সাফল্যের কারণ তাদের শিক্ষা পদ্ধতি
১৫ বছর বয়সেই গণিত ও বিজ্ঞানে দক্ষতা অর্জন
এশিয়ার ছোট দেশ সিঙ্গাপুরের স্কুলশিক্ষার্থীরা, সবশেষ আন্তর্জাতিক মূল্যায়ন পরীক্ষায় বিশ্বে সেরা ফলাফল অর্জন করেছে। সারা বিশ্বের শিক্ষার্থীদের ফলাফল মূল্যায়নের এই আন্তর্জাতিক কর্মসূচিকে বলা হয় ‘প্রোগ্রাম ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট অ্যাসেসমেন্ট’ সংক্ষেপে পিসা। প্রতি তিন বছর অন্তর অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থা-ওইসিডি এই পরীক্ষা পরিচালনা করে। এই পরীক্ষার উদ্দেশ্য হলো গণিত, বিজ্ঞান ও পঠনে ১৫ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের দক্ষতা ও জ্ঞান পরিমাপ করা। এর মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট দেশের শিক্ষাগত মান নির্ধারণ করা যায়।
দেখা গেছে, সবশেষ ২০২২ সালে সিঙ্গাপুরের স্কুলশিক্ষার্থীরা গণিত, বিজ্ঞান, পিসা পরীক্ষাসহ প্রতিটি দক্ষতায় সর্বোচ্চ স্কোর করেছে এশিয়ার দেশটি ঐতিহাসিকভাবে স্কুলশিক্ষায় নিজেদের বেশ সফল বলে প্রমাণ করে আসছে, বিশেষ করে গণিতে। গত সপ্তাহে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, এ বিষয়ে প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানের মধ্যে ব্যবধান ছিল ৩৯ পয়েন্ট।
শিক্ষার্থীদের গণিতের দক্ষতা বিকাশে সিঙ্গাপুরের সাফল্যের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। আর এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে দেশটির অনন্য শিক্ষণ কৌশল ও পদ্ধতি।
‘সিঙ্গাপুর পদ্ধতি’ কী এবং কেন এত সফল? ২০২২ সালের পিসা পরীক্ষার তিনটি প্রধান বিষয়ের মধ্যে একটি হলো ‘গণিত’। সিঙ্গাপুরের ১৫ বছর বয়সী শিক্ষার্থীরা গণিতে ৫৭৫ পয়েন্ট অর্জন করে শীর্ষস্থান লাভ করেছে।
ওই পরীক্ষায় মোট ৮১টি দেশ অংশগ্রহণ করেছিল। যাদের সবার গড় স্কোর ছিল ৪৭২ পয়েন্ট। সে হিসাবে সিঙ্গাপুরের শিক্ষার্থীরা অনেকটাই এগিয়ে আছে। গতবারের চাইতে এবার তারা ছয় পয়েন্ট বেশি অর্জন করেছে।
অন্যদিকে ৫৫২ পয়েন্ট নিয়ে ম্যাকাও আছে দ্বিতীয় অবস্থানে। এরপর তাইপেই, হংকং, জাপান, কোরিয়া, এস্তোনিয়া, সুইজারল্যান্ড, কানাডা, নেদারল্যান্ডস পরের অবস্থানে রয়েছে। সিঙ্গাপুর কর্তৃপক্ষ বিশ্বাস করে যে গণিত শিক্ষা মানুষকে যৌক্তিক ও বিশ্লেষণধর্মী চিন্তা করতে শেখাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
তাই অল্প বয়স থেকেই, সিঙ্গাপুরের শিশুরা জটিল গাণিতিক প্রক্রিয়াগুলো শিখতে শুরু করে, যেমন- যুক্তি দাঁড় করানো, যোগাযোগ স্থাপন এবং গাণিতিক মডেল তৈরি করা। এই পদ্ধতিতে তারা তাদের মেধার বিকাশ ঘটায়।
‘সিঙ্গাপুরের গণিত’ হলো দেশটির অনন্য ও ব্যাপকভাবে স্বীকৃত শিক্ষণ পদ্ধতি। গণিত শিক্ষার ক্ষেত্রে দেশটির এই শিখন পদ্ধতি ‘সিঙ্গাপুর পদ্ধতি’ (বা মাস্টারি অ্যাপ্রোচ) নামে পরিচিত।
১৯৮০’র দশকে সিঙ্গাপুরের শিক্ষা মন্ত্রণালয় এই কৌশলটি তৈরি করে এবং দেশটির সরকারি স্কুলগুলোয় শিক্ষাদানে তা প্রয়োগ করে। মূলত প্রচলিত মুখস্থ বিদ্যা থেকে শিক্ষার্থীদের সরিয়ে আনতে গণিত শেখানোর নতুন এই পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়। যেন শিক্ষার্থীরা যা শিখছে সেটা যেন তারা আরো গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারে।
সাম্প্রতিক দশকগুলোয় সিঙ্গাপুরের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপদ্ধতি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ গ্রহণ করে তা ব্যবহার করতে শুরু করেছে।
এই পদ্ধতি কিভাবে কাজ করে: সিঙ্গাপুর গণিত শিক্ষা মূলত দুটি অন্তর্নিহিত মৌলিক ধারণার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। একটি হলো, সিপিএ পদ্ধতি এবং আরেকটি নোশন অব মাস্টারি। সিপিএ পদ্ধতি বলতে কনক্রিট, পিকটোরিয়াল ও অ্যাবস্ট্র্যাক্ট বোঝানো হয়েছে। বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায় বাস্তবসম্মত, সচিত্র ও সাংকেতিক পদ্ধতি। অন্যদিকে নোশন অব মাস্টারি যা শেখানো হচ্ছে সেটা আয়ত্ত করার বিশেষ প্রক্রিয়া। তবে গণিত শিক্ষার ক্ষেত্রে সিপিএ পদ্ধতি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সিঙ্গাপুর প্রথম দেশ নয়। ১৯৬০-এর দশকে আমেরিকান মনোবিজ্ঞানী জেরোম ব্রুনার এই পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছিলেন। সাধারণত অনেক শিশু এমনকি প্রাপ্তবয়স্করাও গণিতকে কঠিন বলে মনে করে। যেহেতু এটি একটি বিমূর্ত বা সাংকেতিক বিষয়। এই ভয়ের ওপর ভিত্তি করে সিপিই পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়। যেন গণিত নিয়ে ভয় কাটে। সিপিএ পদ্ধতিতে সাংকেতিক গাণিতিক ধারণাকে একটি বাস্তব আকারে উপস্থাপন করা হয়। যখন শিক্ষার্থীরা ওই ধারণাটি পরিষ্কার বুঝতে পারে তখন তারা অন্যান্য আরো জটিল বিষয়গুলো পড়তে থাকে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. এরিয়েল লিন্ডফ বিবিসিকে বলেছেন, ‘সিঙ্গাপুরের গণিত ক্লাসে, শিশুরা সবসময়ই কিছু না কিছু শারীরিক কসরত করে থাকে। তারা বাচ্চাদের ছোট ছোট কিউব বা ঘনক দিতে পারে, যেগুলো পর পর বসিয়ে সাজাতে হয়। তারা সচিত্র কোনো কাজ করতে দিতে পারে। যেমন ফুলের অনেক ছবি থাকতে পারে যেগুলো বাচ্চাদের বেছে বেছে একসাথে রাখতে হবে।’ ‘অথবা এটি একটি ব্যক্তি, ব্যাঙ বা অন্যান্য বস্তুর ছবি থাকতে পারে, যাতে শিশুরা কাছ থেকে এই বিষয়গুলো দেখে উপলব্ধি করতে পারে। কেননা এগুলো সংখ্যার চেয়ে বোঝা সহজ।’ সিপিএ এভাবে শিশুদের এই বিভিন্ন বাস্তব উপকরণ উপস্থাপনের মাধ্যমে গণিত বুঝিয়ে থাকে। শিশুরা যখন বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে এবং সচিত্র উপকরণের মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করতে শেখে এবং গণিতের সমস্যাগুলো সম্পর্কে দৃঢ় ধারণা লাভ করে তখনই তারা পাঠের পরবর্তী ধাপে চলে যায়। যেখানে সংকেত বা সংখ্যার মাধ্যমে শিশুদের অংক করানো হয়। ‘সিঙ্গাপুরের গণিত শিখন পদ্ধতি তাই মুখস্থের ওপর নির্ভর করে না,’ জোর দিয়ে বলেন ড. লিন্ডফ।
‘রিয়েল লার্নিং’: সিঙ্গাপুরে গণিত শেখার আরেকটি স্তম্ভ হলো ‘রিয়েল লার্নিং’। অর্থাৎ যে শিখন পদ্ধতির মাধ্যমে একটি ক্লাসের সকল শিক্ষার্থী একসাথে এগিয়ে যাবে। একই সময়ে সবার দক্ষতা বিকাশ লাভ করবে। যাতে শিক্ষার্থীদের কেউ পিছিয়ে না থাকে। রিয়েল লার্নিংয়ের এই ধারণা নিশ্চিত করে যে কেউ পিছিয়ে নেই। উদাহরণস্বরূপ, যখন শিশুরা যোগ করার মতো একটি নির্দিষ্ট বিষয় শেখে, তখন কেউ কেউ অন্যদের তুলনায় এটি আরো দ্রুত বুঝতে পারে। তখন শিক্ষকরা ওই শিক্ষার্থীদের সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়ে সরানোর পরিবর্তে তাদেরকে একই বিষয় সম্পর্কিত আরো বিভিন্ন কার্যকলাপ শেখায়। যেন ওই শিশুরা বিষয়টি সম্পর্কে গভীর ধারণা পায়।
‘এর মানে এই নয় যে ওই শিশুদের থামিয়ে দেয়া হয় বা অপেক্ষা করানো হয়। তারা তাদের মতো শিখে যায়। এই সময়ের মধ্যে বাকি শিক্ষার্থীরা তাদের পর্যায়ে চলে আসে,’ বলেন লিন্ডফ। ‘ধারণাটি হলো, যদি কিছু শিশুর যোগ সম্পর্কে খুব ভাল ধারণা থাকে, তাহলে শিক্ষকরা তাদের সরাসরি বিয়োগ করানোর দিকে নিয়ে যাবেন না, বরং তাদেরকে এমন কিছু দেবেন যা যোগের ধারণাকে আরো কিছুটা প্রসারিত করবে।’
উদাহরণস্বরূপ, শিশুদের বড় সংখ্যা যোগ করতে দেয়া। অথবা অন্যান্য, বিভিন্ন বিন্যাসে সংখ্যা যোগ করানো।
এভাবে যে শিশুরা ক্লাসের পড়া দ্রুত বুঝতে পারে, তারা ক্লাসের বাকিদের মতো একই ধরনের সমস্যার সমাধান করতে থাকে, তবে তারা এটি করে ভিন্ন উপায়ে। সিঙ্গাপুরে গণিত শেখানোর জন্য এটা নিশ্চিত করা খুবই জরুরি যে গণিত শেখা গুরুত্বপূর্ণ এবং সেটি শিক্ষার্থীদের নাগালের মধ্যে রয়েছে।
‘ধারণাটি হলো, প্রত্যেকেরই গণিত বোঝার এবং ব্যবহার করার ক্ষমতা রয়েছে। কারো কারো এই জাতীয় ধারণাগুলো বোঝার দক্ষতা কিছু স্তর পর্যন্ত থাকতে পারে, এবং প্রত্যেকেরই একটি নির্দিষ্ট স্তর পর্যন্ত সেই ধারণাটি আয়ত্ত করতে সক্ষম হওয়া উচিত,’ ব্যাখ্যা করেন লিন্ডফ।
তিনি বলেন, ‘কেউ কেউ দ্রুত শিখতে পারে। কিছু শিক্ষার্থী ক্লাসের পড়া যা বোঝে তার একটু গভীরে যেতে পারে।… আমরা প্রায়শই মনে করি যে কিছু শিক্ষার্থী গণিত বোঝে। ?আর কিছু শিক্ষার্থী কিছুই বুঝতে পারে না। কিন্তু সিঙ্গাপুরের গণিত এই ধারণাটি গ্রহণ করে না।’
এই পদ্ধতি কি অন্য দেশে কাজ করবে? পদ্ধতিটি ইতোমধ্যে অন্যান্য দেশ, যেমন- যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইসরাইল ও যুক্তরাজ্যের শিক্ষার্থীদের ওপর ব্যবহার করা হয়েছে। ড. লিন্ডফ বিশ্বাস করেন, সিঙ্গাপুরের গণিতের সাফল্যের সাথে দেশটির শিক্ষাগত সংস্কৃতি, প্রেক্ষাপট এবং ইতিহাসের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। ‘আমি মনে করি না আপনি এই পদ্ধতি অবিলম্বে অন্য দেশে এটি বাস্তবায়ন করতে পারবেন,’ বলেন তিনি। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি না যে আপনি কেবল পদ্ধতিটি নিতে পারেন এবং এটি অন্য দেশে প্রয়োগ করতে পারেন।’ ‘সিঙ্গাপুরের একটি আকর্ষণীয় ও অনন্য ইতিহাস রয়েছে, এবং এটি খুব ছোট একটি দেশ। সিঙ্গাপুরের শিক্ষা ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করার চিন্তা করা আর যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করার চাইতে একেবারেই আলাদা।’
তিনি আরো উল্লেখ করেন, অন্যান্য দেশের তুলনায় সিঙ্গাপুরের শিক্ষকদের ক্যারিয়ার আরো উন্নত করার সম্ভাবনা বেশি। এজন্য তারা বিভিন্ন সহায়তা পেয়ে থাকে। সেইসাথে অন্যান্য দেশের শিক্ষকদের তুলনায়, গণিতের প্রতি সিঙ্গাপুরের শিশুদের মনোভাবও সিঙ্গাপুরের গণিতকে সফল করার অন্যতম কারণ। ‘প্রশ্ন হলো, মানুষ কি গণিত পড়ার সুবিধা বুঝতে পারে? এবং গণিত শেখার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কী তা জানতে পারে?’
‘এই গণিত শিক্ষার লক্ষ্য কী শুধুমাত্র হোমওয়ার্কের সমস্যা সমাধান করার মধ্যে সীমাবদ্ধ নাকি এই শিক্ষার মাধ্যমে তারা তাদের বাস্তব জীবনের সমস্যা সমাধান করতে পারছে?’ সূত্র : বিবিসি