সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:২৪ পূর্বাহ্ন

হাসপাতালের চিকিৎসকদের ওপর ইসরায়েলি বাহিনীর পাশবিক নির্যাতন

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ১৫ মার্চ, ২০২৪

ইসরায়েলের সেনাদের হাতে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন ফিলিস্তিনের চিকিৎসকেরা। গত মাসে হাসপাতালে অভিযানের পর ইসরায়েলি সেনারা তাঁদের চোখ বেঁধে আটকে রাখা থেকে শুরু করে বারবার মারধর ও বিবস্ত্র করার মতো নানা নির্যাতন করেছেন। ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসিকে এই নির্যাতনের কথা জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা।
গাজার নাসের হাসপাতালের চিকিৎসক আহমেদ আবু সাবাহ এক সপ্তাহের বেশি ইসরায়েলের নির্যাতনকেন্দ্রে আটক ছিলেন। এ সময় তাঁর হাত ভেঙে দেওয়া হয়। মুখে ঠুসি লাগানো কুকুর লেলিয়ে দেওয়া হয়।
আহমেদ আবু সাবাহর মতোই নির্যাতনের মুখোমুখি হয়েছেন আরও অনেকেই। কিন্তু প্রতিশোধের ভয়ে তাঁরা নাম প্রকাশ করতে চান না। বিবিসিকে তাঁরা বলেন, তাঁদের লাঞ্ছিত করা হয়েছিল। মারধর করা হয়েছিল। গায়ে ঠান্ডা পানি ঢেলে দেওয়া হয়েছিল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অস্বস্তিকর অবস্থানে হাঁটু গেড়ে থাকতে বাধ্য করা হয়েছিল। ছেড়ে দেওয়ার আগে তাঁদের দীর্ঘ সময় বন্দিশিবিরে কাটাতে হয়েছিল। চিকিৎসকদের এই অভিযোগের বিস্তারিত ইসারেয়েল প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) কাছে পাঠিয়েছিল বিবিসি। এ নিয়ে সরাসরি কোনো প্রশ্নের উত্তর দেয়নি আইডিএফ। তারা নির্দিষ্ট অভিযোগ অস্বীকারও করেনি। তবে কোনো চিকিৎসকের ক্ষতি করা হয়েছে, এমন অভিযোগ তারা প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা বলেছে, বন্দীদের সঙ্গে যেকোনো দুর্ব্যবহার আইডিএফ আদেশের পরিপন্থী এবং কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। দক্ষিণ গাজায় ব্যাপক হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল। হাসপাতালে নেই প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসামগ্রী ও রোগীর জন্য শয্যা। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য নেই পর্যাপ্ত পানি। এর মধ্যেই আহতদের মেঝেতে রেখে চলে চিকিৎসা।
দক্ষিণ গাজায় ব্যাপক হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল। হাসপাতালে নেই প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসামগ্রী ও রোগীর জন্য শয্যা। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য নেই পর্যাপ্ত পানি। এর মধ্যেই আহতদের মেঝেতে রেখে চলে চিকিৎসা।ছবি: এএফপি
গত ১৫ ফেব্রুয়ারি গাজার খান ইউনুস হাসপাতালে হামলা করে ইসরায়েলি বাহিনী। এর আগপর্যন্ত এটি কোনোরকমে চালু ছিল। ইসরায়েলি সেনাদের অভিযোগ, হাসপাতালে হামাসের সদস্যরা রয়েছেন, এমন গোয়েন্দা তথ্য ছিল। তাঁদের বলা হয়েছিল, গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালিয়ে হামাস যাঁদের জিম্মি করে রেখেছে, তাঁদের ওই হাসপাতালে রাখা হয়েছে। পরে মুক্ত হওয়া কয়েকজন জিম্মিও সে কথা বলেছেন। হামাস তা অস্বীকার করে বলেছে, হাসপাতলের ভেতর থেকে তাদের যোদ্ধারা লড়াই করেন না।
১৬ ফেব্রুয়ারি হাসপাতালের গোপন ক্যামেরায় ধারণ করা ভিডিও বিবিসির কাছে রয়েছে। তাতে দেখা গেছে, হাসপাতালের জরুরি ভবনে একসারি মানুষকে পরনের পোশাক খুলতে বাধ্য করা হচ্ছে। মাথার পেছনে হাত দিয়ে হাঁটু মুড়ে বসতে বলা হচ্ছে। তাঁদের অনেকের সামনে চিকিৎসকদের পোশাক পরে রয়েছেন।
হাসপাতালের ব্যবস্থাপক আতেফ আল-হুত বলেন, কেউ যদি কোনো নড়াচড়া করেন বা মাথা নাড়ান, তবে তাঁদের দুই ঘণ্টা একইভাবে বসে থাকতে বাধ্য করেন ইসরায়েলি সেনারা।

আইডিএফ বলেছে, নিয়ম অনুযায়ী গ্রেপ্তারের সময় সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীকে পোশাক খুলে রাখতে বলা হয়। কারণ, তাঁদের পোশাক তল্লাশি করে তাতে বিস্ফোরক রয়েছে কি না, তা পরীক্ষা করে দেখা হয়। চিকিৎসকেরা বলেন, ওই পরিস্থিতিতে সবাইকে হাসপাতাল ভবনে নিয়ে মারধর করা হয়। এরপর তাঁদের নগ্ন করে বন্দিশিবিরে নেওয়া হয়। নাসের হাসপাতালে সদ্য যোগ দেওয়া চিকিৎসক আবু সাবাহ বলেন, বন্দিশিবিরে খাবার না দেওয়া থেকে শুরু করে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকার মতো নানা নির্যাতন করা হয়।
মানবাধিকার আইনবিশেষজ্ঞ বলেন, চিকিৎসকদের বক্তব্য ও ভিডিও চিত্র অনুযায়ী এই ঘটনা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। বিবিসির কাছে যে তথ্য এসেছে, তা স্পষ্টভাবে খুব নিষ্ঠুর এবং অমানবিক আচরণের সীমা অতিক্রম করেছে।
বিবিসি কয়েক সপ্তাহ ধরে হাসপাতালের তথ্য তদন্ত করেছে। চিকিৎসক, নার্স, ফার্মাসিস্ট এবং বাস্তুচ্যুত লোকদের সঙ্গে কথা বলছে। তথ্য পুনরায় নিশ্চিত হওয়ার জন্য কাজ করেছে। বন্দিশিবিরে থাকা নাসের হাসপাতালের ৪৯ চিকিৎসকের তালিকা পেয়েছিল বিবিসি। এর মধ্যে ২৬ জনের নাম বিভিন্ন উৎস থেকে পেয়েছিল। এর মধ্যে তিনজন চিকিৎকসকের নাম আগে আসেনি। তাঁদের একজন আবু সাবাহ। তাঁর দুবার সাক্ষাৎকার নিয়েছে বিবিসি। পাঁচজন চিকিৎসকের পরিবার বলেছে, তারা এখনো প্রিয়জনের সন্ধান পায়নি। এ ছাড়া রেডক্রস জানিয়েছে, তারা ১২ জনের বেশি চিকিৎসকের পরিবারের কাছ থেকে প্রিয়জনকে খুঁজে না পাওয়ার ফোনকল পেয়েছে।
নাসের হাসপাতালে দায়িত্বরত চিকিৎসকেরা বলেন, ইসরায়েলি বাহিনীর হামলার পর তাঁরা আর রোগীর চিকিৎসা করতে পারেননি। ইসরায়েলি সেনারা নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার সময় হাসপাতালে ২০০ রোগীর চিকিৎসা চলছিল। তাঁদের অনেকেই বিছানা থেকে ওঠার অবস্থায় ছিলেন না। ছয়জন আইসিইউতে ছিলেন। যাঁরা এসব রোগীর দেখাশোনার দায়িত্বে ছিলেন, তাঁদেরও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যায় ইসরায়েলি বাহিনী। এর বদলে অস্বাস্থ্যকর পরিস্থিতিতে থাকা রোগীদের ওপর দায়িত্ব দেওয়া হয়। ইসরায়েলি বাহিনী নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পরদিনই সেখানে ১৩ জন রোগী মারা যায়। এর কারণ হাসপাতালের পরিস্থিতি। ওই সময় হাসপাতালে বিদ্যুৎ, পানি ও অন্যান্য দরকারি জিনিস ছিল না। ইসরায়েলি সেনারা বিবিসিকে বলেছে, তাঁরা হাসাপাতালে খাবার দিয়েছিলেন এবং এটি চালু রাখতে বিকল্প জেনারেটর দিয়েছিল। ১৮ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) জানায়, হাসপাতালে খাবার ও জরুরি দরকারি চিকিৎসা সরঞ্জাম ছিল না। এ ছাড়া হাসপাতাল চালু রাখার সবকিছু কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। হাসপাতালে থাকা রোগীদের অন্য হাসপাতালে নিতে বাধ্য করা হয়।
বন্দিশিবির থেকে ছাড়া পাওয়া চিকিৎসকেরা অভিযোগ করেন, মুবারক নামের প্রসূতি বিভাগকে জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষ বানায় ইসরায়েলি সেনারা।
আবু সাবাহ বলেন, প্রথমে তাঁকে রোগীদের সঙ্গে থাকতে বলা হয়। পরে তাঁকে প্রসূতি বিভাগে নিয়ে নির্যাতন শুরু করা হয়। তিনি বলেন, ‘আমাকে প্রথমে চেয়ারে বসায়। তারপর তাঁদের হাতে একটি ফাঁস দেখতে পাই। আমি দড়ির শব্দ শুনছিলাম। মনে হচ্ছিল আমাকে ফাঁস দিয়ে হত্যা করতে যাচ্ছে। এরপর তাঁরা একটি বোতল ভেঙে আমার পা কেটে দেন। সেখান থেকে রক্ত বের হতে থাকে। এরপর একে একে চিকিৎসকদের সেখানে জড়ো করতে দেখি। আমি তাঁদের গলা শুনতে পাচ্ছিলাম।’
আইডিএফ এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, তারা মিথ্যা ফাঁসির নাটক সাজায় না।
তিনজন বন্দী চিকিৎসক বলেন, তাঁদের সেনাবাহিনীর গাড়িতে তুলে মারধর করা হয়। পরে একসঙ্গে সবাইকে নিয়ে যাওয়া হয়। লাঠি, বন্দুকের বাঁটসহ নানা জিনিস দিয়ে তাঁদের আঘাত করা হয়। নাম প্রকাশ না করে এক চিকিৎসক বলেন, ‘আমাদের পরনে অন্তর্বাস ছাড়া আর কিছু ছিল না। আমাদের একে ওপরের ওপর জড়ো করতে থাকেন। আমাদের গাজার বাইরে নিয়ে যায়। পুরো পথে মারধর করা হয়। গায়ে ঠান্ডা পানি ঢেলে দেওয়া হয়।’
আবু সাবাহ বলেন, ‘একপর্যায়ে গাড়ি থেকে আমাদের নামানো হয়। চোখ বেঁধে আমাদের এক জায়গায় হাঁটু গেড়ে বসতে বাধ্য করা হয়। মাটিতে গর্ত খোঁড়া ছিল। আমরা ভাবছিলাম, আমাদের মেরে এখানে পুঁতে দেবে। আমরা প্রার্থনা শুরু করি।’
এরপর আবু সাবাহ নিজেকে বন্দিশিবিরে দেখতে পান। সেখানে অন্যদেরও রাখা ছিল। মুক্তি পাওয়া অন্য দুই চিকিৎসক বলেন, তাঁদের পরীক্ষা করা হয়। কিন্তু কোনো ওষুধ দেওয়া হয়নি। আহত স্থানে চিকিৎসার বদলে আরও আঘাত দেওয়া হয়।
আবু সাবাহ বলেন, বন্দিশিবিরে তাঁদের নিয়ম করে শাস্তি দেওয়া হতো। সেখানেই তাঁর ওপর নির্যাতন চালান এক ইসরায়েলি সেনা। মেরে তাঁর হাত ভেঙে দেয় ওই সেনা। টয়লেটে নিয়ে মুখে ঠুসি লাগানো কুকুর লেলিয়ে দেন।
চিকিৎসকেরা বলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ কী, তাঁরা তা জানেন না। দুজন বলেন, হাসপাতালে তাঁরা বন্দী বা হামাসের কাউকে দেখেছে কি না, তা জানতে চাওয়া হয়। ৭ অক্টোবর তাঁরা কোথায় ছিলেন, সে প্রশ্নও করা হয়। এখনো হামাসের হাতে ১৩০ ইসরায়েলি বন্দী হয়ে আছে। ইসরায়েলি কর্মকর্তারা বলছেন, বন্দীদের ৩০ জন মারা গেছেন।
হামাসের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, ইসরায়েলে হামলায় এখন পর্যন্ত ৩১ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাঁদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু।
আবু সাবাহ বলেন, আট দিন বন্দী থাকার সময় তাঁর ওপর অমানবিক নির্যাতন করা হলেও তাঁকে কখনো জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি। তিনজন চিকিৎসক বলেন, মুক্তি পাওয়ার পর তাঁদের চোখ বেঁধে গাজায় ফিরিয়ে আনা হয়। বিবিসি জানায়, ইসরায়েল নিয়ন্ত্রিত কেরাম শালোম ক্রসিং থেকে গাজায় ফিরে আসেন আবু সাবাহ।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com