বীমা খাতকে জনপ্রিয় করার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, বীমাকে জনপ্রিয়, এর প্রসার এবং এ নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে বীমা সংশ্লিষ্ট সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে একযোগে কাজ করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি নিজে গিয়ে সম্মাননা দিতে পারলে ভালো লাগত। কিন্তু করোনা আমাকে একরকম বন্দি করে দিয়েছে। সমস্যা কাটিয়ে উঠতে আমরা টিকা নিয়ে এসেছি, দেওয়াও হচ্ছে। টিকা নেওয়ার পরও স্বাস্থ্য সুরক্ষা মেনে চলতে হবে। হাত ধোয়া, মাস্ক পরা, এগুলোর মাধ্যমে নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে হবে।’
‘বঙ্গবন্ধু শিক্ষা বীমা’ উদ্বোধন করে সোমবার (১ মার্চ) তিনি এসব কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ‘জাতীয় বীমা দিবস-২০২১’ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তার পক্ষে শিক্ষার্থীদের হাতে শিক্ষা বীমার টাকা তুলে দেন অর্থমন্ত্রী আ হ মমুস্তাফা কামাল।
বাবা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির মুক্তি আন্দোলনে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছিলেন। এ কারণে ছোটবেলা থেকেই তার সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত থাকতে হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার ভাইবোনদের। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের সামরিক আইন জারির সময় রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকায় তিন বছর বাবার সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ হয়েছিল শেখ হাসিনার। সেই ঘটনারই স্মৃতিচারণা উঠে আসে বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যার মুখে। শেখ হাসিনা বলেন, ‘১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান ক্ষমতা দখলের পর বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়। এক বছরের মতো বন্দি ছিলেন তিনি। হাইকোর্টে রিট পিটিশন করে মুক্তি পেয়েছিলেন তিনি। সে সময় রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঢাকার বাইরে যেতে হলে থানা বা ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চের অনুমতি নিয়ে যেতে হতো। এ সময় একটি ইনস্যুরেন্স কোম্পানি আলফা ইনস্যুরেন্স কোম্পানির বাংলাদেশ প্রধান হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন তিনি।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বলতে গেলে আমাদের জীবনের সেই সময়টা অত্যন্ত একটা চমৎকার সময় ছিল। কারণ, আব্বা নিয়মিত চাকরি করছেন, বেতন পাচ্ছেন, ভালোভাবে থাকার সুযোগ হচ্ছে। সে সময় ধানমন্ডির জায়গাটায় দুটি কামরা তৈরি করেন আমার মা এবং ১৯৬১ সালের শেষের দিকে আমরা সেখানে চলে আসি। ১৯৬২ সাল পর্যন্ত একটা চমৎকার সময় ছিল। কিন্তু ১৯৬২ সালে আবার গ্রেপ্তার হন তিনি।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আলফা ইনস্যুরেন্সে চাকরির সুযোগে সারা দেশে নেতা-কর্মীদের সংগঠিত করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। রচনা করেন বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফা।’ তিনি বলেন, ‘ওই বিমা কোম্পানিতে থাকার ফলে মানুষকে সচেতন করতে পেরেছিলেন তিনি। কোম্পানির কাজে ঢাকার বাইরে যাওয়ার সুযোগ পেতেন বঙ্গবন্ধু। এ বিমাশিল্পে আমাদের দলের বহু লোককেই কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন তিনি। আলফা ইনস্যুরেন্স কোম্পানিকে বলে তাজউদ্দীন সাহেবকে সেখানে নিয়ে আসেন তিনি। সেই সঙ্গে আনেন মোহাম্মদ হানিফকেও। এখানে বসেই কিন্তু ছয় দফা রচনা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। কাজেই এটা শুধু একটা বিমা কোম্পানিই নয়, আমাদের রাজনৈতিক জীবনের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ জায়গা।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘অভিভাবকের আর্থিক অসংগতি বা শারীরিক অক্ষমতার জন্য কোনো শিক্ষার্থী যেন শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত না হয়, সে নিশ্চয়তা দেবে বঙ্গবন্ধু শিক্ষাবিমা, এটা খুব প্রয়োজন এবং উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও এটা প্রয়োজন। এর আওতায় বার্ষিক ৮৫ টাকা দিয়ে ৩ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিক্ষার্থীরা পলিসি গ্রহণ করতে পারবে। আমি মনে করি, আমাদের জন্য এটা খুবই যুগান্তকারী একটি সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর ফলে পড়াশোনার জন্য অর্থের অভাব কারও আর হবে না।’ বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ‘এটাকে এমনভাবে আপনাদের করতে হবে, যেন একটি নতুন বিবাহিত দম্পত্তি তারা তখন থেকেই তাদের সন্তানের জন্য বিমা করবে, যার মাধ্যমে তাদের সন্তান পড়াশোনা করবে। সন্তান বড় হতে থাকবে সঙ্গে সঙ্গে প্রিমিয়ামের টাকাও বাড়তে থাকবে। পড়াশোনা শেষ হওয়া পর্যন্ত যেন সে এ সুযোগটা পেতে পারে, সেভাবে পলিসি তৈরি করতে হবে।’
গ্রাহকের স্বার্থকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে বিমা প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাগিদ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই সঙ্গে সতর্ক থাকারও পরামর্শ তার।
তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের কিছু মানুষের অভ্যাস আছে, ব্যবসা করতে গিয়ে অনেক সময় ক্ষতি না হলেও আর্টিফিসিয়ালি কিছু ক্ষতি করে। হয়তো আগুন লাগাল, এসব করে একটা মোটা অঙ্কের বিমার প্রিমিয়াম থেকে টাকা চায়। আসলে দেখা যায়, যে পরিমাণ ক্ষতি সে দাবি করে সে পরিমাণ খরচ হয়নি। যারা পরীক্ষা করতে যাবে, তাদেরকেও ভালোমতো শিক্ষা দিতে হবে। তারা যেন আবার এই অল্প ক্ষতিকে বড় ক্ষতি হিসেবে না দেখায়। একটা জিনিস হাতেনাতে ধরতে পেরেছি বলেই আজ আপনাদের বললাম। এখানে যে দুর্নীতিটা এটা অবশ্য কমে গেছে তবু সতর্ক থাকতে হবে।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এটা মানুষকে একটা সেবা দেয়া। মানুষ একটি আমানত রেখেছে সেটাকে আবার অন্যভাবে কেউ যেন ব্যবহার করতে না পারে। সে বিষয়েও সতর্ক থাকার অনুরোধ জানাচ্ছি।’ দেশে স্বাস্থ্যবিমার ব্যাপক প্রসারের ওপরও গুরুত্বারোপ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বলেন, ‘আমাদের স্বাস্থ্যবিমা আরও ব্যাপকভাবে চালু করা একান্তভাবে প্রয়োজন বলে মনে করি। দেশের মানুষ এখনও সচেতন নয়। তবে করোনাভাইরাসের কারণে মনে করি মানুষের মধ্যে এ সচেতনতা হয়তো সৃষ্টি হবে।’
বিমাব্যবস্থা গড়ে তুলতে অ্যাকচ্যুয়ারি গঠনের প্রয়োজনীয়তাও তুলে ধরেন সরকারপ্রধান। অ্যাকচ্যুয়ারি হলো ব্যবসাসংক্রান্ত গোষ্ঠী, যারা ঝুঁকির আর্থিক প্রভাব বিশ্লেষণ করে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা চাই বিমা সম্পর্কে মানুষ আরও আস্থাশীল হোক। আমাদের সবচেয়ে যেটার অভাব, আমাদের কোনো অ্যাকচ্যুয়ারি নেই। এই বিমাকে আরও শক্তিশালী করতে অ্যাকচ্যুয়ারি আমরা লন্ডন থেকে নিয়ে এসে এখানে দিয়েছিলাম। আসলে আমাদের যারা এ বিষয়ে পড়াশোনা করে, তারা পড়াশোনার সঙ্গে সঙ্গে বিদেশে চাকরি পেয়ে যায় আর দেশের কথা ভুলে যায়। বিমাকে আরও দক্ষ করতে হলে অ্যাকচ্যুয়ারি একান্তভাবে দরকার।’
প্রধানমন্ত্রী জানান, অ্যাকচ্যুয়ারি নিয়ে যারা শিক্ষা গ্রহণ করবে বা প্রশিক্ষণ নেবে, উচ্চশিক্ষার জন্য তাদের যুক্তরাজ্যে পাঠাবে সরকার। তবে তাদের অঙ্গীকারবদ্ধ থাকতে হবে যে, দেশে ফিরে তারা দেশের জন্য কাজ করবে। তাদের শিক্ষার টাকাটাও আমরাই দেব। এ সিদ্ধান্ত আমরা নিয়েছি। এটার জন্য পাঁচজন শিক্ষার্থী আমরা সুনির্দিষ্ট করেছি, যাদের প্রাথমিকভাবে পাঠাবো। অ্যাকচ্যুয়ারির ওপর শিক্ষা গ্রহণ এবং ফিরে এসে বিমা নিয়ে তারা কাজ করবেন। দেশের জন্য আরও বেশি দক্ষ মানুষ তারা তৈরি করবেন। অর্থমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন ইনস্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শেখ কবির হোসেন ও আর্থিক বিভাগের সিনিয়র সচিব আসাদুল ইসলাম।