সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলা, বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ উপজেলা। ২০২৪ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী প্রায় চার লক্ষ মানুষের বাস। বিশিষ্টজনদের মতে, বাস্তবে এ সংখ্যা আরও বেশি। এত বড় জনসংখ্যার বিপরীতে শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সই একমাত্র সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান, যা ৫০ শয্যা বিশিষ্ট। বিশাল জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবায় এ হাসপাতালের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হলেও এর সামর্থ্য ও অবকাঠামোগত দুর্বলতা মারাত্মক সমস্যা সৃষ্টি করছে। বিগত কয়েক দশকে শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে কার্যত অকার্যকর অবস্থায় ফেলা হয়েছে। হাসপাতালের এক্স-রে মেশিন দীর্ঘদিন অচল অবস্থায় পড়ে আছে। আল্ট্রাসনো মেশিন চালু হলেও এটি পরিত্যক্ত কোয়ার্টারে অযতেœ পড়ে আছে। অ্যানেস্থেসিয়া ডাক্তারের অভাবে অপারেশন থিয়েটারের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। অপারেশন থিয়েটারের এসি মেশিনও নষ্ট। অন্যদিকে, হাসপাতালের প্যাথলজি রুম রোগীদের জন্য প্রায় অপ্রাপ্য। ইসিজি মেশিনসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি পুরোনো মডেলের হওয়ায় সেবার মান নি¤œমুখী। রোগীর তুলনায় বেডের অভাব এতটাই প্রকট যে অনেককেই মেঝেতে সেবা নিতে হয়। এছাড়া হাসপাতালের ড্রেনেজ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, ফলে অল্প বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতা এবং দুর্গন্ধের সৃষ্টি হয়। সরকারি সেবার দুর্বলতার সুযোগে উপজেলার বিভিন্ন স্থানে গজিয়ে উঠেছে মানহীন বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এগুলোর অধিকাংশই তদারকি ছাড়া চলছে। এতে রোগীদের স্বাস্থ্যসেবা ব্যয় বেড়েছে, কিন্তু সেবার মান বাড়েনি। অভিযোগ রয়েছে, সরকারি হাসপাতালের অনেক ডাক্তার নিজ কর্মস্থলের চেয়ে এসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বেশি সময় দেন। রোগীদের অপ্রয়োজনীয় টেস্ট করাতে বাধ্য করার অভিযোগও রয়েছে। একই টেস্টের রিপোর্ট বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ভিন্ন হওয়া নিয়ে রোগীরা চরম ভোগান্তির শিকার। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প্রধান সমস্যা হলো জনবল ও অবকাঠামোগত ঘাটতি। হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় কম। টয়লেট সুবিধা অপ্রতুল, ফলে রোগী ও তাদের স্বজনরা দুর্ভোগে পড়ছেন। তিন বেলা খাবারের জন্য রোগীপ্রতি বরাদ্দ মাত্র ১২৫ টাকা, যা অমানবিক বলে মন্তব্য করেছেন হাসপাতালের চিকিৎসকরা। ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর, সরকার স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক সংস্কার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এরই অংশ হিসেবে স্বাস্থ্য উপদেষ্টার একান্ত সহকারী ডা. মাহমুদুল হাসান গত ১১ই জানুয়ারি শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স পরিদর্শন করেন। তিনি হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগ ঘুরে দেখার পর সাংবাদিকদের বলেন, “হাসপাতালের সার্বিক অবস্থা ভালো নয়। চার লক্ষ মানুষের তুলনায় ডাক্তারের সংখ্যা একেবারে কম। যত দ্রুত সম্ভব বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, প্রয়োজনীয় ওষুধ ও যন্ত্রপাতি সরবরাহের চেষ্টা করছি। ডাক্তারদের স্থানীয় এলাকায় কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করার বিষয়ে উদ্যোগ নেয়া হবে।” ডা. মাহমুদুল হাসান শ্যামনগরবাসীর কাছে ডাক্তারদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানান এবং হাসপাতালের সার্বিক উন্নয়নে সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার আশ্বাস দেন। শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সংকট শুধু এই উপজেলার নয়, বরং দেশের স্বাস্থ্য খাতের সামগ্রিক সমস্যারই প্রতিফলন। স্বাস্থ্য খাতে সুশাসন, পর্যাপ্ত বরাদ্দ, এবং সঠিক তদারকি নিশ্চিত করতে পারলেই এ সংকটের সমাধান সম্ভব। শ্যামনগরের চার লক্ষ মানুষের কাছে উন্নত স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছানো এখন সময়ের দাবি।