দক্ষ ও পেশাজীবী বাংলাদেশিদের কাজে লাগিয়ে কাতারে শ্রমবাজার সুদৃঢ় করার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। এই লক্ষ্যে দক্ষ জনগোষ্ঠী, কাতার সরকার এবং ওই দেশের বেসরকারি খাতের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়েছে দূতাবাস। এ বিষয়ে কাতারে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মো. জসীম উদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কাতারে আধাদক্ষ কর্মীদের পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশি নাগরিক বিভিন্ন পেশায় এবং উচ্চ পদে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন। কীভাবে কাতারে বাংলাদেশি শ্রমবাজার টেকসই, নিরাপদ এবং সুশৃঙ্খল করা যায় সে বিষয়ে তাদের কাছ থেকে মূল্যবান পরামর্শ পেয়ে থাকি।’ একইসঙ্গে দূতাবাস স্থানীয় কর্তৃপক্ষ এবং বিভিন্ন কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি করেছে বলেও তিনি জানান।
কাতারে কর্মরত বাংলাদেশিদের শুধু রেমিট্যান্স পাঠানোর কারিগর হিসেবে দেখতে নারাজ রাষ্ট্রদূত। তিনি বলেন, ‘আমি তাদের বহুমাত্রিক রূপে দেখি। তারা রেমিট্যান্স পাঠান, একইসঙ্গে কাতারের জনগণের সঙ্গে সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করেন। ভালো কিছু করার জন্য নতুন চিন্তার জোগান দেন। সর্বোপরি তারা পাবলিক ডিপ্লোমেসিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।’ তিনি মনে করেন, এক্ষেত্রে বাংলাদেশি প্রবাসীদের যে কেউ প্রবাসে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম।
উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘গত বছর ইয়াসিন নামের এক বাংলাদেশি মিস্ত্রি হুইলচেয়ারে বসা এক ব্যক্তিকে রাস্তা পার হওয়ার চেষ্টা করতে দেখে। ইয়াসিন তার বাইক থামিয়ে ওই ব্যক্তিকে রাস্তা পার হতে সাহায্য করেন। এ দৃশ্য আরেকজন ব্যক্তি ভিডিও করে সামাজিক গণমাধ্যমে প্রকাশ করলে সেটি ভাইরাল হয়। পরে ইয়াসিনকে কাতারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় খুঁজে বের করে পুরস্কৃত করে। যা কাতারের সব সংবাদমাধ্যমে ছাপা হয়।’
রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘আমি এই উদাহরণ এখানে প্রায়ই দিয়ে থাকি যে একজন বাংলাদেশি নিজের অজান্তে, শুধু মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে আরেকজন ব্যক্তিকে সাহায্য করার ফলে বাংলাদেশের অনেক সুনাম হয়েছে। এভাবে যদি বাংলাদেশিরা সচেতনতার সঙ্গে, সক্রিয় হয়ে, দলবদ্ধভাবে বাংলাদেশের সুনাম বৃদ্ধির জন্য কাজ করে, তবে কাতারি নীতিনির্ধারক থেকে শুরু করে সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে আমাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে। এভাবে প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে জনকূটনীতির কাজে অংশ নিতে পারেন।’
এই প্রসঙ্গে তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী নির্দেশিত জনকূটনীতিকে বাস্তবানুগ ও সময়োপযোগী কৌশল হিসেবে আখ্যায়িত করেন। দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার জন্য দূতাবাসের উদ্যোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘২০১৯ সালে কাতার ১০ লাখ বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি ঘোষণা করে। আমি এখানকার বাংলাদেশিদের উৎসাহিত করছি তারাও যেন এই উদ্যোগে শামিল হন। একে আমরা বলছি সবুজে সহায়তা। এছাড়া পরিবেশ সচেতনতামূলক কাজের অংশ হিসেবে এখানে অনেকে নিজ উদ্যোগে সমুদ্রসৈকত পরিষ্কার করে থাকেন, যা বাংলাদেশিরাও করতে পারেন এবং করেও থাকেন। তাদের আমি রক্তদান কর্মসূচিতেও উৎসাহিত করছি। এসব কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের মাধ্যমে স্থানীয় জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক সুদৃঢ় হবে। এই ইতিবাচক ভাবমূর্তির প্রভাব নানা ক্ষেত্রে পড়বে বলে আশা করা যায়।’
কাতারিরা বাংলাদেশিদের কীভাবে দেখে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কাতারে ২০২২ সালে অনুষ্ঠিতব্য বিশ্বকাপ ফুটবলের অবকাঠামো উন্নয়ন কাজে বাংলাদেশের কর্মীরা দিন রাত পরিশ্রম করছেন। সেদিক থেকে বিশ্বকাপ প্রস্তুতি গাঁথায় আমাদের কর্মীদের নাম যুক্ত হয়ে আছে। আমার সঙ্গে কাতারিদের যখন পরিচয় হয় তাদের অনেকে বলেন, তার বা তার পরিচিত লোকের প্রতিষ্ঠানে বাংলাদেশি শ্রমিকরা কাজ করেন। কাতারে আমাদের প্রবাসী জনগোষ্ঠীর একটা ক্ষুদ্র অংশ আছেন যারা প্রকৌশল, চিকিৎসা, ব্যাংকিংসহ নানা ধরনের পেশায় নিয়োজিত আছেন। কিন্তু এই দেশে আমাদের প্রবাসীদের প্রধান পরিচয় নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে।’ রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘এ ধরনের চিন্তার পরিবর্তন করতে হলে ম্যানেজমেন্ট চেইনে আরও বেশি সংখ্যক বাংলাদেশিকে কাজ করতে হবে।’ তিনি একে ‘প্রবাসী জনগোষ্ঠীতে প্রকৌশল’ বা ‘ডায়াসপোরা ডোমোগ্রাফি ইঞ্জিনিয়ারিং’ নামে আখ্যায়িত করেন।
জসীম উদ্দিন বলেন, ‘জনশক্তি রফতানির ক্ষেত্রে সংখ্যাগত এবং গুণগত, অর্থাৎ আধাদক্ষ এবং একইসঙ্গে দক্ষ পেশাজীবী শ্রেণির ওপর সমান গুরুত্ব আরোপ করতে হবে।’ এই কৌশল রাতারাতি বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, এখনই কাজ শুরু করলে কাতারে বাংলাদেশের জনশক্তির বহুমাত্রিক রূপ বহুগুণে বৃদ্ধি পেতে খুব একটা সময় লাগবে না। কাতার সরকারের নীতিনির্ধারণী মহলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এই কাজ শুরু করার অনুকূল পরিস্থিতি বর্তমানে বিদ্যমান রয়েছে বলে জানান বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রবাসীবান্ধব নীতির কথা উল্লেখ করে রাষ্ট্রদূত জানান, দূতাবাস প্রবাসীদের জন্য সেবার মান উন্নয়নে সদা সচেষ্ট রয়েছে। তিনি বলেন, প্রবাসীদের সর্বোচ্চ মানের সেবা প্রদানে দূতাবাস প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।-বাংলাট্রিবিউন