শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৫৪ অপরাহ্ন
শিরোনাম ::

গুলিবিদ্ধরা কাতরাচ্ছেন হাসপাতালের বেডে

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় সোমবার, ২৯ জুলাই, ২০২৪

বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের আন্দোলন ১ জুলাই থেকে ১৫ জুলাই পর্যন্ত ছিলো শান্তিপূর্ণ। কিন্তু না, সরকারের অসহিষ্ণু আচরণ এবং আইনশৃঙ্খলা বহিনীর মাত্রাহীন শক্তি প্রয়োগে ১৬ জুলাই থেকে অশান্ত হয়ে ওঠে রাজধানী ঢ্যাকাসহ সারা দেশ। এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীল গুলীতে ২১০জনের শাহাদাত বরণ করার খবর পাওয়া গেছে। আহত হয়েছেন কয়েক হাজার। গুলিবিদ্ধরা কাতরাচ্ছেন হাসপাতালের বেডে। গত কয়েক দিনের সংঘর্ষে আহত ২৭২ জন এখনো ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ভর্তি আছেন। গতকাল রাতে হাসপাতাল সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে। এর মধ্যে কেউ কেউ গুলিবিদ্ধ রয়েছেন। তাদের মধ্যে গতকাল ইয়াসিন নামে একজন মারা গেছেন। পরিবার জানিয়েছে, ইয়াসিন একজন গার্মেন্ট শ্রমিক। কাজ শেষে বাসায় ফেরার পথে গুলিবিদ্ধ হন। হাসপাতাল সূত্র জানায়, ঢামেকে যারা গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ভর্তি আছেন তাদের অনেকেই এখনো শঙ্কামুক্ত নন। এ দিকে, হাসপাতালে ঢোকার ব্যাপারে অলিখিত নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। সাংবাদিকরা ঢুকে ইচ্ছেমতো তথ্য নিতে পারছেন না। আহত বা তাদের স্বজনদের সাথে কথা বলতে পারছেন না।
মিটফোর্ড হাসপাতালে গতকাল পর্যন্ত ভর্তি ছিলেন একজন। এ ছাড়া মুগদা হাসপাতাল এবং রাজধানীর বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে এখনো অনেকে ভর্তি আছেন বলে জানা গেছে। তাদের অধিকাংশই গুলিবিদ্ধ।
এ দিকে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট হাসপাতাল সূত্র জানায়, চোখে গুলিবিদ্ধ হয়ে সেখানে চিকিৎসা নিয়েছেন ৪২৪ জন। তাদের মধ্যে ২৭৮ জনের চোখে অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়া রোগীরা রাজধানীর বাইরের বিভিন্ন জেলা থেকেও এসেছেন।
একজন চিকিৎসক জানান, চোখে গুলিবিদ্ধদের অনেকে অন্ধ হয়ে যেতে পারেন। অল্প আহতরা প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়েছেন। তবে যাদের রক্তক্ষরণসহ অঙ্গ গুলিবিদ্ধ হয়ে সিরিয়াস ছিলেন তাদের বেডসহ আইসিইউ ও এইচডিইউতে ভর্তি করা হয়েছে।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, যে ২৭৮ জনের অপারেশন হয়েছে তাদের পরবর্তী সময়ে ফলোআপে আসতে বলা হয়েছে। তাদের মধ্যে অনেকেরই পরবর্তীতে চোখে সমস্যা হতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। ফলোআপে থাকলে সেই সমস্যা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে।
হাসপাতালের মেঝে, বারান্দাতেও ঠাঁই হচ্ছে না : কেউ কিশোর, কেউ তরুণ, আবার অনেকে মধ্যবয়সী। সবাই গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছেন। তাদের কেউ সরাসরি গুলি, কেউ বা ছররা গুলিতে বিদ্ধ হন। কারো হাতে, কারো পেটে, কারো বা পায়ে গুলি লেগেছে। যাদের বেশির ভাগই পঙ্গুত্বের শিকার হতে পারেন। অনিশ্চিত এক জীবনের কথা ভেবে আহত ও তাদের স্বজনদের চোখে মুখে অসহায়ত্ব।
এই চিত্র রাজধানীর উত্তরার একটি হাসপাতালের। যেখানে প্রায় ৬ দিন আগে পেটে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ভর্তি হওয়া শাওন শেখ (২১) এখন বিছানায় কাতরাচ্ছেন। রাজধানীর বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ছাত্রের নাকে ক্যানুলা লাগানো। শরীরে একাধিক ব্যান্ডেজ। কথা বলতে পারছেন না। শুধু চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরছে।
মামা সুজন মোল্লা জানান, গত ১৯ জুলাই শাওন আজমপুর ছিল। পুলিশের একটি সাঁজোয়া যান এয়ারপোর্টের দিকে যাওয়ার সময় গুলি ছুড়তে থাকলে একটি গুলি শাওনের পেটে এসে লাগে। ঘটনাস্থল থেকে তাকে উদ্ধার করে আনা হয় হাসপাতালে।
শাওন শেখের মতো গুলিবিদ্ধ অবস্থায় একই হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন যোবায়ের আহমেদ নামে আরেক শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, ন্যায়সঙ্গত দাবি আদায়ে আমরা রাজপথে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করে আসছিলাম। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ দুর্বৃত্তরা আমাদের ওপর হামলা চালায়। গুলি করা হয়। আমিও গুলিবিদ্ধ হই। আমাদের অনেক ভাইকে গুলি করা হয়েছে।
শুধু উত্তরার হাসপাতালগুলোই নয়, সরেজমিনে রাজধানীর আরো কয়েকটি হাসপাতালে ঘুরে দেখা গেছে, ‘তিল ধারনের ঠাঁই নেই’। আহত রোগী আর স্বজনদের ভিড় বেড থেকে মেঝে, বারান্দা অবধি। যারা বেড পাননি তারা মেঝেতে কাপড় বিছিয়ে চিকিৎসেবা নিচ্ছেন। আবার অনেকে বারান্দাতেও আশ্রয় নিয়েছেন। অনেকে আবার বেড পাওয়ার আশায় বিভিন্নজনের কাছে তদবির করছেন।

জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর) পরিচালক ও অর্থোপেডিক সার্জারির অধ্যাপক ডা: কাজী শামীম উজ্জামান বলেন, প্রতিটি রোগীর একাধিক অস্ত্রোপচার প্রয়োজন। তারা চিকিৎসকের পর্যবেক্ষণে রয়েছেন। রোগীর ক্ষত স্থানের অবস্থা দেখে পর্যায়ক্রমে অস্ত্রোপচারের সময় নির্ধারণ করা হবে।
শিক্ষার্থী ছাড়াও আহতদের মধ্যে রয়েছেন নানা পেশা ও শ্রেণীর মানুষ। রাজনীতির সাথে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। হাসপাতালের বেডে তারা কাতরাচ্ছেন। অনেকে চিরদিনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেছেন। চোখে মুখে তাদের আতঙ্কের ছাপ। এদের অধিকাংশের সঙ্গে ছাত্র আন্দোলনের কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। কেউ রিকশা নিয়ে বের হয়েছিলেন জীবনের তাগিদে, কেউ গিয়েছিলেন কাজে, অথবা কেনাকাটা করতে। অধিকাংশই গুলিবিদ্ধ হয়ে এখন হাসপাতালে ভর্তি।
কারো পেটে, কারো পিঠে আবার বারোবা পায়ে গুলি লেগেছে। এতে পা কেটে ফেলা হয়েছে। আবার কারো কারো দুই পায়ে ব্যান্ডেজ। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ৪২০ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি ২০ জনের প্রায় সবাই গুলিবিদ্ধ। কারো লেগেছে একটি গুলি, কারো লেগেছে দুটি। অনেকগুলো ছররা গুলির ক্ষত নিয়েও ভর্তি কেউ কেউ। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে রাজধানীর মিরপুরে সংঘর্ষের সময় বাসায় ফিরতে গিয়ে ১৯ জুলাই (শুক্রবার) গুলিবিদ্ধ হয় এক কিশোর। স্থানীয় একটি স্কুলের নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থী সে। তার দুই পায়ে যে দুটি গুলি লেগেছে, তা রাবার বুলেট বা ছররা গুলি নয়। দুই পায়ে ব্যান্ডেজ নিয়ে শুয়ে আছে বেডে। ২৭ বছরের যুবক জাকির শিকদার। জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (পঙ্গু হাসপাতাল) ক্যাজুয়ালটি-২ বিভাগে ভর্তি। সংঘর্ষের মধ্যে গত ১৮ জুলাই ঢাকার মধ্যবাড্ডা এলাকায় তার বাঁ পায়ে গুলি লেগেছে। পাটি ইতোমধ্যে অস্ত্রোপচার করে কেটে ফেলা হয়েছে। জাকির জানান, তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বিক্রয়কর্মী। তার দাবি , কাজ শেষে বাসায় ফেরার পথে পায়ে গুলি লাগে। বাকরুদ্ধ কণ্ঠে জানান, তিনি এখন পঙ্গু, হয়তো আর চাকরি করতে পারবেন না। পরিবারের বোঝা হয়ে গেছেন।
পঙ্গু হাসপাতালে এখনো ভর্তি আছেন প্রায় অর্ধশত ব্যক্তি। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীও রয়েছেন। শিশুও আছে কয়েকজন। গত ১৯ জুলাই বাড্ডা থেকে মুহিব্বুল্লাহ (৩৮) নামে এক ব্যক্তি আসেন বুকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায়। গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক বনানী শাখায় নামাজ পড়ান। তিনি নিজেকে পথচারী দাবি করেন। নীরব নামে একজন জানান, তিনি রিকশাচালক। সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে গেলে হঠাৎ গুলি এসে তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে বিদ্ধ হয়। আহতদের মধ্যে একজন মো: সিফাত (১৪)। মিরপুর পল্লবী মাজেদুল ইসলাম মডেল হাইস্কুলের অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থী। সে জানায়, গত ১৮ জুলাই রাত ৯টার দিকে মিরপুর-১০ নম্বর এলাকায় তার ডান পায়ে গুলি লাগে। বাবা মো: সিরাজ একটি বেসরকারি নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানের কর্মী। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, দুই সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে পল্লবীতে থাকেন। ঘটনার দিন ছেলে সিফাত এক বন্ধুর সঙ্গে মিরপুর-১০ নম্বরে গিয়েছিল। বাসায় ফেরার পথে রাস্তা পারাপারের সময় তার পায়ে গুলি লাগে।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com