ধরুন, এই মাত্র বসের ঝাড়ি খেয়েছেন। তাঁর কড়া আদেশ, অফিসের রিপোর্ট এক্ষুনি ই–মেইল করতে হবে। হাতে আছে মাত্র এক মিনিট। পিডিএফ প্রস্তুত করে যে মুহূর্তে জমা দেওয়ার বাটনে ক্লিক করবেন, কম্পিউটার বা মোবাইল ফোনের পর্দায় ভেসে উঠল, ‘আই অ্যাম নট আ রোবট’। পাশে টিক চিহ্ন দেওয়ার ঘর। ঝামেলার এখানেই শেষ নয়। পরের ধাপে এল বেশ কিছু ছবি। গুগল বলল, মনোযোগ দিয়ে দেখে বলুন তো ভাই, এখানে কয়টা ছবিতে ট্রাফিক লাইট আছে? দেখেশুনে নির্বাচন করুন। এ অবস্থায় আপনি হয়তো বিরক্তই হবেন। ঠিক এ রকম পরিস্থিতিতে না পড়লেও নিজেকে মানুষ হিসেবে প্রমাণ করার এই পরীক্ষা দিতে হয়নি, ইন্টারনেটের এমন ব্যবহারকারী খুব বেশি নেই। তাও এক-দুবার নয়, বহুবার। নিজেকে মানুষ প্রমাণের এই পরীক্ষার আক্ষরিক ইংরেজি নাম ক্যাপচা, যার পূর্ণরূপ ‘কমপ্লিটলি অটোমেটেড পাবলিক টুরিং টেস্ট টু টেল কম্পিউটারস অ্যান্ড হিউম্যানস অ্যাপার্ট’। বাংলা করলে দাঁড়ায়, মানুষ ও কম্পিউটারকে আলাদা করার সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় টুরিং পরীক্ষা।
এই টুরিং পরীক্ষা আবার কী?
কোনো যন্ত্র বা প্রযুক্তি বা কম্পিউটার প্রোগ্রাম মানুষের সমান বুদ্ধিমান কি না, তা জানতেই এ পরীক্ষা করা হয়। কম্পিউটার বিজ্ঞানী অ্যালান টুরিং (১৯১২–১৯৫৪) প্রথম কম্পিউটারের বুদ্ধিমত্তাকে মানুষের সমান হওয়ার ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। তাই তাঁর নাম অনুসারেই এই পরীক্ষার নাম টুরিং টেস্ট।
ক্যাপচা যেভাবে এল
২০০০ সালের কথা। মার্কিন ওয়েব সেবা কোম্পানি ইয়াহু তাদের সিস্টেমে একটা সমস্যা লক্ষ করে। কিছু অসাধু মানুষ কম্পিউটার প্রোগ্রাম লেখার মাধ্যমে অসংখ্য ই–মেইল অ্যাড্রেস সংগ্রহ করছে। স্প্যাম-মেইল পাঠিয়ে গ্রাহকদের ব্যক্তিগত তথ্য হাতিয়ে নিচ্ছে। তৎকালীন সবচেয়ে বড় ইন্টারনেট কোম্পানি ইয়াহু যোগাযোগ করে যুক্তরাষ্ট্রের কার্নেগি মেলন ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগের সঙ্গে। এ বিষয়ে গবেষণা শুরু হয়। এই গবেষক দলের অন্যতম সদস্য, পিএইচডি শিক্ষার্থী লুইস ভন অন। তিনি খেয়াল করে দেখেন, কিছুটা বিকৃত ছবি বা অক্ষর কম্পিউটারের পক্ষে শনাক্ত করা কঠিন। অর্থাৎ একটি প্রশ্ন করলেই হ্যাকার নিয়ন্ত্রিত বটকে (স্বয়ংক্রিয় সফটওয়্যার অ্যাপ্লিকেশন) আলাদা করা সম্ভব হবে। পরে তাঁর পিএইচডি সুপারভাইজার ও আরও কিছু শিক্ষার্থীর প্রচেষ্টায় প্রথমবারের মতো ‘ক্যাপচা’ তৈরি করা হয়। ২০০১ সালের দিকে ইয়াহু তাদের গ্রাহকদের সেবায় এটি যুক্ত করে। জানিয়ে রাখা দরকার, লুইস ভনের আগেও অর্থাৎ নব্বইয়ের দশকের শেষ ভাগেই এ ধরনের কিছু গবেষণা শুরু হয়েছিল।
তখনকার ক্যাপচা অবশ্য বর্তমানের মতো ছিল না। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের একটা ছবি দেখানো হতো। লেখা থাকত কিছু ইংরেজি বর্ণ ও সংখ্যা। লম্বা, বেঁটে, ছোট, বড়; নানাভাবে বিকৃত করে। সেটা দেখে নিচের ফাঁকা ঘরে অবিকল ওই বর্ণ ও সংখ্যাগুলো লিখতে হতো।
এটি কিছুটা বিরক্তকর ও সময়সাপেক্ষ কাজ। এ ছাড়া অনেকেই বিকৃত ছবি বুঝতে না পারার অভিযোগ করতে থাকেন। তাই আরও সহজ কিছুর কথা ভাবতে থাকেন লুইস। ২০০৭ সালে তিনি রিক্যাপচা তৈরি করেন। এখানে এলোমেলো বিকৃত অক্ষরের পরিবর্তে তিনি ব্যবহার করেন দুটি শব্দ। একটি সহজে বোঝা যায়, আরেকটি একটু কঠিন বা কিছুটা বিকৃত শব্দের ছবি। এখানেও ছবি দেখে নিচে লিখতে হবে। মজার ব্যাপার হলো, আপনি শুধু লিখছেনই না, ডিজিটাল বইকে উন্নত করতেও সাহায্য করছেন। বুঝিয়ে বলি। মনে করুন, একটি অনেক পুরোনো বই স্ক্যান করে ডিজিটাল বই তৈরি করা হবে। তবে সমস্যা হলো—ফন্ট, কালি, পৃষ্ঠার বাজে অবস্থাসহ নানা কারণে কম্পিউটার কিছু শব্দ বুঝতে পারে না। রিক্যাপচাতে এমন সব ছবি দেওয়া হয়। ফলে অধিকাংশ মানুষ নির্ধারিত একটা শব্দকে একইভাবে লিখলে সেটা ডিজিটাল লাইব্রেরির বইয়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের পত্রিকা দ্য নিউইয়র্ক টাইমস তাদের ১৫০ বছরের আর্কাইভ সংরক্ষণেও রিক্যাপচা ব্যবহার করেছিল।
২০০৯ সালে রিক্যাপচা কিনে নেয় গুগল। এর পর থেকে রিক্যাপচার অনেকগুলো সংস্করণ এনেছে এই টেক জায়ান্ট। এর মধ্যে ‘আই অ্যাম নট আ রোবট’-এ টিক চিহ্ন দেওয়ার পরে ছবির পাজল মেলানো, মানব ব্যবহার পর্যবেক্ষণ করে সরাসরি পরের ধাপে যেতে দেওয়া, অডিও শুনিয়ে যাচাই ইত্যাদি। এই লুইস ভনই ফ্রি–তে ভাষা শেখার মাধ্যম ডুয়োলিংগোর প্রতিষ্ঠাতা। ( উৎস: দৈনিক প্রথমআলো, লেখক: মো. জান্নাতুল নাঈম) সূত্র: বিবিসি, সিএনবিসি