চার দশকেরও বেশি সময় ধরে ভয়াবহ দূষণে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে সীতাকুণ্ড পৌরসদরের প্রাচীন ৪টি দীঘি। দীঘিগুলো বর্তমানে ময়লা আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। দূষণ ছাড়াও দীঘিগুলোর পাড়ের অংশ আবর্জনায় ভরাট হয়ে গেছে। সম্পূর্ণরূপে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়া এসব দীঘি হচ্ছে পৌরসভার ৩ নং ওয়ার্ডস্থ মোহন্তের দীঘি, সীতাকু- থানা কেন্দ্রীয় মসজিদ সংলগ্ন দীঘি, লাল দীঘি ও সীতাকুণ্ড থানার দক্ষিণ পশ্চিম পাশ্বস্থ দীঘি। একসময় এসব দীঘি শীতল হাওয়া ও বিশুদ্ধ পানির উৎস থাকলেও এখন আর তা নেই। প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট হয়ে ভয়াবহ দূষণে পতিত এসব দীঘি এখন নিয়মিত ছড়াচ্ছে বিষক্রিয়া। আশেপাশের মার্কেট, দোকানপাট ও বাসা বাড়ি থেকে দেদারছে ফেলা হচ্ছে ময়লা-আবর্জনা, পাস্টিক, ছেড়া কাপড়, বিষাক্ত সিসা, জবাইকৃত মুরগির নাড়িভুড়ি। শুধু তাই নয়, কেউ কেউ মলমূত্রও ছাড়ছে দীঘিতে। আর এসবের ফলে দীঘিগুলো বিষাক্ত জলাশয়ে পরিণত হয়েছে। ছড়াচ্ছে তীব্র পঁচা গন্ধ, বংশবিস্তার ঘটাচ্ছে রোগ জীবানুর। আশপাশের এলাকায় দূষণ ছড়িয়ে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছে বহু মানুষ। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পৌরসদর ডাকবাংলা রোড় সংলগ্ন মোহন্ত দীঘি বিশাল কচুরিপানার ডিপোতে রূপ নিয়েছে। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে এ দীঘিটি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে আছে। দীঘির পশ্চিম পাড়ে চা দোকান, গাড়ির গ্যারেজ ও অন্যান্য দোকানের ময়লা আবর্জনা, পোড়া মোবিল, তেল, ভাঙা কাচের টুকরো, তার, লোহা, টিন কাটাসহ বিপজ্জনক সব বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। কালো লাকড়ির পোড়া ছালির স্তুপে দীঘির পশ্চিম পাড়ের একটি অংশ ভরাট প্রায়। অন্য পাড়গুলো কচুরীপানায় ঢাকা। আগে তিন পাড়ে ৫-৬ টি ঘাট থাকলেও এখন আর নেই। একসময়ে যে দীঘিতে মানুষজন গোসল করতো, গৃহবধূরা কলসি করে পানি নিয়ে যেতো সেই দীঘি এখন মশা, মাছি, ময়লা ও কচুরিপানার অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। সূত্রে জানা যায়, এই দীঘির মালিক স্থানীয় চৌধুরী বংশের লোকজন। দীঘি নিয়ে মালিক পক্ষদ্বয়ের মাঝে বিরোধ চলমান বলে জানা গেছে। অযত্ন অবহেলায় পরিবেশ বিনষ্ট হয়ে মানুষের ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ে আছে দীঘিটি। দীঘির একাংশের মালিক মো. সাহাবুদ্দিন খবরপত্রকে জানিয়েছেন, দীঘির ৮-৯ জন মালিক রয়েছে। আমরা ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজে ঢাকায় থাকি বলে দীঘির খোঁজ খবর নেওয়ার সময় হয়ে ওঠেনা। অনেকবার দীঘির পরিবেশ রক্ষার উদ্যোগ নিয়েও পরে পিছাতে হয়েছে। এসময় তিনি দীঘির পরিবেশ দূষণে ব্যবসায়ীদের অসচেতনতাকে দায়ি করেন। তবে শীঘ্রই দীঘির পূর্বের পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি। এই দীঘির মতোই অবস্থা থানা মসজিদ সংলগ্ন দীঘি। এ দীঘির পশ্চিম পাড়ে সীতাকুণ্ড থানা কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ ও মার্কেট, পূর্ব পাড়ে সরকারি মহিলা কলেজ, বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও থানা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং উত্তর পাড়ে থানা রোড়, সদর ভূমি অফিস ও দক্ষিণ পাড়ে মার্কেট। এককালের স্বচ্ছ পানির এ উৎসটি এখন বিষাক্ত জলাশয়। এ দীঘির পশ্চিম ও দক্ষিণ পাড়ে অসচেতন মহল ময়লা-আবর্জনা ফেলছে ঢালাওভাবে। নোংরা ও দূষিত বর্জ্য পদার্থে ভরে গিয়ে এ দীঘির পরিবেশ দূষণের মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। তবে এই দীঘির মালিকানা সীতাকু- ইউনিয়নের এক সময়ের চেয়ারম্যান মরহুম শামসুদ্দিনের কাছে। দূষণের বিষয়ে মরহুম শামসুদ্দিন চেয়ারম্যান এর ছেলে মো. সালাউদ্দিন খবরপত্রকে জানান, আমরা সবসময় দীঘিটি পরিস্কার রাখার চেষ্টা করি, ময়লা আবর্জনা দীঘিতে না ফেলতে সবাইকে অনুরোধ জানাই। দীঘিকে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে আমাদের শ্রমিকরা নিয়মিত কাজ করছে। এসময় তিনি মানুষের অসচেতনতার কারণে দীঘিটি দূষিত হচ্ছে বলে জানান। তবে আগের চেয়ে অনেকাংশে দূষণ কমে এসেছে বলে মনে করেন তিনি। একই অবস্থা পৌরসদরের লাল দিঘী ও থানার দক্ষিণ-পশ্চিম পাশ্বস্থ দীঘিরও। থানার দক্ষিণ-পশ্চিম পাশ্বস্থ দীঘির উত্তর,দক্ষিণ ও পূর্ব পাড়ে রয়েছে কয়েকটি মার্কেট। যেখানে রয়েছে হোটেলসহ কয়েকটি খাওয়ারের দোকান। আর এসব হোটেল-চা দোকান থেকে ময়লা-আবর্জনা ফেলা হচ্ছে নিয়মিত।খাওয়ারের উচ্ছিষ্ট, মুরগির নাড়িভুড়ি, প্লাস্টিকসহ নানাবর্জ্যে ভরাট হয়ে গেছে দীঘির পূর্ব পাড় ও দক্ষিণ পাড়। বর্ষাকালে এই দীঘি পানিতে টুইটুম্বুর হয়ে নামার বাজার প্লাবিত করে। তখন দূষিত বর্জ্য পানিতে ভেসে বেড়ায় পুরো এলাকায়। চারপাশের মারাত্মক দূষণ দীঘিকে বিষিয়ে তুলেছে। অন্যদিকে মাদ্রাসা সংলগ্ন লাল দিঘীতেও ফেলা হচ্ছে ময়লা আবর্জনা। দীঘির চারপাড়ের চারটি ঘাটই এখন অচল। ভবনের ছাদ থেকে ময়লা ও মার্কেটের দোকানসমূহের অব্যবহৃত জিনিসপত্র দীঘিতে ফেলার ফলে ভরাট হয়ে গেছে দীঘির কিয়দংশ। লাল দিঘীর উত্তর, উত্তর পূর্ব, ও পশ্চিম কোণে ময়লার বিশাল স্তূফ লক্ষণীয়। যা নিয়মিত দূর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। এসব ময়লার সীমাহীন গন্ধে নাজেহাল স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী ও পথচারীরা। দীঘি সংলগ্ন কয়েকজন ব্যবসায়ী বলেন, দূষিত হয়ে দীঘির পানি ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। আগে আমরা হাত, মুখ ধোয়াসহ পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার কাজে দীঘির পানি এ ব্যবহার করতে পারতাম। নোংরা পরিবেশের ফলে এখন দীঘি ব্যবহারের অনুপযোগী। এ বিষয়ে সীতাকুণ্ড সচেতন নাগরিক কমিটি ও সেভ দ্যা এনভায়রনমেন্ট সীতাকুণ্ড এর নেতৃবৃন্দ বলেন, পৌরসদরের এই দীঘিগুলো এক সময় সীতাকুণ্ড সদরে বসবাসরত মানুষের পানির চাহিদা পূরণ করলেও এখন এগুলো কেবলই অভিশাপ। দূষণের মাত্রা এতো বেশি যে এগুলো দীঘি থেকে ময়লা-আবর্জনার ডাম্পিংয়ে পরিণত হয়েছে। মানবসৃষ্ট এসব দূষণের কারণে যেমনিভাবে পানীয় সংকটে ভুগছে দীঘির আশেপাশের ব্যবসায়ী ও বাসিন্দারা তেমনিভাবে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছে মানুষজন। এসব দীঘির দূষণের ভয়াবহতা দিনের পর দিন তীব্রতর হলেও সচেতনতা সৃষ্টি করা যাচ্ছে না জনমনে। পরিবেশ কর্মীরা আরো বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তর ও সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষ সুনজর দিলে উপকৃত হবে সকলে, দীঘি ফিরে পাবে আপন পরিবেশ। এসময় পরিবেশ কর্মীরা লাল দীঘির দক্ষিণ ও পূর্ব পাড়ে বসার স্থান তৈরির মাধ্যমে দীঘিটিকে পার্কে রূপ দেওয়ার দাবি জানান।