রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:৪৬ পূর্বাহ্ন

আমার দেখা বেনুয়ে নদীর দেশ নাইজেরিয়া

অধ্যক্ষ তরুণ কান্তি বড়ুয়া:
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ১ মার্চ, ২০২৪

ভ্রমণের প্রতি ছোটকাল থেকেই আমার একটা দুর্দমনীয় আকর্ষণ ছিল। মনে ইচ্ছে জাগত যেন সীমাহীন দিক দিগন্তের পথে পাখির মতো উড়ে চলি একস্থান থেকে অন্যস্থানে, একদেশ থেকে অন্য একদেশে। নাইজেরিয়ার পথে যাত্রা শুরুর মাধ্যমে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ আমার জীবনে প্রথম আসে। ১৯৮২ সালের মাঝামাঝি নাইজেরিয়ার সকোটো স্টেট সিভিল সার্ভিস কমিশনের একটি প্রতিনিধি দল ঢাকায় আসেন তাদের স্টেটের স্কুল কলেজের জন্য বিভিন্ন বিষয়ে কিছু শিক্ষক নিয়োগ করার জন্য। বাংলাদেশ ম্যান পাওয়ারব্যুরোর মাধ্যমে নির্ধারিত তারিখে সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠিত হয়। মাস ছয়েক পর দিল্লিস্থ নাইজেরিয়ান হাই কমিশনের মাধ্যমে নিয়োগ পত্র হাতে আসে। সেদেশের আনুষ্ঠানিকতা শেষে আমাদের নাইজেরিয়া যাত্রা প্রায় ১বছর বিলম্বিত হয়। বিভিন্ন বিষয়ের জন্য নির্বাচিত ৪০জন শিক্ষকের মধ্যে ২০জন করে দুটি দলে ভাগ করে আমাদেরকে সকোটো নিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত হয়। প্রথম দলটির সদস্য হওয়াতে যাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। প্রথমবারের মতো দেশের বাইরে যাওয়ার সে এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি। এ যেন চাকরির সুবাদে বিদেশ যাত্রার এক অভিনব সুযোগ।
১৯৮৩ সালের ২৯ জুলাই। মহাসাগরের উপকূলীয় দেশ নাইজেরিয়ায় আমাদের বহুল প্রত্যাশিত যাত্রার দিনক্ষণ। রাত ১০টায় দুবাই হয়ে ইতালির রোম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পর্যন্ত যাই বাংলাদেশ বিমানের ডিসি ১০ ফ্লাইটে। যথাসময়ে সন্ধ্যা ৭টার পর জনশক্তি কর্মসংস্থান ব্যুরোর একজন সহকারী পরিচালক আমাদের ২০জন যাত্রীর পাসপোর্ট নিয়ে বোর্ডিং পাস সংগ্রহের কাজ এবং ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়া শেষে আমাদেরকে বহির্গমণ লাউঞ্জে পৌঁছে দিলেন। এখানে হলো আরেক অপ্রত্যাশিত ব্যাপার। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে বহনকারী বাংলাদেশ বিমানের ডিসি ১০ ফ্লাইট সৌদি আরব থেকে এসে না পৌছায় আমাদের ঐ রাতের যাত্রা বাতিল হয়ে যায়। বিমান কর্তৃপক্ষ হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ভেতরে আমাদের নৈশ আহারের ব্যবস্থা করেন। বিমান যাত্রীদের মধ্য থেকে সকোটোগামী ২০জন যাত্রীকে বিমানের বাসে করে হোটেল পূর্বানীতে পৌঁছে দেয়। ঐদিন রাতে বিমান ভ্রমণে থাকার পরিবর্তে হোটেল পূর্বাণীতে রাত্রিযাপন করতে হয়। পরদিন সকালে হোটেলে প্রাতঃরাশ সাড়ার পর আমাদেরকে বিমানবন্দরে নিয়ে যাওয়া হয়। ইমিগ্রেশন যেহেতু আগের রাত সম্পন্ন করা ছিল এবার সরাসরি বিমানে উঠার পালা। সকাল ১০টায় বাংলাদেশ বিমানের ডিসি ১০ ফ্লাইট হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দও থেকে উড্ডয়নের পর দুবাইয়ের পথে উড়তে থাকে। নির্ধারিত সময়ে আমাদের ফ্লাইট দুবাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণের পর আবারও আমাদেরকে বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়। যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে দুবাই বিমানবন্দরে ৬ঘন্টা যাত্রাবিরতির পর আমাদের বিমান রোম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উদ্দেশে যাত্রা করে স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৮টায় (বাংলাদেশ সময় রাত ১২টা) রোম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মাটি স্পর্শ করে। রোমে আমাদের ৩৬ঘন্টা যাত্রাবিরতি ছিল। অবশ্য যাত্রাবিরতির সময় সীমা কিছুটা কমে দুবাইয়ে অপ্রত্যাশিত বিলম্বের কারণে। নাইজেরিয়া এয়ারওয়েজের সৌজন্যে রোম এয়ারপোর্টের অনতিদূরে হোটেল স্যাটেলাইটে পরবর্তী সময়ের জন্য আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। দুদিনের ক্লান্তিকর যাত্রা শেষে শরীর অবসাদগ্রস্থ থাকায় হোটেলে ভালোই ঘুম হয়েছিল। পরদিন অর্থাৎ ১৯৮৩ সালের ৩১ জুলাই, সকালে প্রাতঃরাশ সেরেই পাশ্ববর্তী এক রেলস্টেশন থেকে রোম নগরীর উদ্দেশে যাত্রা করি। রোম নগরীর প্রাচীন দালানগুলো দেখে রোমান সভ্যতা ও রোমান স্থাপত্যশিল্পের অতীত ইতিহাস আমাদের চোখের সামনে উঠে আসে।
রোমের রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় এক বাংলাদেশী যুবকের সাথে দেখা। তিনি আমাদেরকে ২ঘন্টার যাত্রাপথে ভেটিকান সিটি ঘুরে আসার প্রস্তাব দিলেও অপরাহ্ন ঘনিয়ে সন্ধ্যা নেমে আসার কথা ভেবে ভেটিকান যাওয়া আর হয়ে উঠেনি। রাতটি রোমে কাটালাম। পরেরদিন মূল যাত্রাস্থল কানু হয়ে সকোটো যেতে হবে।
১৯৮৩ সালের ১ আগস্ট। সকাল ১০টায় নাইজেরিয়ান এয়াওয়েজের ফ্লাইটে রোম থেকে কানুর উদ্দেশ্যে যাত্রা এবং স্থানীয় সময় বিকেল ৩টায় ফ্লাইটটি কানু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মাটি স্পর্শ করে। ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়া শেষে আমরা মাইক্রোবাস টার্মিনালে চলে গেলাম। সেখানে দেখি ভাড়া নিয়ে ড্রাইভারের দরকষাকষি। আমাদেও যেতে হবে ৬/৭ ঘন্টার যাত্রাপথ সকোটো। মাইক্রো ভাড়া নিয়ে সকোটোর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু হলো। দৈব দুর্বিপাক কাকে বলে। দুবাই এয়ারপোর্টে ঘটে যাওয়া অপ্রত্যাশিত দীর্ঘ যাত্রা বিরতির ভূত যেন কানু-সকোটো মাইক্রোবাসেও চেপে বসেছিল। যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে মাইক্রোবাসটি পথিমধ্যে বারবার থেমে যাচ্ছে। আরেক বিড়ম্বরনা শুরু হলো বাসের ড্রাইভারকে নিয়ে। সে নাকি পার্শ্ববর্তী নাইজার রিপাবলিকের নাগরিক। পুলিশের হাতে ধরা পড়ে শেষ পর্যন্ত কিছু উপহার দেওয়াতে মোটামুটি ছাড়া পেয়ে যায়। অপরাহ্ন ৪টার পরে রওনা হয়ে ভোর ৪টার দিকে সকোটোস্থ বাংলাদেশী প্রকৌশলী দেবনাথ বাবুর বাসায় উঠি। সেই ভোররাতে ২০জন বাংলাদেশীর উপস্থিতি বহুভাষী নাইজেরিয়ার দেশে দেবনাথ বাবুর বাসায় সাময়িক চাপ সৃষ্টি করেছিল।
১৯৮৩ সালের ২ আগস্ট। স্থানীয় সময় সকাল ১০টায় আমরা ২০জন এক্সপেট্রিয়েট অফিসার বিদেশের মাটিতে সকোটো সিভিল সার্ভিস কমিশনে গিয়ে নতুন কর্মক্ষেত্রে যোগদান করি। উপস্থিতি এবং যোগদান পর্ব শেষে আমাদেরকে সকোটো গেস্ট ইন’এ মধ্যাহ্ন ভোজে আপ্যায়িত করালেন সকোটো সিভিল সার্ভিস কমিশন ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাবৃন্দ। সন্ধ্যার পূর্বে মন্ত্রণালয়ের গাড়িতে করে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় রাজধানী সকোটো থেকে ৯০কি.মি. দূরে অবস্থিত আরগুংগু রেস্ট হাউসে। তখন স্কুল কলেজে গ্রীষ্মের ছুটি চলমান থাকায় দীর্ঘ প্রায় ২মাসের জন্য আমাদের সাথে ও পরে আসা মোট ৪০জন এক্সপেট্রিয়েট অফিসারদের উক্ত রেস্ট হাউসে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কটেজ টাইপের রেস্ট হাউসের প্রতিটিতে ২জনের থাকার সুব্যবস্থা ছিল। পোস্টিং সংক্রান্ত কাজে এখান থেকেই সবাইকে মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করতে হতো। অবশ্য সকোটো পৌঁছার পর আমাদেরকে বেতনের কিছু অগ্রিম নাইরা মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া হয়েছিল। রেস্ট হাউসে থাকাকালীন সময়ে নাস্ত, লাঞ্চ, ডিনার, চা-কফি বাবদ খরচের সম্পূর্ণ খরচ মন্ত্রণালয় বহন করেছিল। ইতোমধ্যে মন্ত্রণালয় কর্তৃক বিভিন্ন স্কুল কলেজে আমাদের পোস্টিং এর কাজ সম্পন্ন হতে যাচ্ছিল। পোস্টিং নিয়ে সবাই কিন্তু খুবই উদ্বিগ্ন ছিলা কারণ রাজ্যের রাজধানী সকোটো ছাড়া হাতে গোনা ৪/৫টা উপশহর ছিল যেখানে নিত্য প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ ও পানির সরবরাহ নিশ্চিত ও সার্বক্ষণিক ছিল। শহরতলি এবং গ্রামাঞ্চলের জায়গাগুলো তাদের ভাষায় বুশ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো যেহেতু সরকার পরিচালিত তাই ক্যাম্পাসভিত্তিক স্কুল-কলেজ ভবন ও শিক্ষকদের বাসস্থানের অবকাঠামোগত অবস্থান ছিল দৃষ্টিনন্দন। ক্যাম্পাসে বাসস্থান সংকট থাকলে ক্যাম্পাসের বাইরে মন্ত্রণালয় কর্তৃক ভাড়া বাসা নেওয়ার সুব্যবস্থা ছিল। সমস্যা হলো ভাগ্যদেবী সুপ্রসন্ন ছিলনা এমন শিক্ষকদের বুশ এলাকায় ভীষণ কষ্টে দিন কাটাতে হয়। সেসব জায়গায় সুরম্য বাসা থাকলেও পানি এবং বিদ্যুতের সরবরাহ না থাকায় শিক্ষকদের দুর্বিষহ জীবন যাপন বিভূঁই বিদেশে ছিল করুণ স্মৃতিবহ ।
সকোটো’র পর কয়েকটি উপশহর যেমন গুছাও, আরগুংগু এবং বারর্নিংকেবীর চিত্রপট অনেকটা ভিন্ন কারণ এসব স্থানে সার্বক্ষণিক পানি এবং বিদ্যুতের সরবরাহ সুনিশ্চিত ছিল। সৌভাগ্যক্রমে আমিও বন্ধু দুলাল বড়ুয়া উপশহর আরগুংগুতে পোস্টিং পেয়েছিলাম। সকোটো রাজ্য যেখানকার স্কুল-কলেজে শিক্ষকতার জন্য আমরা ৪০জন শিক্ষককে আনা হয়েছিল সেটি ছিল অনেকটা মরু অঞ্চলী েেদশের মতো। খুব ঘন বনাঞ্চল না হলেও বনাঞ্চলের পথ পাড়ি দিয়ে অনায়াসে একস্থান থেকে অন্যস্থানে যাতায়াত করা যেত। রাস্তাগুলো সুপ্রসস্থ হওয়ার কারণে ভ্রমণ বেশ স্বাচ্ছন্দ্যময় ছিল। এতে এক রাজ্য হতে অন্য রাজ্যে যাতায়াত সহজসাধ্য ও আরামদায়ক ছিল। গাড়ি চালানোর গতিবেগ ঘন্টায় ৯০-১২০ কিলোমিটার নির্ধারিত ছিল। কোনো কোনো চালককে ১৫০কি.মি. গতিবেগে গাড়ি চালাতে দেখতাম। দ্রুত গতিতে যানবাহন চলাচল করার কারণে দুর্ঘটনা কবলিত গাড়িগুলোর চালক এবং যাত্রীদের বেঁচে থাকা সম্পূর্ণ অনিশ্চিত ছিল।
সকোটো শহরের সর্বত্রই সারি সারি নিমগাছ দেখে দেশটিকে মরু অঞ্চল মনে হয়নি। এটি শুধু সকোটো শহর নয়, মফস্বল এলাকায়ও স্কুল-কলেজ এবং সরকারি, আধা সরকারি ভবন চত্বরও নিমগাছ দ্বারা আচ্ছাদিত। সকোটোতে আমার স্বল্পকালীন অবস্থান সময়ে পার্শ্ববর্তী কানু এবং কাদুনা রাজ্যে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। সেখানেও একই চিত্র দৃশ্যমান ছিল। শহর এবং উপশহরগুলোর সুপার মার্কেটগুলোতে হরেক রকমের বিদেশি পণ্যের সমারোহ দেখে যেকোনো উন্নত দেশের চিত্র স্মৃতিতে ভেসে ওঠে। কাঁচা বাজারগুলোতে হরেক রকম শাকসবজি পাওয়া যেত। কিছু কিছু আমাদের দেশীয় সবজী যেমন ঢেঁড়স, শশা, টমাটো, বাঁধাকপি, ফুলকপি, গাজর, বীট, আলু, কলা, পেঁপে, মিষ্টি কুমড়া ইত্যাদি। মাছের মধ্যে কিছু নদীর মাছ পাওয়া যেত। আমাদের কর্মস্থল আরগুংগু সরকারি টিচার্স কলেজ এবং সামা সেকেন্ডারি স্কুলের সন্নিকটে আরগুংগু নদী থাকাতে আমরা কিছু কিছু নদীর মাছ পেতাম। তবে মাগুর (আফ্রিকান মাগুর) এবং শিং মাছ ছাড়া অন্যান্য মাছগুলো চেনা যেত না। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, উল্লিখিত আরগুংগু নদীতে প্রতিবছর মাছ ধরার উৎসব অনুষ্ঠিত হতো যেখানে পার্শ্ববর্তী অন্যান্য রাজ্যগুলোর লোকজন অংশগ্রহণ করতো। গরুর মাংস, খাসির মাংস এবং রেমের মাংস তাদের খুবই প্রিয়।
তেল সমৃদ্ধ নাইজেরিয়ার কথা শুনে অনেকটা রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম যা আগেই উল্লেখ করেছি। স্থানীয় মুদ্রা এক নাইরার দাপ্তরিক মূল্য ছিল ১.৩৩ ইউএস ডলার। প্রতিমাসে ৫০% রেমিট্যান্স প্রেরণ করা যাবে যা আমাদের চাকরির চুক্তিপত্রে উল্লেখ ছিল। ১৯৮৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর, বছরের শষ রাতে শেহু শাগারীর বেসামরিক সরকারকে হটিয়ে ল্যাফটেন্যান্ট জেনারেল বুহারীর নের্তৃত্বে¡ সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করে নেয়। তারপর যা হবার তাই ঘটে যাচ্ছিল। রেমিট্যান্স প্রেরণ অনিশ্চিত, কার লোন বন্ধ এবং ফ্যামিলি প্যাসেজ দেওয়ার সিদ্ধান্ত স্থগিত ইত্যাদি নানান সমস্যা আমাদের সেখানে অবস্থানের বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়। আমাদের পূর্বে যাওয়া অনেক শিক্ষক, ডাক্তার এবং প্রকৌশলী যারা ছিল তারা তখনকার বিদ্যমান সুবিধাদি পেয়ে অর্থনৈতিকভাবে কিছুটা ভালো অবস্থানে ছিল। অনেক বিদেশি এক্সপেট্রিয়েটদের স্থানীয় বসদের তোষামোদে ব্যস্ত থাকতে দেখা যেত। তাদের অনেককেই বলতে শুনেছি আমাদেরকে ঠেলে বের করে না দিলে আমরা এদেশ ছেড়ে যাব না। রেমিট্যান্স না পেলেও স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে খেয়ে পড়ে বাকি দিনগুলো কাটিয়ে দেবো কিন্তু আমাদের অভিমত ছিল ভিন্ন। পর্যায়ক্রমে আমরা অনেকে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে দেশে ফিরে আসার পরিকল্পনা গ্রহণ করলাম। আমি ও বন্ধু দুলাল বড়ুয়া মন্ত্রণালয়ে দৌড়ঝাপ দিয়ে ফেরত টিকেট নিয়ে দেশে ফেরার চেষ্টা করে প্রায় ৩ মাসের মধ্যে মধ্যে টিকেট পেয়ে লন্ডন হয়ে দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি।
নাইজেরিয়াতে অবস্থানকালে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা ব্যবস্থা, অফিসসমূহের সেবা, গণমানুষের আচার আচরণ সম্পর্কে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা কিছুটা তুলে ধরার চেষ্টা করছি। নাইজেরিয়ার অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকার কর্তৃক পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত। এককালের পরাক্রমশালী বৃটিশ শাসন ও সাম্রাজ্যের উপনিবেশ হওয়ার কারণে শিক্ষার মাধ্যম ও সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহে শতভাগ ইংরেজি ভাষার ব্যবহার প্রচলিত আছে। প্রাথমিক শিক্ষাজীবন শেষে শিক্ষার্থীদের উচ্চ বিদালয়ে ভর্তি হয়ে ফর্ম ১ থেকে ফর্ম ১০ পর্যন্ত পড়ালেখা করে চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়। এটি উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের পরীক্ষা যা ওয়েস্ট আফ্রিকান এক্সামিনেশন কাউন্সিল এর নীতিমালা অনুসারে পরিচালিত হয়। তারপর টারশিয়ারি শিক্ষা কার্যক্রম। অফিস পাড়ায় স্থানীয়দের আচার আচরণ মাঝে মাঝে পীড়া দিচ্ছিল। একবার সরকারি সিদ্ধান্তে সব কাগজের নোটগুলো একসাথে বাতিল করে ব্যাংকে জমা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। অথচ বিকল্প কোনো নতুন নোট দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল না। প্রায় সপ্তাহখানেক এভাবে চলতে ছিল। বাসায় আমাদের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস ফুরিয়ে প্রায় শূণ্যেও কোঠায়। অনেকটা উপোস থাকার অবস্থা। ব্যাংকের একজন কর্মচারীকে বললাম পার্ট পার্ট কওে নোটগুলো বদলালে ভালো হতো। তাকে বললাম, আমাদের দেশে তো তাই করে। দেশের সাথে তুলনা করে কথাটা বলা আমার ঠিক ছিল না। তাই তিরস্কার মূলক কথাটি আমাকে শুনতে হয়েছিল। সে বলেছিল ‘হুয়াইল ইউ আর ইন রোম, বিহাভ লাইক দ্য রোমানস’।
নিয়ম নীতির অপরিকল্পিত সিদ্ধান্ত থাকলেও ভুল হোক, শুদ্ধ হোক স্বদেশ প্রেমের আভিজাত্য তাদের মধ্যে প্রকটভাবে লক্ষ্য করা যেত। মধ্যে প্রাচ্যের কিছু দেশে নাকি বিদেশি লোকদের ফকির মিসকিনের সাথে তুলনা করার কথা শুনেছি। সেখানে এ ধরনের তেমন কোনো মন্তব্য শুনিনি। তবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দাপ্তরিক কাজ করতে গিয়ে স্থানীয় কিছু কিছু লোকের উদাসীনতা আমাদের বাংলাদেশী শিক্ষকদের দেশে ফিরে আসা ত্বরান্বিত করেছিলো। তবে গ্রামাঞ্চলের সাধারণ জনগণকে বিদেশিদের যথেষ্ট সম্মান করতে দেখেছি। বিশেষ করে বয়স্ক পুরুষ কিংবা মহিলারা মুষ্টিবদ্ধ ডানহাত বুকে ঠেকিয়ে মাথা নুইয়ে আমাদের সম্মান বা অভিবাদন জানাতো।
এবার আমাদের লন্ডন হয়ে বাংলাদেশে ফিরে আসার বর্ণনা। ১৫ জুলাই ১৯৮৪ সাল। নাইজেরিয়ান এয়ারলাইনসের একটি আভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে সকোটো কানু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছে এয়ারলাইনসের ভাড়াকরা একটি হোটেলে উঠলাম। হোটেলে রাত্রিযাপন শেষে পরদিন সকালে প্রাতঃরাশ সেরে কানু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছি। নাইজেরিয়ান এয়ারওয়েজের একটি বোয়িং বিমান আমাদেরকে নিয়ে সকাল ১০টায় কানু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়নের পর স্থানীয় সময় বিকেল ৩টার পর হিথ্রো বিমানবন্দরের মাটি স্পর্শ করে। হিথ্রো পৌঁছেই ইমিগ্রেশন কাউন্টারে গিয়ে আমি ও বন্ধু দুলাল বড়ুয়া লন্ডনে সাময়িক অবস্থানের জন্য সাত দিনের ভিসা চাইলে কর্তৃপক্ষ আমাদের আবেদন মঞ্জুর করে। ভিসা না পেলে পরদিন বাংলাদেশের পথে রওনা দিতে হতো। ভিসা পেয়ে এক সপ্তাহ লন্ডন ঘুরে দেখার সুযোগ পেয়ে যাই। তারপর আমার সম্বন্ধী অধ্যাপক অরবিন্দ বড়ুয়ার ভায়রাভাই রাউজানস্থ নোয়াপাড়া বৈদ্যপাড়ার সুসন্তান বাবু কনক কান্তি বড়ুয়ার সাথে ফোনে যোগাযোগ করে টিউব রেলওয়ের ট্রেনে করে উনার বাসার পথে রওয়ানা হলাম। ফোনালাপে যে স্টেশনে আমাদের নামতে বলা হয় অপেক্ষায় থাকা কনক বাবুকে খুঁজে নিতে আমাদের কষ্ট হয়নি।
১৬ জুলাই ১৯৮৪ সাল। সকালেই আমরা ট্রেনের টিকিট সংগ্রহ করলাম। শুরু হলো টুরিস্ট মানচিত্র অনুযায়ী লন্ডন ভ্রমণ। লন্ডনে অবস্থানের সময়ে প্রতিদিন নাস্তা সেরে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দর্শন শেষে সন্ধ্যাকালে কনক বাবুর বাসায় ফিরে আসতাম। কনক বাবুর সহধর্মিণীর সাথে সকাল সন্ধ্যা দেখা হলেও কনক বাবুর সাথে দেখা ও আলাপ হতো শুধু নৈশ কালীন খাবার টেবিলে কারণ আমরা ঘুম থেকে উঠার আগেই কনক বাবু অফিসে চলে যেতেন।
১৯৮৪ সালের ১৯ জুলাই। স্থানীয় সময় রাত ৯টায় আমাদের ঢাকাগামী বৃটিশ এয়ারওয়েজের ফ্লাইট নির্ধারিত ছিল। সেদিন সকালে কনক বাবুর সাথে আমাদের বিদায়ী সাক্ষাৎ শেষ করতে হয়েছিল কারণ সন্ধ্যায় উনি বাসায় ফিরার পূর্বে আমরা হিথ্রো বিমানবন্দরের উদ্দেশে যাত্রা করবো। লন্ডন ছেড়ে আসার পূর্ব মুহুর্তগুলো সঠিকভাবে ভ্রমণে ব্যস্ত থাকার লোভ সংবরণ করতে পারিনি। তাই শেষদিন সকাল থেকে দুুপুর ২টা পর্যন্ত টুরিস্ট বাসের ছাদে বসে লন্ডন নগরীর বিভিন্ন স্থানসমূহ দেখার সর্বশেষ সুযোগটাও ছেড়ে আসিনি। ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়া শেষে বৃটিশ এয়ারওয়েজের ফ্লাইটে যখন আসন গ্রহণ করি তখন স্থানীয় সময় রাত ৮.৩০ মিনিটে লন্ডনের পশ্চিমাকাশে সবেমাত্র সূর্য অস্ত যাচ্ছিল। পরদিন স্থানীয় সময় সকাল ১০ টায় নির্ধারিত যাত্রাবিরতির জন্য আমাদের ফ্লাইটটি কাতার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। কাতর এয়ারপোর্ট থেকে উড্ডয়নের পর আমাদের ফ্লাইট স্থানীয় সময় বিকেল ৪ টায় মাতৃভূমির হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মাটি স্পর্শ করে। দীর্ঘ এক বছর পর মাতৃভূমির মাটির স্পর্শে দেশের প্রতি গভীর মমত্ববোধ ও ভালোবাসার এক অনির্বচনীয় অনুভূতি উপলব্ধি করলাম। অবচেতন মনে যেন গানের সুর বেজে উঠল ‘ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা।
লেখক পরিচিতি:
প্রাবন্ধিক ও সাবেক অধ্যক্ষÑরাংগুনিয়া সরকারি কলেজ, চট্টগ্রাম।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com