একজন মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ। মানবজাতির জন্য আল্লাহর মনোনীত জীবনব্যবস্থা ইসলামে এ ব্যাপারে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশসহ অনেক দেশে গাড়ি ও শিল্প-কারখানার ধোঁয়া-বর্জ্যে মানুষের বাঁচার পরিবেশ মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে। বর্তমানে আমাদের রাজধানী ঢাকা বিশ্বের সর্বাধিক দূষিত শহরের তালিকায় ৩ নম্বরে রয়েছে। তা ছাড়া সবচেয়ে বেশি আতঙ্কের বিষয় হচ্ছে, ধোঁয়া-বর্জ্যের বিস্তার এবং পাহাড় কাটা ও বৃক্ষনিধনের ফলে জলবায়ুতে যে পরিবর্তন আসছে, তার প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠ দিন দিন উঁচু হতে চলেছে। এতে মালদ্বীপ, বাংলাদেশসহ অনেক দেশের বিরাট অংশ পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। পরিবেশদূষণ ও জলবায়ুর ক্ষতিকর পরিবর্তন রোধে ইসলাম কী নির্দেশ দিয়েছে, তা জেনে নিই।
পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন থাকার নির্দেশ: পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেনÍঅর্থ : আর যারা পবিত্রতার প্রতি যতœবান, তাদেরই আল্লাহ ভালোবাসেন। [সুরা আত তাওবাহ : ৯/১০৮]
হাদিস শরিফে এসেছেÍঅর্থ : হজরত আবু মালিক আল আশআরী রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্ল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্ল্লাম বলেছেন, পবিত্রতা ঈমানের অর্ধেক। আর ‘আলহামদুলিল্লাহ’ [বলার সাওয়াব] পাল্ল্লা পরিপূর্ণ করে দেয়। [সহিহ মুসলিম শরিফ, হাদিস : ২২৩]
অর্থ : হজরত আয়েশা সিদ্দিকা রা. থেকে বর্ণিত, একসময় হজরত আসমা রা. রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হায়েজের [ঋতুস্রাব থেকে পবিত্র হওয়ার] গোসলের নিয়ম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। উত্তরে তিনি বললেন, তোমরা প্রথমে পানি নিয়ে তাতে পদ্মপাতা মেশাবে।
অতঃপর হাত-মুখ ও যৌনাঙ্গকে ভালো করে ধুয়ে নেবে। অতঃপর মাথায় পানি ঢেলে চুলের গোড়ায় পানি পৌঁছে এরূপে চুলে ভালো করে ঘষামাজা করবে। অতঃপর শরীরে পর্যাপ্ত পানি ঢালবে। অতঃপর সুগন্ধিযুক্ত কাপড়ের একটি টুকরা [বর্তমানে তোয়ালে-গামছা] দিয়ে শরীর মুছে নেবে। [সহিহ মুসলিম শরিফ, হাদিস : ৩৩২]
অর্থ : হজরত সাদ রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্ল্লাম বলেছেন, নিশ্চয় আল্ল্লাহ পবিত্র এবং তিনি পবিত্রতাকে ভালোবাসেন।
নিশ্চয় তিনি পরিচ্ছন্ন এবং পরিচ্ছন্নতাকে তিনি ভালোবাসেন। নিশ্চয় তিনি আত্মমর্যাবোধসম্পন্ন এবং আত্মমর্যাবোধকে তিনি ভালোবাসেন। নিশ্চয় তিনি উদার এবং উদারতাকে তিনি ভালোবাসেন। তাই তোমরা তোমাদের ঘরের উঠানকে পরিচ্ছন্ন রাখবে এবং অপরিচ্ছন্নতায় ইহুদিদের সদৃশ হবে না। [তিরমিজি শরিফ, হাদিস : ৩৩২]
অর্থ : হজরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্ল্লাম বলেছেন, যেভাবেই হোক তোমরা পরিচ্ছন্ন থাকবে। কারণ আল্ল্লাহ পরিচ্ছন্নতার ওপরই ইসলামের ভিতকে দাঁড় করিয়েছেন। আর পরিচ্ছন্ন লোকজন ছড়া আর কেউ জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। [রাফেঈর আত তাদবিন : ১/১৭২]
বৃক্ষরোপণের নির্দেশ: হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছেÍঅর্থ : হজরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্ল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কোনো মুসলিম যদি কোনো শস্য চাষ করে বা কোনো গাছ রোপণ করে এবং তা থেকে যদি কোনো মানুষ, কোনো পাখি, কোনো পশু, কোনো হিংস্র প্রাণী বা অন্য কোনো প্রাণী যদি [ফল, পাতা, লতা, ডাল] খায়, তাহলে এর বিনিময়ে সে [জীবিত ও মৃত উভয় অবস্থায় ওই ফল, পাতা, লতা, ডাল ইত্যাদি] দান করার সাওয়াব পাবে। [সহিহ বুখারি শরিফসহ আটটি গ্রন্থ, বুখারির হাদিস নম্বর : ২১৯৫]
অর্থ : হজরত জাবির রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্ল্লাম বলেছেন, কোনো মুসলিম যদি কোনো গাছ রোপণ করে, তাহলে তা থেকে যা কিছু খাওয়া হবে, তা তার জন্য সদকা বলে গণ্য হবে। তা থেকে যা চুরি হবে, তা-ও তার জন্য সদকা বলে গণ্য হবে। আর তা থেকে যদি কোনো পাখি বা কোনো হিংস্র প্রাণী খায়, তাহলে সেটাও তার জন্য সদকা বলে গণ্য হবে। আর যদি কেউ ওই গাছের কোনো ক্ষতি করে, তাহলে সেটাও তার জন্য সদকা বলে গণ্য হবে। [সহিহ মুসলিম শরিফ, হাদিস : ১৫৫২]
অর্থ : হজরত আমর ইবনুল আসি রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্ল্লাম বলেছেন, কোনো মুসলিম যদি কোনো গাছ রোপণ করে বা কোনো শস্য চাষ করে এবং তা থেকে যদি কোনো মানুষ বা কোনো পাখি খায়, তাহলে এর বিনিময়ে সে [জীবিত ও মৃত উভয় অবস্থায় ওই ফল, পাতা, লতা, ডাল ইত্যাদি দান করার] সাওয়াব পাবে। [তবরানি আওসাত, হাদিস : ৮৯৮৭]
অর্থ : হজরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, সাত উত্তম কাজের সওয়াব মানুষ মৃত্যুর পরও পেকে থাকে। তা হলোÍকোনো জ্ঞান শিক্ষা দেওয়া, কোনো নদী-নালা চালু করা, কোনো কূপ খনন করা, কোনো খেজুরগাছ [যেকোনো ফলগাছ হলে চলবে] রোপণ করা, কোনো একটি মসজিদ নির্মাণ করা, কোনো একটি কিতাব রেখে যাওয়া এবং কোনো সৎ সন্তান রেখে যাওয়া, যে তার জন্য মৃত্যুর পর গুনাহ মাফের দোয়া করবে। [বাইহাকির শুআবুল ঈমান, হাদিস : ৩৪৪৯]
অর্থ : হজরত মুআয ইবনু আনাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্ল্লাম বলেছেন, যে কারো ওপর কোনো অন্যায় ও সীমা লঙ্ঘন ছাড়া কোনো গৃহ নির্মাণ করল অথবা কোনো গাছ রোপণ করল, সে এর তত দিন অব্যাহতভাবে সওয়াব পেতে থাকবে, যত দিন তা থেকে আল্ল্লাহর কোনো সৃষ্টি উপকৃত হবে। [মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ১৫৬৫৪ ও বাইহাকির শুআবুল ঈমান, হাদিস : ৩৪৪৯]
অর্থ : হজরত খল্লাদ ইবনু সায়েব রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্ল্লাম বলেছেন, যে কোনো চারা রোপণ করল এবং তা থেকে কোনো পাখি বা অন্য কোনো প্রাণী বা মানুষে খেল, তাহলে সে এর জন্য সওয়াব পাবে। [মুসনাদ আহমদ, হাদিস : ১৬৬০৭ ও তবরানি কবির, হাদিস : ৪১৩৪]
অর্থ : হজরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যদি কেয়ামত এসে পড়ে এবং ওই সময় তোমাদের কারো হাতে একটি চারা থাকে, তাহলে সম্ভব হলে সে যেন সেটি রোপণ করে দেয়। [মুসনাদ আহমদ, হাদিস : ৪১৩৪ এবং বুখারির আল আদাবুল মুফরাদ, হাদিস : ৪৭৯]
পাহাড় সংরক্ষণের নির্দেশ: পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে অর্থ : আমি কি তোমাদের জন্য জমিনকে বিছানা এবং পাহাড়গুলো পেরেক হিসেবে তৈরি করিনি? [সুরা আন নাবা : ৭৮/৬-৭]
আল্লাহর এই বাণী থেকে প্রতীয়মান হয়, পানির ওপর ভাসমান এই পৃথিবীর স্থিরতার জন্যই তিনি এর ওপর পাহাড়গুলো গেড়ে দিয়েছেন। অতএব, এই পাহাড়ের ক্ষতিসাধন যে পৃথিবীর মাঝে ভূমিকম্প এবং এর আবহাওয়ায় উষ্ণতাসহ বিভিন্ন দুর্যোগ ডেকে আনতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়।
হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে অর্থ : হজরত আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে তার নিজের অভিভাবককে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করল, আল্লাহ তাকে অভিশপ্ত করুন। আর যে জমিনের কোনো নিদর্শন [পাহাড়-টিলা ও নদী-খাল ইত্যাদি] নষ্ট করল, তাকেও আল্ল্লাহ অভিশপ্ত করুন। আর যে কোনো অন্ধকে পথ দেখাল না, তাকেও আল্ল্লাহ অভিশপ্ত করুন। আর যে তার মা-বাবাকে অভিশাপ দিল, তাকেও আল্ল্লাহ অভিশপ্ত করুন। আর যে কোনো পশুর সঙ্গে সঙ্গম করল, তাকেও আল্ল্লাহ অভিশপ্ত করুন। আর যে লুত সম্প্রদায়ের কাজ [সমকামিতা] করল, তাকেও আল্ল্লাহ অভিশপ্ত করুন [শেষের এ বাক্যটি তিনি তিনবার উচ্চারণ করলেন]। [মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ৮৫৫ ও আল হাকিম, হাদিস : ৮০৫২]
অর্থ : হজরত কাছির ইবনু আবদুল্লাহ তাঁর পিতা এবং তাঁর পিতা তাঁর দাদা থেকে বর্ণনা করেনÍরাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, কেউ জমিনের কোনো নিদর্শন [পাহাড়-টিলা ও নদী-খাল ইত্যাদি] নষ্ট করলে কেয়ামতের দিন তার ওপর আল্ল্লাহর অভিশাপ ও ক্রোধ পতিত হবে এবং আল্লাহ তার ফরজ-নফল কোনো ইবাদত গ্রহণ করবেন না। [তবরানি কবির : ১৭/২৩]