শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:৪২ অপরাহ্ন

পেশা ছাড়ছেন বিমাকর্মীরা

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় শনিবার, ২ মার্চ, ২০২৪

এজেন্ট হিসেবে ২০০৬ সালে বিমা পেশা বেছে নেন মো. শরিফুল ইসলাম (ছদ্মনাম)। গ্রামে গ্রামে ঘুরে স্বল্প আয়ের কয়েকশ মানুষকে বিমার আওতায় আনেন। মাসে এক, দুই বা পাঁচশ টাকা করে বিমা প্রিমিয়াম দিতে থাকেন এসব গ্রাহক। ১০ বছর পর এসব বিমা পলিসির মেয়াদ শেষে ঘটে বিপত্তি। মাসের পর মাস, এমনকি বছর গড়িয়ে গেলেও কোম্পানি গ্রাহকদের বিমা দাবির টাকা পরিশোধ করে না। তিক্ত-বিরক্ত হয়ে গ্রাহকরা শরিফুলকে নানাভাবে নাজেহাল করতে থাকেন। এক পর্যায়ে নতুন গ্রাহকদের বিমা করা বন্ধ করে দেন এই বিমা এজেন্ট। একই সঙ্গে নানা উপায়ে তার মাধ্যমে যেসব গ্রাহক বিমা করেছেন, তাদের দাবির টাকা আদায়ের চেষ্টা করেন। মানসিকভাবে ভেঙে পড়া শরিফুল এক সময় পেশাই ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। শুধু শরিফুল নন, এ ধরনের তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছে কয়েক হাজার বিমা এজেন্ট। দ্বারে দ্বারে ঘুরে স্বল্প আয়ের মানুষকে বিমার আওতায় আনা অনেক এজেন্ট মেয়াদ শেষে তাদের দাবির টাকা তুলে দিতে না পারার তিক্ত অভিজ্ঞতার শিকার হয়েছেন। রাগে-ক্ষোভে অনেকেই এক পর্যায়ে ছেড়েছেন পেশা। বিমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) হিসাবেই ২২টি জীবন বিমা কোম্পানিতে নিষ্ক্রিয় এজেন্টর সংখ্যা তিন লাখ ২২ হাজার ৩৮৮ জন।
বিমা পেশা ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে শরিফুল ইসলাম বলেন, এইচএসসি পাস করে এজেন্ট হিসেবে যখন কাজ শুরু করি তখন বেশ ভালো লাগতো। নতুন নতুন পলিসি বিক্রি করতাম, কমিশনের টাকা পেতাম। এতে পলিসি বিক্রির আগ্রহ বেড়ে যায়। কিন্তু মেয়াদ শেষে যখন গ্রাহক দাবির টাকা পাচ্ছেন না, তখন সব খুশি, আনন্দ শেষ হয়ে যায়। দাবির টাকা না পাওয়া গ্রাহক নানাভাবে আমাকে নাজেহাল করতে থাকেন। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় নিজের বাড়িতেই থাকা কঠিন হয়ে পড়ে।
তিন লাখের বেশি নিষ্ক্রিয় এজেন্ট এটা বিমা খাতের জন্য সুখকর নয়। তবে এরা কমিশনভিত্তিক। অনেকে আছেন সিজনাল কাজ করেন, অন্য জবেও আছেন। আমাদের অধিকাংশ বিমা কোম্পানি সময়মতো দাবির টাকা দিচ্ছে না এবং অনেকে একেবারেই দিতে পারছে না। বিমা খাতে এটা একটা বড় সমস্যা।- ডেল্টা লাইফের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা আনোয়ারুল হক তিনি বলেন, আমার মাধ্যমে যারা বিমা করেছেন, তারা অনেক কষ্ট করে টাকা দিয়েছেন। মেয়াদ শেষে যখন তারা সেই টাকা ফেরত পাবেন না, স্বাভাবিকভাবেই তারা ক্ষিপ্ত হবেন। এক পর্যায়ে সবকিছু মেনে নিয়েছি। কেউ কিছু বললে মুখ বুঝে সহ্য করি। নতুন বিমা পলিসি বিক্রি করা বন্ধ করে দিয়েছি। বিমার প্রতি আমার আস্থা পুরোপুরি উঠে গেছে।

তিনি আরও বলেন, আমি কাজ শুরুর অল্প সময়ের মধ্যেই ৫শ জনকে বিমার আওতায় নিয়ে আসি। বিমা কোম্পানি যদি দাবির টাকা সময়মতো গ্রাহকদের পরিশোধ করতো, তাহলে অনেক মানুষকে বিমার আওতায় আনা সম্ভব হতো। কিন্তু কোম্পানি সময়মতো দাবির টাকা না দেওয়ায় মানুষ এখন বিমার নাম শুনলেই বিরক্ত হয়। ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর উপজেলার মো. জুয়েল পেশায় একজন ভ্যানচালক। পরিশ্রমের টাকা অল্প অল্প করে জমিয়ে একটি বিমা পলিসি কেনেন। নিয়ম মেনে প্রিমিয়ামের সব টাকা জমা দিলেও মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ছয় মাসের বেশি পার হলেও তিনি বিমার টাকা পাননি।
এ বিষয়ে জুয়েল বলেন, যার মাধ্যমে বিমা করেছি, তার কাছে গেলেই বলে কোম্পানিতে সব কাগজপত্র পাঠানো হয়েছে। কোম্পানি চেক পাঠালেই পেয়ে যাবেন। ছয় মাসের বেশি সময় ধরে ঘুরছি, কিন্তু বিমার টাকা পাচ্ছি না। আমি ভ্যান চালানো টাকা দিয়ে বিমা করেছি, এখন সেই টাকা ফেরত পাচ্ছি না। বিভিন্ন মাধ্যমে কোম্পানিতে যোগাযোগের চেষ্টা করছি, তাতেও কাজ হচ্ছে না। এরপর জুয়েল যে এজেন্টের মাধ্যমে বিমা পলিসি কেনেন তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। উজ্জ্বল নামে এই বিমাকর্মী বলেন, আমি ভদ্র ঘরের সন্তান। বিমাকর্মী হিসেবে কাজ করতে গিয়ে যেন পাপ করে ফেলেছি। প্রতিদিন মানুষ বিমার টাকার জন্য বাড়িতে এসে উৎপাত করে। কোম্পানিতে গ্রাহকদের সব কাগজপত্র নিয়ম মেনে পাঠিয়ে দিলেও মাসের পর মাস চলে যাচ্ছে, দাবির টাকা দিচ্ছে না। এখানে তো আমাদের কিছু করার নেই। কোম্পানি টাকা না দিলে আমরা কীভাবে দেবো। এদিকে আইডিআরএর তৈরি করা প্রতিবেদন অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি নিষ্ক্রিয় এজেন্ট ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সে। এই জীবন বিমা কোম্পানিটিতে নিষ্ক্রিয় বিমা এজেন্টের সংখ্যা এক লাখ ২৪ হাজার ৬১৯ জন। এর পরের স্থানেই রয়েছে বিদেশি মালিকাধীন প্রতিষ্ঠান মেট লাইফ। এই বিমা কোম্পানিটির ৬৯ হাজার ৫০৮ জন এজেন্ট নিষ্ক্রিয়।
প্রগতি লাইফ ইন্স্যুরেন্সে নিষ্ক্রিয় এজেন্টের সংখ্যা ৪৬ হাজার ৮শ জন। সরকারি মালিকানাধীন একমাত্র জীবন বিমা প্রতিষ্ঠান জীবন বীমা করপোরেশনে ৪৫ হাজার ৯৯৯ জন এজেন্ট নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন। ১০ হাজার ৪৪৪ জন নিষ্ক্রিয় এজেন্ট রয়েছে প্রাইম ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সে।
কোম্পানি দাবির টাকা ঠিকমতো পরিশোধ না করায় এজেন্টরা অনেক সময় স্থানীয়ভাবে ঝামেলায় পড়ে। আপনি একজনকে বিমা করালেন, তার প্রাপ্তির সময় তার প্রাপ্তি দিতে পারলেন না, তাহলে তো আপনার প্রতি তার আস্থা বা বিশ্বাস থাকবে না। ওই রকম হয়েছে।- আইডিআরএ মুখপাত্র জাহাঙ্গীর আলম এছাড়া রূপালী লাইফে ৩ হাজার ৪৭২ জন, মেঘনা লাইফে এক হাজার ৬৮৩ জন, গার্ডিয়ান লাইফে এক হাজার ৩৮১ জন, চাটার্ড লাইফে দুই হাজার ৩৬৯ জন, ন্যাশনাল লাইফে দুই হাজার ৭৩৩ জন, প্রোটেক্টিভ ইসলামী লাইফে ২৫৯ জন, আলফা ইসলামী লাইফে ৪ হাজার ৪৪ জন, জেনিথ ইসলামী লাইফের এক হাজার ৬১০ জন, হোমল্যান্ড লাইফের তিন হাজার ২৫১ জন, আস্থা লাইফের ২০ জন, ফারইস্ট ইসলামী লাইফের ৫৯৭ জন, লাইফ ইন্স্যুরেন্স করপোরেশন (এলআইসি) অব বাংলাদেশ এক হাজার ১২৯ জন, ডায়মন্ড লাইফে ৪৪৭ জন, মার্কেন্টাইল ইসলামী লাইফে ১৪০ জন, সন্ধানী লাইফে এক হাজার ৪৬১ জন এবং সানফ্লাওয়ার লাইফে ৪২২ জন এজেন্ট নিষ্ক্রিয়। বিমা কোম্পানিগুলো নিয়মমাফিক দাবির টাকা পরিশোধ না করায় অনেকে গ্রাহকের হয়রানির শিকার হয়ে বিমা পেশা ছাড়ছেন। আইডিআরএ প্রতিবেদন অনুযায়ী, তিন লাখ ২২ হাজারের বেশি এজেন্ট নিষ্ক্রিয়, এটা বিমা খাতের জন্য সুখকর কি? এমন প্রশ্ন করা হলে ডেল্টা লাইফের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার (সিইও) চলতি দায়িত্ব পালন করা আনোয়ারুল হক বলেন, ‘তিন লাখের বেশি নিষ্ক্রিয় এজেন্ট এটা বিমা খাতের জন্য সুখকর নয়। তবে এরা কমিশনভিত্তিক। অনেকে আছেন সিজনাল কাজ করেন, অন্য জবেও আছেন।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের অধিকাংশ বিমা কোম্পানি সময়মতো দাবির টাকা দিচ্ছে না এবং অনেকে একেবারেই দিতে পারছে না। বিমা খাতে এটা একটা বড় সমস্যা। সে কারণে অনেকে এ পেশায় থেকে সম্মান পায় না। গ্রাহকরা অসম্মান করে, সে কারণে হয়তো নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। এটা ছাড়াও নানা কারণে নিষ্ক্রিয় হয়। তবে প্রধান কারণ এটি (দাবি পরিশোধ না করায় গ্রাহক দ্বারা হয়রানির শিকার)।’
ডেল্টা লাইফে সবচেয়ে বেশি নিষ্ক্রিয় এজেন্টের কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কোম্পানির জন্ম থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত সব তথ্য রয়েছে। ওই তথ্য আমরা রেখে দিয়েছি। কোম্পানির বয়স ৩৭ বছর হয়ে গেছে। এ কারণে সংখ্যা বেশি। এখানে পুরাতন সংখ্যাই বেশি। নতুন নিষ্ক্রিয় আমাদের কম। আমরা হয়তো খুব আহামরি ব্যবসা করি না, কিন্তু দাবি পরিশোধে আমাদের কোনো অভিযোগ নেই। আমরা দাবি নিয়মিত দিচ্ছি এবং সেই সক্ষমতা আমাদের আছে।’
জেনিথ ইসলামী লাইফের সিইও এবং বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স ফোরামের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এস এম নূরুজ্জামান বলেন, ‘কয়েকটি কোম্পানির বিমা দাবি পরিশোধের হার খুবই খারাপ। এ কোম্পানিগুলোর কারণে সমগ্র বিমা খাতের বদনাম হচ্ছে। বাজারে ছড়িয়ে পড়ছে, বিমা কোম্পানি টাকা দেয় না। অনেক সময় দাবির টাকা না পাওয়া গ্রাহকরা এজেন্টদের ওপর ক্ষিপ্ত হয়। বিমাকর্মীদের পেশা ছাড়ার পেছনে এটা একটা কারণ হতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘একটা সেক্টরে যখন একাধিক কোম্পানি খারাপ করে, তখন তার প্রভাব সার্বিক সেক্টরের ওপর পড়ে। বিমা খাতের মূল সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে সঠিকভাবে দাবি পরিশোধ না করা। কয়েকটি কোম্পানি গ্রাহকদের দাবি পরিশোধ না করার কারণে যারা ভালো করছে তাদেরও বদনাম হচ্ছে।’ আইডিআরএ মুখপাত্র জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘কোম্পানি দাবির টাকা ঠিকমতো পরিশোধ না করায় এজেন্টরা অনেক সময় স্থানীয়ভাবে ঝামেলায় পড়ে। আপনি একজনকে বিমা করালেন, প্রাপ্তির সময় তার প্রাপ্তি দিতে পারলেন না, তাহলে তো আপনার প্রতি তার আস্থা বা বিশ্বাস থাকবে না। ওই রকম হয়েছে।’
এ সমস্যা সমাধানে আপনাদের উদ্যোগ কী? এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘আমাদের উদ্যোগ সব সময় আছে। বিমা দাবি পরিশোধ আইডিআরএর সর্বোচ্চ প্রাধিকার দেয়। এখন যে সমস্যা বহুদিনের, সেটা তো একেবারে তাড়াতাড়ি সমাধান হয়ে যাবে না। আইডিআরএ এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করছে।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com