রবিবার, ২৭ অক্টোবর ২০২৪, ০৭:০৩ পূর্বাহ্ন

অর্থনীতিতে মহানবী সা: আদর্শ-৩

ড. ইকবাল কবীর মোহন
  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ২৪ অক্টোবর, ২০২৪

(গত দিনের পর)
ক. জাকাত : ইসলামী রাষ্ট্রের রাজস্বের প্রধান উৎস জাকাত। নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিকের ওপর জাকাত আদায় করা ফরজ করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে ও সৎকর্ম করে এবং সালাত কায়েম করে ও জাকাত প্রদান করে, তাদের প্রতিপালকের কাছে রয়েছে পুরস্কার।-(সূরা বাকারা)। জাকাতের আটটি খাতের মধ্যে ছয়টি খাতই দারিদ্র্য দূরীকরণে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে। নবীযুগে, খলিফাদের আমলে এবং মুসলিম শাসনের সময় দেশ ও সমাজের দরিদ্র মানুষের কল্যাণে রাষ্ট্রীয়ভাবে জাকাতের অর্থ ব্যয় করা হতো। কেন্দ্রীয় কোষাগার বা বায়তুলমালে জাকাতের অর্থ জমা হতো এবং তা প্রয়োজনমতো নির্দিষ্ট খাতে বিলি-বণ্টন করা হতো। মানুষের (বিশেষ করে দরিদ্র মানুষের) অর্থনৈতিক চাহিদা মেটাতে জাকাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
খ. উশর : জমির ফসলের জাকাত হলো উশর। মুসলমানদের অধিকারভুক্ত জমিতে উৎপন্ন ফসলের জাকাতই মূলত উশর। বৃষ্টিতে সিক্ত ভূমি হতে ফসলের এক-দশমাংশ ও যেসব জমিতে অন্যভাবে সেচ দিয়ে জমি সিক্ত করতে হয়, তা থেকে উৎপন্ন ফসলের বিশ ভাগের একভাগ ফসল উশর হিসেবে আদায় করা হতো। উশর সম্পর্কে আল-কুরআনে বলা হয়েছে, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা যা উপার্জন করো এবং আমি যা ভূমি হতে তোমাদের উৎপাদন করে দিই, তার মধ্যে যা উৎকৃষ্ট, তা ব্যয় কর এবং এর নিকৃষ্ট বস্তু ব্যয়ের সংকল্প কর না, অথচ তোমরা তা গ্রহণ করার নও, যদি না তোমরা চোখ বন্ধ করে থাক। তবে জেনে রাখ যে, আল্লাহ অভাবমুক্ত, প্রশংসিত।’-(সূরা বাকারা : ২৬৭)। প্রসঙ্গত মদিনা রাষ্ট্রের প্রধান উৎপন্নদ্রব্য ছিল খেজুর। খেজুর মৌসুমে খেজুরের উশর আদায় করে কেন্দ্রীয়ভাবে জমা করা হতো।
গ. সাদাকাতুল ফিতর : রমজান মাসের সিয়াম সাধনার পর ঈদের দিন বিত্তশালীদের ওপর দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য নির্দিষ্টহারে যে বিশেষ দানের নির্দেশ রয়েছে, তাকে ‘সাদাকাতুল ফিতর’ বলে। জাকাতের ক্ষেত্র সীমিত হলেও সাদাকাতুল ফিতরের ক্ষেত্র অনেকটা বিস্তৃত। প্রত্যেক বিত্তবান ব্যক্তিকে তার নিজের, পরিবারবর্গ ও পোষ্যদের পক্ষ থেকে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করতে হয়। সাদাকাতুল ফিতর ব্যক্তিগত দান হলেও মদিনা রাষ্ট্রে তা আদায় করে দরিদ্র মানুষের মাঝে বণ্টনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সাদাকাতুল ফিতর আদায়ের প্রতি গুরুত্বারোপ করে মহানবী সা: মুসলিম দাস ও স্বাধীন ব্যক্তি, নর ও নারী এবং বালক ও বৃদ্ধের ওপর সাদাকাতুল ফিতর এক সা (প্রায় সাড়ে তিন কেজি) খেজুর কিংবা এক সা যব নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। তিনি এটাও নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, লোকেরা (ঈদের) নামাজে যাওয়ার আগেই যেন তা আদায় করে দেয়।
ঘ, ওয়াকফ : মানবকল্যাণের লক্ষ্যে প্রবর্তিত ইসলামের এক অনন্য বিধানের নাম ওয়াকফ। ইসলামী পরিভাষায় কোনো বস্তু বা সম্পদ আল্লাহর মালিকানায় রেখে তার উৎপাদন বা উপযোগকে দরিদ্রদের মাঝে কিংবা যেকোনো জনহিতকর খাতে দান করাকে ওয়াকফ বলা হয়। এটি হচ্ছে সমাজসেবা ও জনকল্যাণমূলক একটি স্থায়ী ব্যবস্থা। ইমাম আবু হানিফার (রহ) মতে, ‘কোনো বস্তুকে ওয়াকফকারীর মালিকানায় রেখে এর উৎপাদন ও উপযোগকে গরিবদের মধ্যে কিংবা যেকোনো কল্যাণকর খাতে দান করাকে ওয়াকফ বলে।’ দাতার ইনতেকালের পরও তার ওয়াকফ মানবকল্যাণে বহাল থাকে। এ ব্যাপারে মহানবী সা: বলেন, ‘মানুষের ইন্তিকালের পর তিনটি আমল ছাড়া বাকি সব বন্ধ হয়ে যায়। তিনটি আমল হলো, (১) অব্যাহত দান বা সাদাকায়ে জারিয়া, (২) কল্যাণধর্মী ইলম (জ্ঞান) বা এমন ইলম যা দ্বারা মানুষ উপকৃত হয় এবং (৩) এমন নেক সন্তান, যে তার জন্য দোয়া করে।’- (সহিহ মুসলিম)। ইসলামের সূচনালগ্ন থেকে অদ্যাবধি মুসলিম জাতি আল্লাহর সন্তুষ্টি বিধানের লক্ষ্যে এই সুন্দরতম ব্যবস্থা অনুসরণ করে আসছে। স্বয়ং মহানবী সা: ওয়াকফ করার ব্যাপারে উৎসাহিত করেছেন। খোলাফায়ে রাশেদাসহ অধিকাংশ সাহাবা থেকে ওয়াকফ করার বিষয়ে প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রখ্যাত সাহাবি ইবনে উমর (রা) বলেন, খায়বর যুদ্ধে একখ- জমি লাভ করেছিলেন। তিনি উক্ত জমি সম্পর্কে মহানবী সা: কাছে জানতে চান যে, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমি খায়বরে একখ- জমি লাভ করেছি, যা অপেক্ষা উত্তম জমি আর পাইনি। আপনি আমাকে এ ব্যাপারে কী পরামর্শ দেন?’ জবাবে মহানবী সা: বলেন, ‘তুমি চাইলে এর মালিকানা নিজের কাছে রেখে দেবে এবং উৎপাদিত পণ্য সাদাকা করে দেবে।’ তখন উমর (রা) তা সাদাকা করে দিয়ে বললেন, ‘এই জমি বিক্রি করা যাবে না, দান করা যাবে না, কেউ এর উত্তরাধিকারী হবে না, বরং এর মাধ্যমে গরিব, নিকটাত্মীয়, দাসমুক্তিকরণ, আল্লাহর পথে, মুসাফিরদের জন্য এবং অতিথি সেবায় ব্যয় করা যাবে। এই সম্পদ যিনি তত্ত্বাবধান করবেন, তিনি ন্যায়সঙ্গতভাবে তা থেকে পারিশ্রমিক নিতে পারবেন। কিন্তু মূলধন সরবরাহকারী (মালিক) হিসেবে খেতে পারবেন না।’ (সহিহ বুখারি)। পরবর্তীকালে এসব সম্পদের আয় বায়তুলমালে জমা হতো। ইসলামের ইতিহাসে প্রথম ওয়াকফ হলো ‘মসজিদুল কোবা’। আর দ্বিতীয় উদাহরণ হলো ‘মসজিদে নববী’।
ঙ. আল-গণিমত : গণিমত বলতে যুদ্ধলব্ধ সম্পদ বোঝায়। পারিভাষিক অর্থে মুসলিমদের কাছে পরাজিত অমুসলিমদের কাছ থেকে যেসব অস্ত্রশস্ত্র, স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ হস্তগত করা হতো, তা সবই গণিমতের সম্পদ হিসেবে গণ্য হতো। মদিনা রাষ্ট্রের সম্প্রসারণকালে এটি ছিল রাষ্ট্রীয় রাজস্বের উল্লেখযোগ্য উৎস। যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রু পরিত্যক্ত যেসব সম্পদ হস্তগত হতো, সেগুলো একত্র করে পাঁচ ভাগের এক ভাগ মহানবী সা: রাষ্ট্রের জন্য রেখে অবশিষ্ট চার ভাগ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সৈন্যদের মাঝে দায়িত্ব ও পদমর্যাদা অনুযায়ী বণ্টন করে দিতেন। গণিমতের মাল তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব পালন করেন সাহাবি মুআইকিব ইবনে আবু ফাতিমা (রা)। মহানবীর সা: জীবদ্দশায় সেনা সদস্যদের সুনির্দিষ্ট বেতন-ভাতা না থাকায় গণিমতসামগ্রী প্রদানের মাধ্যমে কার্যত বেতন-ভাতা দেয়া হতো। এর মাধ্যমে মুসলিম সৈনিকরা প্রতিরক্ষা প্রস্তুতি নিতে পারতেন এবং জীবন ধারণের প্রয়োজনীয় ব্যয়ভার বহনের সুযোগ লাভ করতেন। এ প্রসঙ্গে কুরআনে বলা হয়েছে- ‘আরও জেনে রাখ, যুদ্ধে যা তোমরা লাভ কর তার এক-পঞ্চমাংশ আল্লাহর রাসূলের, রাসূলের স্বজনদের, এতিমদের, মিসকিনদের এবং পথচারীদের, যদি তোমরা আল্লাহতে ঈমান রাখ (সূরা আনফাল : ৪১)। মহানবী সা: তাঁর জীবদ্দশায় গণিমতের মালের যে অংশ গ্রহণ করতেন, তা তিনি ব্যক্তিগতভাবে না নিয়ে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে গ্রহণ করতেন এবং তা জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করতেন।
চ. আল-ফাই : মহানবী সা: প্রবর্তিত রাষ্ট্রের আয়ের অন্যতম উৎস ছিল আল-ফাই। মুসলিম সেনাবাহিনীর প্রতি ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে অমুসলিমরা তাদের জমিজমা, বাড়িঘর, ধন-সম্পদ ইত্যাদি ফেলে পালিয়ে যেত এবং তা কার্যত যুদ্ধ-বিগ্রহ ছাড়াই মুসলমানদের দখলে এসে যেত। এরূপ সম্পদকে আল-ফাই বলা হয়। আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ তাদের (ইহুদিদের) কাছ থেকে তাঁর রাসূলকে যে ফাই দিয়েছেন, তার জন্য তোমরা ঘোড়া কিংবা উটে চড়ে যুদ্ধ করোনি। আল্লাহ তো যার ওপর ইচ্ছা তার রাসূলকে কর্তৃত্ব দান করেন; আল্লাহ সব বিষয়ে সর্বশক্তিমান।’-(সূরা হাশর : ৬)। ফাই গণিমতের সম্পদের মতো নয়। গণিমতের মতো তা সৈনিকদের মধ্যে বণ্টন করা যায় না।
ছ. মুক্তিপণ : যুদ্ধে মুসলিমদের বিজয় অর্জনের পর প্রায়ই অনেকে যুদ্ধবন্দী হয়ে আসত। এদের মধ্যকার খুব কমসংখ্যক লোককে দাস বানানো হতো। মহানবী সা: কখনো কোনো কিছুর বিনিময় ছাড়া আবার কখনো মুক্তিপণ গ্রহণপূর্বক যুদ্ধবন্দীদের মুক্তি দিতেন। যুদ্ধবন্দীদের তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা নিয়োজিত থাকতেন। ইসলামের প্রথম যুদ্ধ বদরে অনেক শত্রুকে বন্দী করা হয়। অবশেষে মুক্তিপণ আদায় করে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। মুক্তিপণের এই অর্থ বা সম্পদ বায়তুলমালে জমা দেয়া হয়। মুক্তিপণ মদিনা রাষ্ট্রের বায়তুলমালের আয়ের অন্যতম উৎস ছিল।
জ. উপহারসামগ্রী : মহানবী সা: মদিনা রাষ্ট্রের প্রধান ছিলেন। তাঁর সম্মানে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা মদিনায় নানারকম উপহারসামগ্রী পাঠাতেন। ওই উপহারসামগ্রী মহানবী সা: নিজে ব্যবহার করতেন না। তিনি তা বায়তুলমালে জমা করে দিতেন। ফলে উপহারসামগ্রী রাজস্বের একটি উৎস ছিল। মুসলিম খলিফারাও তাদের কাছে আসা উপহারসামগ্রী বায়তুলমালে জমা করে দিতেন। (চলবে)




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com