রবিবার, ১২ জানুয়ারী ২০২৫, ০৪:১৯ পূর্বাহ্ন

খুলনা জেলার নদীগুলোয় নাব্য সংকট সবচেয়ে বেশি

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় রবিবার, ১৮ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪

দেশে বর্তমানে নাব্য হারানো নদীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি সুন্দরবনবেষ্টিত খুলনা জেলায়। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনকে ঘিরে রাখা ৫৩ নদী নাব্য হারিয়েছে বলে সরকারের সাম্প্রতিক তথ্যে উঠে এসেছে। নদী ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, নদী নাব্য হারানোয় জীববৈচিত্র্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। জলজ প্রাণী, নদীকেন্দ্রিক অর্থনীতি ও পরিবেশ সংকটে পড়েছে। জোয়ারের লবণাক্ত পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে উপকূল। এতে মানব স্বাস্থ্য ও ফসলের ক্ষতি হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড ও জেলা প্রশাসনগুলোর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, দেশে প্রবহমান নদীর সংখ্যা ৯৩১। আর নাব্য হারানো নদীর সংখ্যা ৩০৮। এর মধ্যে খুলনায় ৫৩টি, কিশোরগঞ্জে ৩৩, দিনাজপুরে ২০, প গড়ে ১৯, ময়মনসিংহে ১৪, নীলফামারী ও ঝিনাইদহে ১২টি করে নদী নাব্য হারিয়েছে।
খুলনা জেলায় নাব্য সংকটে থাকা নদীর একটা বড় অংশের অবস্থান পাইকগাছায়। উপজেলা সদরে রয়েছে শিবসা ও কপোতাক্ষ। পৌর সদরের শিববাড়ী এলাকায় শিবসা ও কপোতাক্ষ নদের মিলনস্থল। এ মিলনস্থলে ৩৪৬ মিটারের একটি সেতু রয়েছে। এর প্রায় এক কিলোমিটারের মধ্যে শিবসা নদীর ওপর আরো একটি সেতু রয়েছে। এলাকাবাসীর অভিযোগ, পাশাপাশি দুটি সেতু থাকায় শিবসা ও কপোতাক্ষের পানিপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি হয়ে নদী দুটি নাব্য হারিয়েছে।
১৯৮০-এর দশকে এ অ লের মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থার অন্যতম মাধ্যম ছিল নৌপথ। সে সময় শিবসা ও কপোতাক্ষ ব্যবহার করে এ অ লে যাতায়াত ও বাণিজ্য বিনিময় হতো। বড়-ছোট ল , কার্গোসহ বিভিন্ন ধরনের নৌযানের অবাধ বিচরণ ছিল এসব নদীতে। তবে ২০০০ সালের পর থেকে নদী দুটির পানিপ্রবাহ কমতে থাকে। বর্তমানে দুটি নদীই মৃতপ্রায়। ভাটার সময় একটি ছোট নৌকার ওপর দিয়েই মানুষজন পারাপার হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করে পাইকগাছা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আনোয়ার ইকবাল মন্টু বলেন, ‘‌স্বাধীনতার আগে কলকাতার সঙ্গে এ অ লের নৌ যোগাযোগ ছিল। তবে ২০০০ সালের পর থেকে নদীর প্রবাহ কমতে থাকে। সেটা সেতুর কারণে হতে পারে, আবার প্রাকৃতিক কারণেও হতে পারে। আর গত এক দশকে এ অবস্থার আরো অবনতি হয়েছে। বর্তমানে উপজেলা সদরে নদী দুটি মৃতপ্রায়। তবে উপকূলে নদীর নাব্য এখনো স্বাভাবিক।’ এ প্রসঙ্গে খুলনা-৬ (পাইগাছা-কয়রা) আসনের সংসদ সদস্য মো. রশীদুজ্জামান বলেন, ‘‌তালিকায় যেসব নদীর নাম রয়েছে সেটির বড় অংশই পাইকগাছার। এছাড়া কয়রাসহ আরো কয়েকটি এলাকার নদীগুলোয় এ সংকট রয়েছে। আমাদের এ অ লের মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গে নদীর অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে। নদী বাঁচলে মানুষ বাঁচবে। তাই এলাকার নদীর নাব্য ফিরিয়ে আনতে যেসব পদক্ষেপ নেয়া দরকার, সেগুলো দ্রুত নেব।’
শুধু শিবসা ও কপোতাক্ষ নয়, নাব্য সংকটে খুলনার অন্য নদীগুলো হলো উত্তর কাঠামারি, কয়রা, কাটাবুনিয়া, কালিনগর, কিচিমিচি, কুরুলিয়া, গড়খালি, গাছুয়া, গুনাখালি, গেউবুনিয়া, গোয়াচাবা, ঘোষখালি, ঘ্যাংরাই, চাঁদখালি, চিত্রা, চুনকুড়ি, জিরবুনিয়া, ঝপঝপিয়া, ঢাকি, তালতলা, তেলিখালি, দিঘলিয়া, দেলু, নৈর, নোয়াই, পশুর, পুরাতন পশুর, বাতাঙ্গি, বাদুরগাছা, বানিয়াখালি, বিগরদানা, ভদ্রা, মঙ্গা, মধুখালি, ময়ূর, মরা ভদ্রা, মিনহাজ, মির্জাপুর, রাধানগর, লতা, পুতলাখালি, শাকবাড়িয়া, শামুকপোতা, শোলমারি, সালতা, সৈয়দখালি, হরিণখোলা, হরি, হাড়িয়া, হাবরখালি, জিলে ও চকরিবকরি। ফারাক্কা বাঁধের প্রভাবে খুলনা অ লের নদীগুলোর প্রবাহে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বলে মনে করেন রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের (আরডিআরসি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ। তিনি বলেন, ‘‌নদীর প্রবাহ কমলে নাব্য সংকট তৈরি হয়। বিশেষ করে খুলনা এলাকার নদীতে পানি আসে গঙ্গা অববাহিকা থেকে। ফারাক্কায় নিয়মিত যে স্রোত ও প্রবাহ থাকার কথা, সেটা তো নেই। এটাই মূলত খুলনা বা পার্শ্ববর্তী অ লের নদীগুলোয় প্রভাব ফেলেছে। উজান থেকে যে পানি আসে, সেটা গড়াই দিয়ে ঢোকে। সেই গড়াইয়ের মুখেও প্রতিবন্ধকতা আছে। এগুলো ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় না।’
আরেক নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকীও ফারাক্কাকে দায়ী করেছেন। তিনি জানান, ‌খুলনা বিভাগে যে নদীগুলো আছে, সেগুলোর উৎস গঙ্গা। পদ্মা থেকে পানি নিয়ে মাথাভাঙ্গা, শিয়ালমারি, হিসনা, গড়াই, চন্দনা ও ভৈরব নদ-নদী প্রবাহিত হয়। পদ্মায় যদি স্রোত থাকে তাহলে সেখান থেকে পানি গড়িয়ে এ নদীগুলোতে যায়। পরে সেটি বিভিন্ন নদী হয়ে খুলনার নদীগুলোতে মেশে। বর্তমানে পদ্মাতেই পানি কম। ফলে ওইসব নদী নাব্য হারাবে, সেটাই স্বাভাবিক। এগুলো সবই হচ্ছে ফারাক্কার কারণে।
তিনি বলেন, ‘‌ফারাক্কা ও অভ্যন্তরীণ পরিকল্পনার অভাবে আমরা প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার নদীর নাব্য হারিয়েছি। অপরিকল্পিত জলকপাট ও বাঁধ দেয়া হয়েছে। খুলনার যে নদীগুলো নাব্য হারিয়েছে, তার প্রধান কারণ ফারাক্কা।’

খুলনা অ লের নদীগুলো নাব্য হারিয়ে শুকনো মৌসুমে পানি থাকে না। ফলে পার্শ্ববর্তী খেতখামারে চাষের ব্যাঘাত ঘটছে। অন্যদিকে পানি না থাকার কারণে তাপমাত্রাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। কারণ পানি সূর্যের তাপকে টেনে নিয়ে আশপাশের এলাকাকে ঠা-া রাখে। এমনটাই জানিয়েছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স ডিসিপ্লিনের প্রধান অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী। তিনি জানান, ‌খুলনা থেকে আরো দক্ষিণে আগে নদীপথে পণ্য পরিবহন ও যাতায়াত ব্যবস্থা ছিল। নাব্য সংকটে সেটি আর নেই। এছাড়া নদী নির্ভরশীল জনগোষ্ঠী যারা ছিল, তারা পেশা হারিয়েছে। পাশাপাশি নদীগুলো মাছের প্রজনন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছিল, যা এখন আর নেই। আবার মাছের ওপর নির্ভরশীল বিভিন্ন প্রাণী যেমন পাখি, ভোদড়, শুশুক কমে গেছে।
ড. আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, ‘‌নাব্য হারানোর অন্যতম কারণ হচ্ছে উজানে যে নদী ছিল, পদ্মায় বাঁধ এবং তার সঙ্গে সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে নদীগুলো খননের কোনো ব্যবস্থা নেই। এছাড়া নদীভাঙন এবং অপরিকল্পিত বেড়িবাঁধের কারণে নদীগুলো ভরাট হয়েছে। খুলনা হচ্ছে জোয়ার-ভাটা অ ল, এ কারণে নদীগুলোয় প্রচুর পলি আসে। সেই পলি অপরিকল্পিত বেড়িবাঁধের কারণে নদীর বুকেই জমা হয়। ফলে নদীগুলো নাব্য হারিয়ে ফেলে।’ নাব্য সংকট উত্তোরণের জন্য সরকারের নানা কার্যক্রম চলমান বলে জানিয়েছেন পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব নাজমুল আহসান। তিনি বলেন, ‘‌আমরা পর্যায়ক্রমে সব নদীতে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। তবে যেসব নদী বেশি ভালনারেবল সেগুলোতে আগেই উদ্যোগ নিয়েছি। চলমান প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে এরই মধ্যে বেশকিছু নদী খননের কাজ করছি এবং এটি আমরা অব্যাহত রাখব। ভবিষ্যতে ডেল্টা প্ল্যান বাস্তবায়নের পরিকল্পনা রয়েছে। এ পরিকল্পনার আলোকে দেশে সব নদ-নদীকে সংরক্ষণ করার উদ্যোগ নেব।’- বণিক বার্তা




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com