বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, রাসুল সা. শ্রমিকের অধিকারকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। তাদের হকের ব্যাপারে বারবার সতর্ক করেছেন। শ্রমিকের সাথে সুসম্পর্ক রাখার জন্য উৎসাহিত করেছেন।
তিনি আজ রাজধানীর পল্টনের ফেনী সমিতি অডিটোরিয়ামে বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের উদ্যোগে কেন্দ্রীয় কার্যকরী পরিষদের অধিবেশন ও জেলা-মহানগরী সভাপতি সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন। ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি আ.ন.ম শামসুল ইসলামের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আতিকুর রহমানের সঞ্চালনায় এতে আরো উপস্থিত ছিলেন ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি অধ্যাপক হারুনুর রশিদ খান, গোলাম রব্বানী, লস্কর
মো. তসলিম, কবির আহমদ, মাস্টার শফিকুল আলম ও মনসুর রহমান প্রমুখ।
ডা. শফিকুর রহমান বলেন, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মানুষকে শ্রমিকের অধিকার লঙ্ঘন না করতে এবং তাদের সাথে ইনসাফপূর্ণ আচরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। রাসুল সা.-এর শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় সর্বোচ্চ সচেষ্ট ছিলেন। শ্রমিকদের কেন্দ্র করে অনেক শ্রমিক সংগঠন ও ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে উঠেছে। এই সংগঠনের নেতারা শ্রমিকদের কষ্ট ব্যাথা বেদনার খবর জানেন। কিন্তু গতানুগতিক ধারার শ্রমিকনেতারা শ্রমিকদের দুর্দশা কীভাবে দূর করতে হবে সে সম্পর্কে ওয়াকিফহাল নন। বরং শ্রমিকদের পুঁজি করে কীভাবে নিজেদের ভাগ্য বদলাতে হবে তা ভালো করে জানে। ফলে শ্রমজীবী মানুষরা প্রতি যুগে এই সমস্ত ট্রেড ইউনিয়ন ও নেতৃত্বের কাছে বারবার প্রতারিত হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। আল্লাহ মানবজাতিকে ন্যায় ও ইনসাফের বিধান দিয়েছেন তা যদি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রতি পালন করা হয় তাহলে শ্রমিকের দুঃখ ব্যাথা বেদনা দূর হবে। ইনসাফের মানদ-ের ওপর যার যার প্রাপ্যতা নিশ্চিত হবে।
তিনি বলেন, একজন শ্রমিক যখন দেখবে তার শ্রমের ন্যায্য মূল্যায়ন করা হয়েছে তখন শুধু দেহের শক্তি নয় মনের শক্তি যুক্ত হবে। এতে উৎপাদন ক্ষমতা বেড়ে যাবে। এতে কার্যত মালিকরা শ্রমিকদের থেকে বেশি লাভবান হবে। অন্যান্য ট্রেড ইউনিয়ন মালিক-শ্রমিকের সংঘাত লাগাতে চায়, আমরা এটা চাই না। মালিকরা উদ্যোক্তা না হলে শ্রমিকরা শ্রম খাটাবে কোথায়। আবার শ্রমিক না থাকলে কাকে দিয়ে উদ্যোগ বাস্তবায়ন করবে। আমরা মালিক-শ্রমিকের সুসম্পর্ক চাই। আমরা চাই মালিক-শ্রমিক কেউ কাকে ঠকাবে না। এখান থেকে সবাই আমরা উপকৃত হবো। এই স্লোগান বাস্তবায়ন করতে চাই। এই বাগান থেকে চারা গাছ উঠিয়ে সমাজের সব জায়গায় রোপন করতে চাই। আল্লাহ চাইলে এই ন্যায়ের বাগান তখন পরিপূর্ণ হবে। তখন বৈষম্য দূর হবে।
ডা. শফিকুর রহমান বলেন, আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। মানুষের প্রতি দয়া মায়া তার চেয়ে বেশি কারো হতে পারে না। অপরদিকে মানুষ সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে গড়ে উঠে। মানুষ তো নিজের প্রতি সুবিচার করতে পারে না। অপরের প্রতি মানবতা দেখাবে কী করে। আল্লাহ সামিউন বাছির। তিনি তার এই সিফাতের গুণে যা শুনেন এবং যা দেখেন এটি একমাত্র পরিপূর্ণ। সেই আল্লাহ মানবজাতির জন্য মুক্তির পরিপূর্ণ বিধান নিজে বলে দিয়েছেন। এর বাইরে যা আছে সব জোড়াতালি। সব গোঁজামিল। এবং কোনো কালেই ঐ সমস্ত বিধান মানুষকে কোনো ধরনের মুক্তির স্বাদ দিতে পারে নাই। বরঞ্চ মানবজাতিকে ধোঁকা দিয়েছে। প্রতারিত করেছে দফায় দফায়। কোনো দল ক্ষমতায় যাওয়ার আগে যখন কথা বলে তখন মানুষের মনে হবে আর দুঃখ বেদনা থাকবে না। যখন ক্ষমতায় চলে যায় তখন সব ভুলে যায়। তখন তারা বলে ঐ কথা তো আমরা যখন বিরোধী দলে ছিলাম তখনের কথা। এখন আমরা জাতির মালিক। জাতির সেবকরা যদি মালিক হয়ে যায় মানুষ তাহলে যাবে কোথায়।
আমরা শ্রমিক ময়দানে একটি বিপ্লব ঘটাতে চাই। এই বিপ্লবের জন্য প্রত্যেকটি কর্মীকে নিজের চিন্তা ও কর্মের জগতে আমূল পরিবর্তন তথা বিপ্লব ঘটাতে হবে। আমরা যদি নিজের মাঝে বিপ্লব ঘটাতে পারি তাহলে আমরা শ্রমিক অঙ্গনে প্রত্যাশিত বিপ্লব ঘটাতে পারব। আমরা হবো মর্যাদার অংশীদার। কিন্তু ঐ বিপ্লব যদি না ঘটে তাহলে এই সমাজে আমাদের কারো মর্যাদা থাকবে না। আমরা যে যেখানে যে অবস্থায় থাকি না কেনো সকলে অপদস্থ ও অপমানিত হবো। সকলে বারবার প্রতারিত ও বঞ্চিত হবে।
সভাপতির বক্তব্যে আ.ন.ম শামসুল ইসলাম বলেন, আদর্শিক রাষ্ট্র গঠনে শ্রম অঙ্গনের গুরুত্ব অপরিসীম। এদেশের ৭০ ভাগ মানুষ শ্রমিক। শ্রমিকদের অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো আদর্শ বাস্তবায়ন সম্ভব না। বরং শ্রমিকদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে আগামী বাংলাদেশ গঠিত হবে। যেখানে থাকবে না কোনো ধরনের বৈষম্য। মানুষের ওপর যুগ যুগ ধরে চলা অবিচার-নির্যাতনের অবসান ঘটবে। এদেশের শ্রমিক-জনতা সেই বাংলাদেশ গঠনের জন্য উন্মুখ হয়ে আছি।
সম্মেলনে নি¤েœাক্ত প্রস্তাবনা গৃহীত হয়েছে
১.আজকের এই সম্মেলন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শহিদ, ছাত্র, শ্রমিক জনতার আত্মার মাগফিরাত কামনা করছে এবং শোকসপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছে। আহত ও চিকিৎসাধীন ছাত্র, শ্রমিক-জনতার আরোগ্য কামনা করছি। সকল শহিদ পরিবারকে সরকার উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে এবং আহত সকল ছাত্র, শ্রমিক জনতার সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। আহতদের যথাযথ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে।
২.আজকের এই সম্মেলন মনে করে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নির্বিচারে গুলি করে গণহত্যা ও হাজার হাজার ছাত্র-জনতাকে আহত করা মানবতাবিরোধী অপরাধ। হত্যাকারীদের আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে বিচার করতে হবে।
৩.আজকের এই সম্মেলন চাল-ডাল, তৈলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে এবং দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসার জন্য সরকারের নিকট জোর দাবি জানাচ্ছে। আজকের এই সম্মেলন শ্রমিকদের জন্য রেশনিং ব্যবস্থা চালু করার জন্য সরকারের প্রতি জোর দাবি জানাচ্ছে।
৪.আজকের এই সম্মেলনে গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছে যে দেশের শ্রম শক্তির ৬৫ ভাগ কৃষি খাতে নিয়োজিত। কিন্তু দেশে এখনোও কাক্সিক্ষত কৃষি ভিত্তিক শিল্প কারখানা গড়ে না উঠার কারণে কৃষক পণ্যের নায্য মুল্য পায় না। ফলে তাদের আর্থিক অবস্থার কোন পরিবর্তন হচ্ছে না। এই সম্মেলন সরকারি ও বেসরকারিভাবে কৃষি ভিত্তিক শিল্প কারখানা গড়ে তোলার জন্য জোর দাবি জানাচ্ছে এবং কৃষক যাতে উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য পায় সেই জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে উৎপাদিত কৃষি পণ্য ক্রয়ের ব্যবস্থা রাখতে হবে। বন্ধকৃত সার কারখানা চালু করতে হবে।
৫.আজকের এই সম্মেলন হোটেল শ্রমিক ও দোকান কর্মচারীসহ ব্যক্তি মালিকানা শ্রমিক নির্বিশেষে বিরাজমান জীনযাত্রার ব্যয়ের নিরিখে জাতীয় ন্যূনতম মজুরি কাঠামো পুননির্ধারণের ও বাস্তবায়নের জোর দাবি জানাচ্ছে এবং পরিবহন রিকশা-ভ্যান, নির্মাণ, কৃষি, চাতাল, দর্জি ও তাঁত, স্টিল রি-রোলিং, ফার্নিচার, হকার্স, দোকান কর্মচারী, নৌ-পরিবহন ও করাতকল শ্রমিকসহ সর্বস্তরের শ্রমিকদের জন্য ট্রেড ভিত্তিক সমস্যাসমূহ চিহ্নিত করা ও সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছে।
৬.আজকের এই সম্মেলন গার্মেন্টস শ্রমিকদের সর্বনি¤œ মজুরি ১২,৫০০/- টাকা প্রত্যাখান করছে। গত বছর ন্যূনতম মজুরি আদায়ের আন্দোলনে নিহত শ্রমিকদের হত্যাকারীদের শাস্তি দাবি করছে। এবং গার্মেন্টস শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ২৩,০০০/- টাকা দাবি করছে।
৭.আজকের এই সম্মেলন বন্ধকৃত ২৫টি জুট মিলের শ্রমিক কর্মচারীদের যাবতীয় বকেয়া পাওনাদি অবিলম্বে পরিশোধ করার জোর দাবি জানাচ্ছে এবং বিএমআরই পদ্ধতিতে আধুনিকায়ন করে উক্ত ২৫টি জুট মিলসহ বন্ধকৃত সকল কল-কারখানা অবিলম্বে চালু করার জোর দাবি জানাচ্ছে।
৮.আজকের এই সম্মেলন সরকারি, বেসরকারি ও গার্মেন্টসসহ সকল শিল্প, কল-কারখানায় শ্রম আইন অনুযায়ী মহিলাদের প্রসূতিকালীন ছুটি ও ভাতা প্রদানসহ নারী শ্রমিকদের সন্তানের জন্য শিশু যত্মাগার স্থাপনের জন্য জোর দাবি জানাচ্ছে। ব্যক্তি মালিকানাধীন সকল মিল চালু করতে হবে। শ্রমিকদের সকল বকেয়া বেতন পরিশোধ করতে হবে। ৯.এই সম্মেলন আইএলও কনভেনশন মোতাবেক অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার ও ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে শ্রমিকদের নিয়োগপত্র প্রদান নিশ্চিত করার জোর দাবি জানাচ্ছে। ট্রেড ইউনিয়ন করা শ্রমিকদের অধিকার। কিন্তু শ্রম অধিদপ্তর শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। তাই আজকের সম্মেলন শ্রম অধিদপ্তরের নিকট ট্রেড ইউনিয়ন করার ক্ষেত্রে হয়রানি না করে সহযোগিতা করার জোর দাবি জানাচ্ছে।
১০.এই সম্মেলন গভীর উদ্বেগের সাথে বলছে যে, দীর্ঘদিন থেকে পরিবহন সেক্টরে স্বৈরাচার ও অসৎ নেতৃত্ব চেপে বসেছিল এবং শ্রমিকদের উপর নানা অত্যাচার, নির্যাতন করেছে। তার জন্য সুস্থ তদন্ত কমিশন গঠন করে অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে হবে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পরিবহন সেক্টরে সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে পরিবহন সেক্টরে নৈরাজ্য, চাঁদাবাজি বন্ধ করে পরিবহন শ্রমিকদের দুর্দশা লাগব করতে হবে। তাই এই সম্মেলন পরিবহন শ্রমিকদের নিয়োগপত্র প্রদান, চাঁদাবাজি ও হয়রানি বন্ধ করার জোর দাবি জানাচ্ছে।
১১.আজকের এই সম্মেলন মনে করে যে, বাংলাদেশ রেলওয়ে একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন অগ্রগতি মানে দেশের উন্নতি। তাই বাংলাদেশ রেলওয়েকে দ্রুত আধুনিকায়নের মাধ্যমে দেশের ৬৪ জেলায় রেল লাইন বাস্তবায়ন করে রেলওয়ে নেটওয়ার্কের আওতায় আনতে হবে। রেলওয়ে অপরাধ ও দুর্নীতি রোধ টেকনিক্যাল নিরীক্ষা কমিটি গঠন করতে হবে।
১২.এ সম্মেলন গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছে যে, দেশ গঠনে শ্রমিকদের অবদান থাকার পরও দেশ পরিচালনায় শ্রমিকদের উপেক্ষা করা হয়। এই সম্মেলন দাবি করছে রাষ্ট্র পরিচালনায় শ্রমিকদেরকে অংশীদারিত্ব দিতে হবে এবং সংসদ নির্বাচনে শ্রমিকদের কাজ ৩০টি সংরক্ষিত আসন নিশ্চিত করতে হবে।
১৩.আজকের এই সম্মেলন মনে করে যে, শ্রমজীবী মানুষের প্রকৃত সমস্যার সমাধান কুরআন, সুন্নাহর আইন প্রতিষ্ঠা ছাড়া সম্ভব নয়। তাই ইসলামী শ্রমনীতি প্রতিষ্ঠার লক্ষে শ্রমজীবী মানুষসহ সকল স্তরের শ্রমিক জনতাকে বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের পতাকাতলে শামিল হওয়ার জোর দাবি জানাচ্ছে।
প্রেস বিজ্ঞপ্তি