নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে ধীরগতি
উপকূলীয় অঞ্চলের নৌচলাচল ব্যবস্থার উন্নতি করতে ২০১৪ সালে একটি প্রকল্প নেয় নৌ-অধিদফতর। নৌচলাচলে সহায়ক যন্ত্রপাতি স্থাপন ও পরিচালনা, আন্তর্জাতিক কনভেনশনের চাহিদা পূরণসহ আনুষাঙ্গিক বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়নে ওই বছর ১১ মার্চ ৩৭০ কোটি ৮৯ লাখ টাকা প্রাক্কলন ব্যয়ে প্রকল্পটি অনুমোদন পায় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পটির কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। দুই দফা সময় বাড়িয়ে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়। প্রকল্পের ব্যয়ও প্রথম দফায় বাড়িয়ে ৪৫৫ কোটি ৯৫ লাখ এবং দ্বিতীয় দফায় ৬৮৭ কোটি তিন লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এস্টাবলিস্টমেন্ট অব গ্লোবাল মেরিন ডিসট্রেস অ্যান্ড সেফটি সিস্টেম অ্যান্ড ইন্টিগ্রেটেড মেরিন নেভিগেশন সিস্টেম (ইজিআইএমএনএস)’ শীর্ষক প্রকল্পটির আর্থিক অগ্রগতি ডিসেম্বর ২০২০ পর্যন্ত ২৭.৪৬% এবং বাস্তব অগ্রগতি ২৮.৩২%। এ বছর জুনের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা সম্ভব হবে না। যার কারণে প্রকল্পের মেয়াদ আরও এক বছর বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
শুধু এ প্রকল্পই নয়, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের বেশিরভাগ প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি দেখা গেছে। এ মন্ত্রণালয়ের চলমান প্রকল্পগুলো নিয়ে বৃহস্পতিবার অনুমিত হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিতে আলোচনা হয়। কমিটি সূত্রে জানা গেছে, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ও এর আওতাধীন বিভিন্ন সংস্থার মোট ৫১টি প্রকল্প চলমান রয়েছে। এসব প্রকল্পের মধ্যে ২৫ শতাংশের নিচে কাজ হয়েছে ১৪টিতে। ৫০ শতাংশের নিচে ১০টি প্রকল্প এবং ৫১-১০০ শতাংশের নিচে রয়েছে ১৭টি প্রকল্প। শতভাগ কাজ হয়েছে ৪টি প্রকল্পের। ৬টির কোনও কাজই হয়নি। ওই ৬টির বেশিরভাগই এক বছরের আগে শুরু করা। এ ছাড়া কিছু প্রকল্প রয়েছে যার ভৌত ও আর্থিক অগ্রগতি একই। এটাকে সংসদীয় কমিটি অযৌক্তিক বলে মনে করছে। চট্টগ্রামের সঙ্গে নৌপথে ঢাকা ও আশুগঞ্জের যাত্রী ও পণ্য পরিবহন বাড়াতে ২০১৬ সালে ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে বাংলাদেশ আঞ্চলিক অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন প্রকল্প-১ গ্রহণ করা হয়। প্রকল্পটি ২০২৪ সালে শেষ করার কথা ছিল। গত বছর সেপ্টেম্বরে ১৪৯ কোটি ৪২ লাখ টাকা বাড়িয়ে ৩ হাজার ৩৩৯ কোটি ৪২ লাখ টাকায় উন্নীত করে একনেক সংশোধনী প্রস্তাব অনুমোদন দেয়। এ সময় প্রকল্পের মেয়াদও এক বছর বাড়ানো হয়। ২০১৬ সালের জুলাইয়ে শুরু হওয়া এ প্রকল্পের ভৌত কাজ (ডিসেম্বর ২০২০) হয়েছে ১০.৭০ শতাংশ। আর আর্থিক অগ্রগতি মাত্র ১ শতাংশ।
এ বছরের জুনে শেষ হবে এমন প্রকল্পগুলোর মধ্যে নগরবাড়ী নদীবন্দর নির্মাণ প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি ১৮.০১ শতাংশ ও ভৌত অগ্রগতি ২৫.২৫ শতাংশ। গত ডিসেম্বরে মেয়াদ শেষ হওয়া বিশেষ ধরনের টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি ৮৬ শতাংশ হলেও আর্থিক অগ্রগতি ৪৭.৬৭ শতাংশ। ২০১৮ সালের জুলাইয়ে শুরু হওয়া ৩৫টি ড্রেজার কেনা প্রকল্পের কাজের আড়াই বছরে শেষ হয়েছে মাত্র ১.৩৪ শতাংশ। এ প্রকল্পে অর্থ ব্যয় হয়েছে ১.২৬ শতাংশ। প্রকল্পটি ২০২৩ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে শুরু হওয়া পুরাতন ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তুলাই এবং পুনর্ভবা নদীর নাব্যতা উন্নয়ন প্রকল্পের আর্থিক ও ভৌত কাজ হয়েছে যথাক্রমে ৫.৫৪% ও ৬.৩৪%। গত ডিসেম্বরে শেষ হওয়া উদ্ধারকারী জলযানের জন্য ইঞ্জিনসহ যন্ত্রাংশ কেনার জন্য নেওয়া প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি ১৮.১৭ শতাংশ, ভৌত অগ্রগতি ৪৬.০৮ শতাংশ। আশুগঞ্জ অভ্যন্তরীণ কন্টেইনার নৌ-বন্দর স্থাপন প্রকল্পে আর্থিক ও বাস্তব অগ্রগতি ৫১.৭৬ শতাংশ। ২০১৮ সালের জুলাইয়ে শুরু হওয়া প্রকল্পটি চলতি বছর ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা। একইভাবে বাল্লা স্থলবন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের আর্থিক ও বাস্তব অগ্রগতি ১৫.৫৪ শতাংশ। বাংলাদেশ রিজিওনাল কানেকটিভিটি প্রজেক্ট-১ শেওলা, ভোমরা ও রামগড় স্থলবন্দর উন্নয়ন এবং বেনাপোল স্থলবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা উন্নয়ন প্রকল্পের আর্থিক ও বাস্তব অগ্রগতি ১৩.৫৬ শতাংশ। চট্টগ্রাম বন্দরে যন্ত্রপাতি ক্রয়ে নেওয়া প্রকল্পের আর্থিক ও ভৌত অগ্রগতি ০.২৬%। গত বছর জানুয়ারিতে শুরু হওয়া প্রকল্পটি আগামী বছর জুনে শেষ হওয়ার কথা।
এ ছাড়া ৩৫টি ড্রেজার ও সহায়ক জলযানসহ আনুষাঙ্গিক সারঞ্জামাদি সংগ্রহ প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি ১.২৬%, বাস্তব অগ্রগতি ১.৩২%। বি আইডব্লিউটিরি জন্য দুটি মিডিয়াম ফেরি নির্মাণ প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি ও বাস্তব অগ্রগতি ৫৭ ও ৫৮ শতাংশ। জুনে এ প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। ধামুকা-কামালপুর স্থলবন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের আর্থিক ১১.১৮ শতাংশ ও বাস্তব অগ্রগতি ১১.৭৬ শতাংশ। প্রকল্পগুলোর মধ্যে মোংলা বন্দরের জন্য সহায়ক জলযান কেনা, মেংলা বন্দরে আধুনিক বর্জ্য ও নিঃসৃত তেল অপসারণ ব্যবস্থাপনা, বন্দরে চ্যানেলের ইনার বারে ড্রেজিং, মাতারবাড়ি পোর্ট ডেভেলপমেন্ট প্রকল্প, পাটুরিয়া ও দৌলতদিয়া নদীবন্দর আধুনিকীকরণ, ডাকাতিয়া নদীর পাড়ে ওয়াকওয়ে নির্মাণ প্রকল্পের কাজ গত বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাইয়ে মধ্যে শুরু হওয়ার কথা থাকলেও এখনও হয়নি।
সময়মতো বাস্তবায়ন না হওয়া ও ব্যয় বৃদ্ধির বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক ও নৌপরিবহন অধিদফতরের চিফ নটিক্যাল সার্ভেয়ার ক্যাপ্টেন কে. এম. জসিমউদ্দিন সরকার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাস্তবে কাজ করতে গিয়ে পরে নতুন কিছু কম্পোনেন্ট যুক্ত হয়েছে। নকশা সংশোধনের প্রয়োজনও পড়েছে।’ তাছাড়া তার আওতাধীন প্রকল্পটি দ্বীপ ও চর অঞ্চলে হওয়ায় বেশি সময় লেগেছে বলেও জানান তিনি। এক বছর সময় বাড়ানোর প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে উল্লেখ করে তিনি আশা প্রকাশ করেন, এক বছর পেলে তারা কাজ শেষ করতে পারবেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে অনুমিত হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি মো. আব্দুস শহীদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সরকারের প্রকল্পগুলো বেশিরভাগই আমরা সময়মতো শুরু ও শেষ করতে দেখি না। এসব বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীও বার বার নির্দেশনা দিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবতা তা থাকে না। এতে জনগণ যেমন সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়, সরকারের ব্যয়ও বাড়ে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের মনে হয়ে ডিপিপি প্রণয়ন থেকে শুরু করে সব খাতেই দুর্বলতা আছে। সংশ্লিষ্টদের গাফিলতি ও তদারকির ঘাটতিও রয়েছে।’-বাংলাট্রিবিউন