শনিবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৫, ১১:২০ পূর্বাহ্ন

চরম অর্থকষ্টে শহীদ সাইদুরের পরিবার

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় রবিবার, ১৩ এপ্রিল, ২০২৫

চব্বিশের স্বৈরাচারবিরোধীু ‘জুলাই অভ্যুত্থান’ যখন চূড়ান্ত রূপ নিচ্ছিল, তখন ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচির প্রবল জোয়ারে উদ্বেল হয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আন্দোলনে দিয়ে শহীদ হন মো. সাইদুর রহমান ইমরান (২২)।
সকাল সাড়ে ১১টার দিকে যাত্রাবাড়ীর কাজলা ফুটওভার ব্রিজের কাছে পুলিশের ব্যারিকেড ভাঙার সময় হাজারো আন্দোলনকারীর সঙ্গে সাইদুরও এগিয়ে যান। এ সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান এই তরুণ।
তার মৃত্যু আর্থিক ধস নামিয়ে এনেছে তার পরিবারে। কারণ কোভিড-১৯-এর সময় অসুস্থতার কারণে তার বাবা চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হলে সাইদুর সংসারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন।
সাইদুরের বাবা মো. কবির হোসেন বাসস-কে বলেন, ‘আমি একটা টিন ফ্যাক্টরিতে কাজ করতাম। কিন্তু অসুস্থ হয়ে যাওয়ায় চাকরি ছাড়তে হয়। তখন আর কোনো উপায় না পেয়ে আমার ছেলেকে পড়ালেখা ছেড়ে কাজে নামাতে বাধ্য হই। তখন সে দশম শ্রেণির ছাত্র।’
যাত্রাবাড়ীর মীরহাজীরবাগে তাদের বাসায় বসে ৫৬ বছর বয়সী কবির হোসেন যখন এসব বলছিলেন, তখন তার মুখে ফুটে উঠছিল অনিশ্চিত ভবিষ্যতের হতাশা।
পেশায় একটি কার্পেট দোকানের কর্মচারী সাইদুর ছিলেন তিন ভাইয়ের মধ্যে দ্বিতীয়। বড় ভাই মো. তৌফিকুর রহমান (২৩) পটুয়াখালীর বাউফলের গ্রামের বাড়ির এক মাদরাসা থেকে আলিম পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ছোট ভাই মাহমুদুর রহমান (১২) মীরহাজীরবাগের একটি স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে।
সাইদুরের আয়ে পরিবারে স্বস্তি এসেছিল। ভরপেট খাওয়া, ভাইদের পড়াশোনা চালানো সবই সম্ভব হচ্ছিল। কিন্তু তার মৃত্যুতে শুধু এক সন্তান নয়, উপার্জনের অবলম্বন হারিয়ে ভেঙে পড়েছে পরিবারটি।
এই ক্ষতি তাদের মনে আরও গভীর হয়ে বাজে, কারণ পাঁচ বছর আগে তাদের একমাত্র মেয়েও নয় বছর বয়সে স্ট্রোক করে মারা যায়।
‘পাঁচ বছরের ব্যবধানে দুই সন্তান হারানোর এই যন্ত্রণা কীভাবে সইবো?’ভেঙে পড়া কণ্ঠে বলেন কবির। বর্তমানে তিনি ছোট পরিসরে টিন বিক্রি করেন, কিন্তু এতে সংসার চলে না।
‘আমরা আত্মমর্যাদাশীল পরিবার। ছেলের মৃত্যুর পর এমন অর্থকষ্টে পড়েছি যে, কাউকে কিছু চাইতেও পারিনি, নিজেরাও চলতে পারছি না ঠিকমতো,’ বলেন কবির।
তবে শহীদ সাইদুর স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে পাঁচ লাখ টাকা ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী থেকে দুই লাখ টাকা সহায়তা পাওয়ায় কিছুটা সাময়িক স্বস্তি মিলেছে।
এই টাকায় এখন পর্যন্ত সংসার চালাচ্ছি। কিন্তু কতদিন চলবে, জানি না,’ বলতে বলতে অনিশ্চয়তায় ভরে ওঠে কবিরের মুখ।
সাইদুর কেন আন্দোলনে যোগ দেন জানাতে গিয়ে তার বাবা বলেন, ১৬ জুলাই বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদের নির্মম হত্যাকা- মেনে নিতে পারেননি সাইদুর। ‘সে বলেছিল, ‘ছাত্রদের জন্য কিছু একটা করতেই হবে।’
মা লাভলী বলেন, ‘ছেলেটা বলেছিল, ‘মা, দরকার হলে দেশের জন্য, ছাত্রদের জন্য শহীদ হবো।’ এই বলে বের হয়েছিল ৫ আগস্টের আগে। যেন বুঝেই গিয়েছিল, কী হতে যাচ্ছে।’
৪৫ বছর বয়সী লাভলী স্মরণ করেন, সাইদুরের দাদী তখন বলেছিলেন, ‘তুই শহীদ হলে তোর মা কেমনে বাঁচবে?’ সাইদুর উত্তর দিয়েছিল, ‘আল্লাহ আমার মাকে দেখবেন।’ এ কথায় তার চরম আত্মত্যাগের প্রস্তুতি ফুটে উঠেছিল।
সাইদুরকে নিয়ে লাভলীর স্মৃতিচারণ ছিল হৃদয়বিদারক। ‘সেদিন সকালে ও নিজ হাতে আমাকে খাইয়ে দিয়েছিল। এখন মনে হয়, সেটা ওর শেষ বিদায় ছিল। আমি বারবার যেতে না করলেও ও ১০টা ৪৫ মিনিটে বেরিয়ে গেল। বলেছিল, ‘তাড়াতাড়ি ফিরে আসব।’ ফিরেছে ঠিকই, তবে লাশ হয়ে।’ সেদিন সাইদুরের এক চাচাতো ভাই নাঈম তাকে ফোন করে ঘরে ফিরে আসতে বলেন। কারণ, ততক্ষণে দেশজুড়ে কারফিউ জারি হয়েছে, রাস্তায় অরাজক পরিস্থিতি। কিন্তু দুপুর ১২টার দিকে বড় ভাই তৌফিক যখন ফোন করছিলেন বারবার, তখন এক ব্যক্তি ফোন ধরেন এবং জানান, সাইদুরকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। ততক্ষণে সে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় প্রাণ হারিয়েছে। দুইটি গুলি লেগেছিল সাইদুরের শরীরে। একটি মাথা ভেদ করে চলে যায়, অন্যটি গলায় আটকে থাকে।
মা লাভলী বলেন, ‘আমি ভেবেছিলাম শুধু আহত হয়েছে। তৌফিক আমাকে পুরোটা বলেনি। হাসপাতালে পৌঁছে পাঁচটা লাশের মধ্যে ছেলেকে খুঁজে পাই। আমি-ই প্রথম ওকে শনাক্ত করি।’ তবে কে বা কারা সাইদুরকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল, তা নিশ্চিত করে বলতে পারেননি তার পরিবারের সদস্যরা। ‘সম্ভবত ছাত্ররাই হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল,’ বলেন সাইদুরের বাবা।
পরে কিছু ছাত্র লাশ বাড়িতে এনে দেন। প্রথম জানাজা হয় মীরহাজীরবাগে। পরে ৬ আগস্ট সকাল ৯টায় বাউফলের গ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয় তাকে। শহীদ সাইদুরের পরিবার এই হত্যার বিচার চায়। ‘আমার আদরের ছেলেকে যারা মেরেছে, তাদের বিচার চাই,’ বলেন কান্নায় ভেঙে পড়া মা লাভলী।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com