। অনেকেই ২২ সেপ্টেম্বরের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। খোঁজ করছে, ওইদিন সন্ধেতেই ওঁরা বার-এ কাজ করতে আরম্ভ করবেন তো? রসিকজনরা একটুও দেরি সহ্য করতে পারছেন না।
বাইশে সেপ্টেম্বর রাত্রে সিলভারটন আমাকে নেমন্তন্ন করেছিলেন। হোটেলের লোকরা সহজে কাউকে নেমন্তন্ন করে না। কিন্তু সিলভারটনের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা অন্যরকম ছিল-মাঝে মাঝে নেমন্তন্ন করে খাওয়াতেন। সে-রাত্রে শাজাহান হোটেলের বার এবং ডাইনিং রুমে তিলধারণের জায়গা ছিল না। ইয়ংমেন উইথ বেস্ট অফ ম্যানারস্ অ্যান্ড ওয়ার্ল্ড অফ ইনটেনসন সেখানে হাজির হয়েছিল। কিন্তু নতুন বালিকারা রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত হলেন না।
কী ব্যাপার, জাহাজ কি এসে পৌছয়নি? অনেক ছোকরা প্রশ্ন করতে আরম্ভ করল।
জাহাজ এসেছে। তারাও এসেছেন। কিন্তু আজ তারা অত্যন্ত ক্লান্ত সিলভারটন হাতজোড় করে ঘোষণা করলেন।
আমরাও কিছু তাজা গোলাপফুলের অবস্থায় নেই। সারাদিন কাজ করে, পচা বৃষ্টিকে কলা দেখিয়ে ভিজতে ভিজতে এখানে হাজির হয়েছি। ছ্কোরাদের একজন ফোড়ন দিয়েছিল।
সিলভারটন বিনয়ে গলে গিয়ে বলেছিলেন, শাজাহান হোটেলের পরম সৌভাগ্য, এত অসুবিধার মধ্যেও তাকে আপনারা ভোলেননি। আপনাদের দেহের এবং মনের অবস্থার কথা ভেবেই মিস ডিকশন সেলার থেকে কয়েকটি সেরা বোতল বার করে এনেছেন।
ছোকরারা খিলখিল করে হেসে ফেললে। উই ডিমান্ড ওল্ড ওয়াইন ফ্রম নিউ হ্যান্ড। নতুন কচি কচি হাত থেকে পুরনো মদ চাই আমরা।
একটু দূরে মুখ শুকনো করে প্রৌঢ়া মিস ডিকশন দাঁড়িয়ে আছেন। পিছনে অনেকগুলো মদের বোতল সাজানো রয়েছে। পাশে পিতলের ছোট্ট বালতি হাতে পাথরের মতো একজন জোয়ান খিদমতগার দাঁড়িয়ে রয়েছে। গেলাসে বরফের গুঁড়ো দেওয়াই তার কাজ মনে হতে পারে। কিন্তু ওটা ছুতো, আসলে সে বডিগার্ড।
কেউ আজ মিস ডিকশনের কাছে ড্রিংকস কিনছে নাÍআজ যেন ওই দড়ির মতো পাকানো শীর্ণ দেহটাকে এখানে কেউ প্রত্যাশা করেনি। ছোকরারা বললে, আমরা কি একটু অপেক্ষা করব? নতুন মহিলারা কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে আসতে পারেন।
সিলভারটন আপত্তি জানালেন, আমি অত্যন্ত দুঃখিত, ওঁরা এতই ক্লান্ত যে এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছেন।
সিলভারটনের পা-দুটো উত্তেজনায় কাঁপছিল। ছোকরারা চিৎকার করে বললে, প্রয়োজন হয় আমরা গিয়ে ওঁদের অনুরোধ করতে পারি; আর তাতে যদি অসুবিধা থাকে তবে আমরা চললাম। অ্যাডেলফি বার-এর লোলা আমাদের জন্যে বসে আছে। আমাদের দেখলেই লোলা ফিক করে হেসে উঠবে, আর মনে হবে যেন মেঝেতে মুক্তো ঝরে পড়ছে।
ওরা দল বেঁধে শাজাহান থেকে বেরিয়ে পড়ল। সিলভারটন মুখ শুকনো করে দাঁড়িয়ে রইলেন। মিস ডিকশনও সেই যে কাউন্টারের কাঠের দিকে তাকিয়ে রইলেন, আর মুখ তুললেন না।
সিলভারটনকে জিজ্ঞাসা করলাম, কী ব্যাপার?
সিলভারটন আমাকে তার ঘরে নিয়ে গেলেন। বললেন, নিজের ঘরে বসে বসে আমরা আলাদা ডিনার করব। বেশ মুশকিলে পড়ে গিয়েছি।
ওঁর ঘরে গিয়ে ব্যাপারটা শুনলাম। বিপদই বটে! মেরিয়ন বুথ নামে যে মহিলাটি জাহাজ থেকে নেমেছেন, তাঁর বয়স পঁয়তাল্লিশের কম নয়। জাহাজঘাটেই সিলভারটন ব্যাপারটা বুঝেছিলেন। কিন্তু তখন কিছু বলতে পারেননি। জেন গ্রেন অবশ্য ফাঁকি দেয়নি। সিলভারটন মাথায় হাত দিয়ে বসেছেন। এত পয়সা খরচ করে সিলভারটন একটা বুড়ি এনেছেন, এ-খবর একবার বেরিয়ে পড়লে শাজাহানের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যাবে।
ব্যাপারটা পরে প্রকাশিত হয়েছিল। শাজাহান হোটেল ঠকে গিয়েছে। যে-মেয়েকে শাজাহান হোটেলের এজেন্ট পছন্দ করেছিলেন, কথাবার্তা বলেছিলেন, এমনকি জাহাজে তুলে দিয়েছিলেন সে কোনো এক সময় জাহাজের খোলে বুড়িকে রেখে, নিজে নেমে গিয়েছে। কলকাতায় এসে কনেবদল যখন ধরা পড়ল, তখন আর কিছুই করবার নেই।
রাগে কাঁপতে কাঁপতে সিলভারটন জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আপনারই নাম মেরিয়ন বুথ? আপনি সত্যি কথা বলছেন?
ভদ্রমহিলা কাংস্যবিনিন্দিত কণ্ঠে প্রতিবাদ করেছিলেন। হোয়াট? তুমি আমার ফাদারের দেওয়া নামে সন্দেহ করছ?
এবং আপনার বয়স পঁচিশ! দাঁতে দাঁত চেপে সিলভারটন বলেছিলেন।
মোর অর লেসÍভদ্রমহিলা উত্তর দিয়েছিলেন।
নিশ্চয়ই লেসÍসিলভারটন নিজের মাথা চাপড়াতে চাপড়াতে বললেন। আমার যে কি ক্ষতি আপনি করলেন! আপনাকে ফেরত পাঠিয়ে যে অন্য কাউকে আনব সে-টাকাও আমার নেই। টাকা যদিও জোগাড় হয়, সময় নেই। মিস ডিকশনকে নোটিশ দিয়ে দিয়েছি। একা মিস গ্রের পক্ষে এত বড় বার চালানো অসম্ভব।
আমি বলেছিলাম, এসে যখন পড়েছে, তখন কী করবেন? লন্ডনে কি বয়স্কা মহিলারা বার-এ কাজ করেন না?
প্রত্যুত্তরে সিলভারটন যা বলেছিলেন তা আজও আমার বেশ মনে আছে। দীর্ঘদিন ধরে বহুবার ব্যবহার করেও কথাটা পুরনো হয়নি। এই শহর সম্বন্ধে ওইটাই বোধহয় শেষ কথাÍক্যালকাটা ইজ ক্যালকাটা।
সিলভারটন বলেছিলেন, লন্ডনে চলতে পারেএখানে চলবে না। দুটো বুড়ি এইভাবে চৌরঙ্গীর দুটো হোটেলকে ঠকিয়েছে। ওদের টাকা ছিল অনেক, ফিরতি জাহাজের ভাড়া দিয়ে দিলে, কন্ট্রাক্ট অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ দিলে বুড়িরা অবশ্য ফিরে যায়নি, তারা খিদিরপুরে গিয়ে জাহাজি পাড়ায় নিজেদের দোকান করে বসল।
বুড়ি মিস বুথ আনুনয় বিনয় করেছিলেন। বলেছিলেন, আমাকে একবার সুযোগ দাওআমি বলছি তোমার বিক্রি কমবে না।
সিলভারটন রাজি হননি। জোচ্চুরিটা ধরবার জন্যে, চাবি খুলে মিস গ্রেকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। পথের শ্রমে ক্লান্ত হয়ে বেচারা মিস গ্রে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। চোখ মুছতে মুছতে লাজনা জেন আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে প্রথমে একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। তার মুখে যে ট্র্যাজেডির ইঙ্গিত ছড়ানো রয়েছে, সেদিনই যেন বুঝেছিলাম।
সিলভারটন জিজ্ঞাসা করেছিলেন, মিস বুথ কিভাবে সকলকে ফাঁকি দিয়ে কলকাতায় এসে হাজির হলেন, জানেন?
মিস গ্রে কোনো উত্তর দেননি। মাথা নিচু করে বলেছিলেন, আমি তখন নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম। দেশ ছেড়ে আসছি, কোনোদিন আর ফিরতে পারবো কি না জানি না।
এই লাজুক ও নম্র স্বভাবের অষ্টাদশী শাজাহান হোটেলের বার-এ কী করে যে কাজ করবে বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার আগে জেন বললেন, মিস বুথের মতো দয়ালু স্বভাবের মহিলা আমি দেখিনি। জাহাজে সমস্ত পথ আমাকে যতœ করে এসেছেন।
সেই রাত্রে শাজাহান থেকে ফিরে এসেছিলাম। কয়েকদিন পরে শুনেছিলাম মিস বুথ লিপস্টিক এবং রুজমাখা কিডারপুর গার্লদের দলে যোগ দিয়েছিলেন। আর যুবতী মিস গ্রের লাজনম্র হাত থেকে হুইস্কি গ্রহণ করবার জন্যে শাজাহান হোটেলে অনেক মেড-ইন-ইংল্যান্ড ভদ্রলোক এবং মেড-ইন-ইন্ডিয়া বেঙ্গলিবাবু ভিড় করছেন। এই বেঙ্গলি বাবুদের নিয়েই ডেভি কারসন গান বেঁধেছিলেন I very good Bengali Babu
In Calcutta I long time eÕstop,
জেন সম্বন্ধে আমি যে ভুল করিনি, তা আবার একজনের কথা শুনে বুঝলামআমার বন্ধু রবি। রবি অ্যাডাম। শাজাহান-এ সাপার করতে গিয়ে জেনকে সে প্রথম দেখেছিল। কলকাতার বার-এ তার নিজের দেশের এক মেয়ের দুর্দশা সে নিজের চোখে দেখেছিল। না দেখলেই হয়তো ভালো করত। অনেক কষ্টের হাত থেকে বেঁচে যেতবিধাতার এমন কঠিন পরীক্ষায় বেচারাকে বসতে হত না।
রবি বলেছিল, শাজাহানের নতুন মেয়েটিকে দেখেছ? চোখঝলসানো সুন্দরী হয়ত নয়Íকিন্তু প্লিজিং। বেচারার কি ইংলন্ডে চাকরি জুটল না? না জেনেশুনে কেউ এখানে আসে? গত রাত্রে ক্লাইভ স্ট্রিটের এক বড়া সাব ওর হাত চেপে ধরেছিল। অনেক কষ্টে খিদমতগার হাত ছাড়িয়ে দেয়। আর একজন আব্দার ধরেছিল, আমাকে কম্পানি দাও। কাউন্টার থেকে বেরিয়ে আমার টেবিলে এসে বসো, একটু ড্রিঙ্ক করো। আমি বাধা না দিলে ভদ্রলোক জোর করেই ওকে কাউন্টার থেকে বের করে নিয়ে আসতেন। তখন একটা কেলেঙ্কারি হত। বার-এর অন্য খদ্দেররা রেগে উঠত, সবাই বলত, আমার পাশে এসে বসো, আমিও লোনলি ফীল করছি।
আমাদের রবি, অর্থাৎ রবার্ট জে অ্যাডাম, তখনও পুরো ক্যালকাটাওয়ালা হয়ে ওঠেনি। বছর খানেক ক্লাইভ স্ট্রিটের এক বাঘা আপিসে কাজ করছিল। এখানকার ভাষা, সভ্যতা, চলচলন কোনো কিছুতেই সে তখনও অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি।
এমন যে হবে তা আমি জানতাম না। কোনো অদৃশ্য আকর্ষণে রবি প্রতিদিন শাজাহান হোটেলে যেতে আরম্ভ করেছে। দিনের আলোয় ওদের দেখা হওয়া সম্ভব ছিল না। জেনকে ঘরে তালাবদ্ধ করে, সিলভারটন ঘুমোতে যেতেন। জেনও সেই সময় অঘোরে ঘুমিয়ে থাকত। সন্ধ্যার পর থেকে তার যে ডিউটি আরম্ভ। আর তখনকার বার তো আর এখনকার মতো দশটা কি এগারোটা বাজলেই বন্ধ হয়ে যেত না। সকাল পাঁচটা পর্যন্ত খোলা থাকত।
মদ্যপদের অট্টহাসি, হৈ হৈ হট্টগোল, গেলাস ভাঙার শব্দের মধ্যেও দুটি মন নীরবে কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছিল।
হবস একটু হাসলেন। বললেন, আমি ব্যবসাদার লোক, কাব্যিক ন্যাকামো আমার আসে না। তবুও আই মাস্ট সে, ওদের দুজনের পরিচয়ের মধ্যে কাব্যের সৌরভ ছিল। শুনেছি ওরা কোডে কথা বলত। হুইস্কির গ্লাস এগিয়ে দিতে দিতে জেন কড়া কড়া ভাষা ব্যবহার করত। মিষ্টি কথা বলা মিষ্টি হাসবার কোনো উপায় ছিল না, অন্য খদ্দেররা তাহলে হৈ হৈ বাধিয়ে দেবে।
খিদমতগারই বোধহয় সব জানত। কোনো গোপন কথা থাকলে সে-ই রবিকে চুপি চুপি বলে যেত। খিদমতগার বেচারার এক মুহূর্তের শান্তি ছিল না। কাউন্টারে দাঁড়িয়ে বারমেডকে কিছু বলতে অতিথিরা তবুও সঙ্কোচ বোধ করেন, কিন্তু খিদমতগারের মাধ্যমে কোনো প্রস্তাব পেশ করতে লজ্জা নেই। শাজাহান হোটেলের মদ্যরসিকরা খিদমতগারকে একটা টাকা এবং একখানা চিঠি মেমসায়েবকে পৌঁছে দেবার জন্যে দিতেন।
জেন-এর কাছে পরে শুনেছি, একরাত্রে সে তিরিশখানা চিঠি পেয়েছিল। তার মধ্যে দশজন তাকে বিয়ে করবার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। জেন বলেছিল, মাই পুওর খিদমতগার, সে যদি তিরিশ টাকা রোজ আয় করতে পারে, আই ডোন্ট মাইন্ড।
হবস একবার টোক গিললেন। সুদূরের স্মৃতিকে কাছে টেনে আনার চেষ্টা করতে করতে বললেন, আমি কিন্তু রবিকে সাবধান করে দিয়েছিলাম। বলেছিলাম, ডোন্ট ফরগেট, ক্যালকাটা ইজ ক্যালকাটা।
সাদারল্যান্ডও যেন মিস্টার হবসের কথায় চমকে উঠলেন। আস্তে আস্তে বললেন, ঠিক। কলকাতা কলকাতাই।
জেন ও রবি যখন বিয়ে করবার মতলব ভঁজছে তখনও রবিকে বলেছিলাম, মনে রেখো ক্যালকাটা ইজ ক্যালকাটা। হোটেলে যাও, ড্রিঙ্ক করো, ফুর্তি করো, কেউ কিছু বলবে না। কিন্তু তাই বলে বারমেডকে বিয়ে করে বোসো না।
মিস্টার হবস এবার একটু থামলেন।
তার কথা শুনে আমি আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম। বিয়ে করে একঘরে হবার সম্ভাবনা ইংরেজ সমাজেও তাহলে আছে? এতদিন ধরে সমস্ত গালাগালিটা শুধু শুধু আমরাই হজম করে এসেছি।
মিস্টার হবস আবার বলতে আরম্ভ করলেন। আমার মধ্যে তবু সামান্য চঞ্চলতা ছিল, কিন্তু সাদারল্যান্ড পাথরের মতো নিশ্চল হয়ে তার কথা শুনতে লাগলেন।
মিস্টার হবস বললেন, আমাদের কোনো আপত্তিই রবি শোনেনি। সে বলেছে, আমি কথা দিয়েছি। শাজাহান হোটেলের নরককু- থেকে জেনকে আমার উদ্ধার করতেই হবে।
জেনও আপত্তি করেনি। শাজাহান হোটেল থেকে বেরিয়ে আসবার জন্যে সে ছটফট করতে আরম্ভ করেছে। বার-এর কাউন্টারে দাঁড়িয়ে সে যে আপনজনকে খুঁজে পেয়েছে, তা হয়তো গল্পের মতো শোনায়; কিন্তু সত্যি তা সম্ভব হয়েছে। ক্যালেন্ডারের পাতার দিকে তাকিয়ে থেকেছে জেন।
সিলভারটন গুজব শুনে মাথায় হাত দিয়ে বসেছেন। জেনকে আড়ালে ডেকে জিজ্ঞাসা করেছেন, যে-সব গুজব শুনছি, আই হোপ, সেগুলো মিথ্যে। তোমার কাজে আমরা সন্তুষ্ট হয়েছি। তোমার পপুলারিটি কলকাতার সমস্ত বারমেডদের হিংসের কারণ। পরের কনট্রাক্টে তোমার মাইনে বাড়িয়ে দেব।
জেন বলছে, বিবাহিত মেয়েদের চাকরিতে রাখতে আপনার কোনো অসুবিধে আছে?
বিবাহিত মেয়ে! জেন, তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে? ম্যারেড গার্ল দিয়ে কখনও বারমেড-এর কাজ চলে?
কেন? আপত্তি কী? জেন প্রশ্ন করেছে।
আপত্তি আমার নয়! শাজাহান হোটেলের পেট্রনদের। তারা অপমানিত বোধ করবেন। হয়তো শাজাহান বারকে বয়কট করে বসবেন। সিলভারটন বলেছেন।
জেন সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিয়েছে, আমি তা হলে কন্ট্রাক্ট সই করব না। আমাকে চাকরি ছাড়তে হবে।
সিলভারটন তখন লোভ দেখিয়েছেন। জেনকে সব ভেবে দেখতে বলেছেন। এমনকি বিক্রির উপর একটা কমিশন দিতেও রাজি হয়েছেন। জেন তবুও রাজি হয়নি। বড়লোক হবার জন্যে সে কলকাতায় আসেনি। অভাবে বিরক্ত হয়ে, বাঁচবার জন্যে, ভুল করে চলে এসেছিল বিলেত থেকে। এখন নিজের চোখে সব দেখছে।
সিলভারটন বলেছেন, তোমার প্রাইভেট লাইফে আমি কোনোরকম বাধা দেব না। দুপুরবেলা তালা দিয়ে রাখার ব্যাপারটা প্রচারের জন্য করেছিলাম। তুমি যদি চাও সে তালার চাবিও তোমাকে দিয়ে দেব। তোমার যা খুশি তাই করো।
জেন বলেছে, চাবির মধ্যে থাকবার আর প্রয়োজনই নেই। নতুন যে বারমেড আসবে, তাকে বরং ওই সুযোগটা দেবেন।
(সংকলিত)
——চলবে