মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলাটা আজও অনেকের কাছেই অস্বস্তিকর। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে, ততই আমরা বুঝতে পারছি যে মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখাটা শারীরিক স্বাস্থ্যের মতোই জরুরি। বিষণ্ণতা, উদ্বেগ, পিটিএসডি বা পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার —এই শব্দগুলো আজকাল প্রায়শই শোনা যায়। কিন্তু এগুলোর গভীরতা ঠিক কতটা হতে পারে? কীভাবে বুঝবেন কেউ মানসিকভাবে সংকটে আছে? কখন পেশাদার সাহায্য নেবেন? আর পরিবার হিসেবে কীভাবে সাহায্য করবেন? চলুন জেনে নেওয়া যাক।
যে ধরনের লক্ষণের দিকে নজর দেবেন-
মানসিক সমস্যার লক্ষণগুলো অনেক সময় এতটাই সাধারণ হয় যে আমরা তা অবহেলা করি। কিন্তু এই ছোট ছোট লক্ষণই বিষণ্ণতা বা ডিপ্রেশন, উদ্বেগ বা অ্যাংজাইটি ও পিটিএসডির মতো বড় সমস্যার ইঙ্গিত দেয়। তাই নিজের ও কাছের মানুষদের আচরণগত পরিবর্তনের দিকে খেয়াল করুন। যে লক্ষণগুলো চিন্তার কারণ হতে পারে-
সব সময় ক্লান্তি বা শক্তির অভাব বোধ করা।
আগে খুব ভালো লাগত এমন বিষয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলা।
ঘুমের সমস্যা—হয় একেবারে ঘুম আসে না, নয়তো সারাদিন ঘুমিয়ে কাটানো বা ঝিমুনি।
হঠাৎ ক্ষুধা কমে যাওয়া বা বেড়ে যাওয়া।
নিজেকে মূল্যহীন মনে হওয়া।
আত্মহত্যা বা নিজের ক্ষতি করার কথা ভাবা।
আপাতদৃষ্টিতে ছোট বিষয় নিয়ে অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা হওয়া।
হঠাৎ হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া, ঘাম হওয়া, বা শ্বাসকষ্ট হওয়া। ডাক্তারি ভাষায় একে ক্স প্যানিক অ্যাটাক বলা হয়ে থাকে।
কোনো কিছুতে মনোযোগ দিতে অসুবিধা হওয়া।
সব সময় এক ধরনের অস্বস্তি ও ভয় কাজ করা।
অতীতের কোনো দুঃসহ স্মৃতি বারবার মনে আসা বা দুঃস্বপ্ন দেখা।
সেই ঘটনার কথা মনে হলেই ভয় বা আতঙ্কে কেঁপে ওঠা।
মানসিক আঘাতের কথা এড়িয়ে চলা বা কোনো কিছুতে অনুভূতিহীন হয়ে যাওয়া।
ডাক্তার বা কাউন্সিলরের সাহায্য নেবেন কখন
মানসিক সমস্যা নিয়ে লজ্জা বা ভয়ের কিছু নেই। যখন দেখবেন যে এই লক্ষণগুলো দৈনন্দিন জীবনকে প্রভাবিত করছে, তখনই মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত। যেমন
কাজে বা পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে অসুবিধা হলে।
ব্যক্তিগত সম্পর্কগুলোর ওপর প্রভাব পড়লে।
শারীরিক সমস্যা যেমন মাথাব্যথা, পেটে ব্যথা ইত্যাদি ঘন ঘন দিনের সময় কেড়ে নিতে থাকলে।
আত্মহত্যার চিন্তা বা আত্মঘাতী আচরণ দেখা দিলে অবশ্যই দ্রুত সাহায্য নিতে হবে।
সময়মতো চিকিৎসা না করলে যেসব দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়তে পারে-
দীর্ঘস্থায়ী বিষণ্ণতা বিভিন্ন শারীরিক রোগ, যেমন- মাইগ্রেন, হৃদরোগ, ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়।
ক্রমাগত উদ্বেগ উচ্চ রক্তচাপ ও হজমের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। এমনি হার্ট অ্যাটাকের মতো ঘটনাও ঘটতে পারে।
পিটিএসডি এটি ব্যক্তির সামাজিক ও ব্যক্তিগত জীবন ধ্বংস করতে পারে এবং দীর্ঘমেয়াদে অন্যান্য মানসিক রোগের কারণ হতে পারে।
পরিবারের কারও মধ্যে এমন লক্ষণ দেখলে কী করবেন
পরিবারের সদস্যদের সচেতনতা ও সহযোগিতা মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তির ভালো থাকার প্রধান কয়েকটি উপায়ের একটি। মানসিক সংকটের লক্ষণগুলো যদি আপনার পরিবারের বা বন্ধুদের কারও মধ্যে দেখেন, তাহলে আপনার দায়িত্ব তাকে সাহায্য করা। কারণ আক্রান্ত ব্যক্তি অনেক সময়ই নিজে থেকে সাহায্য চাইতে পারে না।
লক্ষ্য করুন: ব্যক্তির আচরণে আকস্মিক পরিবর্তন (যেমন অতিরিক্ত রাগ বা নিস্তেজ হয়ে যাওয়া) দেখা দিলে সচেতন হোন। তাকে দোষারোপ না করে কারণ বুঝতে চেষ্টা করুন।
শুনুন: তার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুন। বিচার বা সমালোচনা না করে সহানুভূতিশীল হোন। হতে পারে তার কথা আপনার কাছে অযৌক্তিক লাগছে, কিন্তু মনে রাখবেন- অনুভূতির কোন সত্য মিথ্যা হয় না। তাই একমত না হলেও সংকটাপন্ন ব্যক্তির অনুভূতিকে সম্মান করুন।
উৎসাহ দিন: হতাশা বা উদ্বেগ জীবনের ওপর আধিপত্য নিতে শুরু করার আগেই চিকিৎসা নেওয়ার জন্য উৎসাহিত করুন। মানসিক সমস্যা নিয়ে লজ্জা নেই, এটি একটি সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যা মাত্র, এই বিষয়টি বারবার মনে করিয়ে দিন।
পাশে থাকুন: তাকে একা বোধ না করতে সাহায্য করুন। আপনার উপস্থিতিই তার জন্য বড় সমর্থন হতে পারে।
মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে কথা বলা আজও আমাদের সমাজে কঠিন হলেও এই নীরব সংকট মোকাবিলা করার সময় এসেছে। বারবার এ বিষয়ে আলোচনা করা মানুষকে অবগত করার মধ্য দিয়েই সবার জন্য স্বস্তিকর একটি পৃথিবী লাভ করা সম্ভব। মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখাটা কোনো বিলাসিতা নয়, এটি আমাদের মৌলিক প্রয়োজন।