বাবা অথবা মায়ের মৃত্যুর পর যেন সম্পদ বণ্টন নিয়ে সন্তানদের ভেতরে সংকট তৈরি না হয় এ জন্য কখনো কখনো তাঁরা তাঁদের জীবদ্দশায় সম্পদ বণ্টন করে দিতে চান। আবার কখনো অস্থাবর সম্পদ বণ্টন করা হয় এবং স্থাবর সম্পদ রেখে যাওয়া হয়। প্রশ্ন হলো— জীবদ্দশায় সন্তানদের ভেতরে সম্পদ বণ্টন করতে চাইলে করণীয় কী? এ ক্ষেত্রে সন্তানদের সন্তুষ্টির কোনো শর্ত আছে কি?
উত্তর হলো, প্রত্যেক মানুষ তাঁর জীবদ্দশায় নিজের সহায়-সম্পত্তিতে পরিপূর্ণ মালিক থাকে এবং পূর্ণাঙ্গ কর্তৃত্বের অধিকারী হয়। ফলে সে যেকোনো বৈধ কাজে তা ব্যয় করার পূর্ণ অধিকার ও স্বাধীনতা রাখে।
সম্পত্তির মালিক যদি তাঁর জীবদ্দশায় সন্তানদের ভেতরে সন্তুষ্টির সঙ্গে সম্পদ বণ্টন করতে চান, তবে তিনি তা করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে ওয়ারিশদের সন্তুষ্টি থাকা উত্তম, তবে বণ্টন শুদ্ধ হওয়া শর্ত নয়। বিপরীতে সম্পত্তির অধিকারী ব্যক্তির সন্তুষ্টি থাকা জরুরি। জীবদ্দশায় সন্তান বা ওয়ারিশদের ভেতর সম্পত্তি বণ্টন করাকে উপহার বলা হয়।
আর সন্তানদের ভেতর যখন কোনো উপহার বণ্টন করা হয়, তখন তাতে সমতা রক্ষা করা জরুরি। কেননা রাসুলুল্লাহ (সা.) উপহারে সমতা রক্ষার নির্দেশ দিয়েছেন। নোমান ইবনে বাশির (রা.) বলেন, আমার পিতা আমাকে কিছু দান করেছিলেন। তখন (আমার মা) আমরা বিনতে রাওয়াহা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে সাক্ষী রাখা ছাড়া সম্মত নই।
তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এলেন এবং বললেন, আমরা বিনতে রাওয়াহার গর্ভজাত আমার পুত্রকে কিছু দান করেছি। হে আল্লাহর রাসুল! আপনাকে সাক্ষী রাখার জন্য সে আমাকে বলেছে। তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার সব ছেলেকেই কি এ রকম করেছ? তিনি বললেন, না। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, তবে আল্লাহকে ভয় করো এবং আপন সন্তানদের মধ্যে সমতা রক্ষা করো। নোমান (রা.) বলেন, অতঃপর তিনি ফিরে গেলেন এবং তাঁর দান ফিরিয়ে নিলেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২৫৮৭)
এ ক্ষেত্রে উত্তম হলো, ব্যক্তি নিজের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ রেখে দেবে এবং তাঁর স্ত্রীর জন্য এক-অষ্টাংশ সম্পদ নির্ধারণ করবে। অতঃপর অবশিষ্ট সম্পদ সন্তানদের ভেতর সমতার ভিত্তিতে বণ্টন করবে। এ ক্ষেত্রে পিতার জন্য সন্তানদের অবস্থা বিবেচনা করে বণ্টনে তারতম্য করার অবকাশ আছে। যেমন—কোনো এক ছেলে পিতার সেবাযতœ করেছে, সে দ্বিনদারিতে এগিয়ে অথবা সে ব্যবসা ও কাজে অংশগ্রহণ করে সম্পদ বৃদ্ধিতে অবদান রেখেছে ইত্যাদি। একইভাবে ভাই-বোন ও ওয়ারিশরা যদি পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে সম্পদ বণ্টনের কোনো প্রস্তাব দেয় এবং পিতাও তাতে সম্মত হয়, তবে তারতম্য থাকলেও বণ্টন করা বৈধ হবে।
ইমাম শামি (রহ.) বলেন, ‘উপহার (বা দান) ও ওয়াকফের ক্ষেত্রে সমতা সন্তানদের অধিকার। এ ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষ সমান। কেননা তাঁরা (উল্লিখিত হাদিসের আলোকে ফকিহ আলেমরা) জীবদ্দশায় উপহারের ক্ষেত্রে সন্তানদের ভেতর সমতা নিশ্চিত করার বিধান বর্ণনা করেছেন।’ (ফাতাওয়ায়ে শামি : ৪/৪৪৪)
মনে রাখতে হবে, নিছক কোনো সন্তানকে বঞ্চিত করা এবং অন্যের অংশ বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য জীবদ্দশায় সম্পদ বণ্টন করা উচিত নয়। জীবদ্দশায় সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে সন্তান বা ওয়ারিশকে মালিকানা হস্তান্তর করা জরুরি। মালিকানা হস্তান্তর না করে কেবল মৌখিক ঘোষণায় দান পূর্ণ হয় না।
ফাতাওয়ায়ে কাজিখানে বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি তার সুস্থতার সময় সন্তানদের কিছু দান করতে চান এবং তিনি একজনের ওপর অন্যজনকে প্রাধান্য (অংশ বেশি) দিতে চান, তবে এ ক্ষেত্রে ইমাম আবু হানিফা (রহ.) বলেন, দ্বিনের ক্ষেত্রে অগ্রগামী হওয়ার কারণে প্রাধান্য দিলে সমস্যা নেই। আর যদি দ্বিনি মানদ-ে সবাই সমান হয় তবে মাকরুহ হবে। আর আবু ইউসুফ (রহ.) বলেন, কারো ক্ষতি করার ইচ্ছা না করলে তারতম্যে কোনো সমস্যা নেই। নতুবা ব্যক্তি সব সন্তানের ভেতর সমতা নিশ্চিত করবে। এটাই হানাফি মাজহাবের ফাতাওয়া।(ফাতাওয়ায়ে শামি : ৪/৪৪৪) আল্লাহ সবাইকে সঠিকভাবে দ্বিন পালনের তাওফিক দিন। আমিন।