মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারী ২০২৫, ০৩:৫৮ অপরাহ্ন

কিয়ামতে আল্লাহর বিচারিক আদালত

শাহ আলম বাদশাহ:
  • আপডেট সময় শনিবার, ২০ মার্চ, ২০২১

আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘কিয়ামত দিবসে আল্লাহ সব মানুষকে একটি ময়দানে একত্র করবেন, তারপর রাব্বুল আলামিন তাদের সামনে আত্মপ্রকাশ করে বলবেন, পৃথিবীতে যে যার অনুসরণ করত, এখন কেন সে তার পদাঙ্ক অনুসরণ করবে না?’ অতএব, ক্রুশপূজারিদের জন্য ক্রুশ, মূর্তিপূজারিদের জন্য মূর্তি, অগ্নিপূজকদের জন্য আগুন উপস্থাপন করা হবে এবং সবাই নিজ নিজ পূজনীয় মাবুদদের সাথে চলবে। আর মুসলিমরা তাদের জায়গাতেই থেকে যাবে। রাব্বুল আলামিন তাদের সামনে প্রকাশিত হয়ে বলবেন, ‘তোমরা কেন ওইসব মানুষকে অনুসরণ করছ না? তারা বলবে, নাউজুবিল্লাহ মিনকা, নাউজুবিল্লাহ মিনকা (আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি)। আল্লাহই আমাদের প্রভু। আর এটা আমাদের জায়গা। আমরা আমাদের প্রভুর সাক্ষাৎ পাওয়ার আগমুহূর্ত পর্যন্ত এ স্থান ছেড়ে যাবো না। তিনি তাদের নির্দেশ দেবেন এবং তাদের নিজ জায়গায় অটল রাখবেন।
তারপর আল্লাহ অদৃশ্য হয়ে যাবেন। তিনি পুনরায় তাদের সামনে প্রকাশিত হয়ে বলবেন, তোমরা কেন ওইসব মানুষের অনুসরণ করছ না? তারা বলবে, নাউজুুবিল্লাহ মিনকা, নাউজুুবিল্লাহ মিনকা, আল্লাহ আমাদের রব এবং এটি আমাদের অবস্থানস্থল। আমরা আমাদের রবের দেখা পাওয়ার আগমুহূর্ত পর্যন্ত এ জায়গা ছেড়ে যাব না। তিনি তাদের আদেশ দেবেন এবং নিজ স্থানে দৃঢ় রাখবেন।
সাহাবিরা প্রশ্ন করলেন, হে আল্লাহর রাসূল সা:, আমরা কি আমাদের প্রভুর দেখা পাবো? তিনি বললেন, তোমাদের কি পূর্ণিমা রাতের চাঁদ দেখতে অন্যদের কষ্ট দিতে হয়? তারা বললেন, না, হে আল্লাহর রাসূল! তিনি বললেন, অনুরূপভাবে সে সময় তাকে দেখার জন্য তোমাদের কাউকেও কষ্ট করতে হবে না। তারপর আল্লাহ আড়ালে চলে যাবেন। তিনি পুনরায় তাদের সামনে প্রকাশিত হয়ে নিজের পরিচিতি উপস্থাপন করে বলবেন? আমিই তোমাদের প্রভু। তোমরা আমার অনুসরণ করো। মুসলিমরা উঠে দাঁড়াবে। চলার পথে পুলসিরাত স্থাপন করা হবে। তারা তা খুব সহজেই দ্রুতগামী ঘোড়া ও উটের মতো অতিক্রম করবে এবং এর ওপরে তাদের ধ্বনি হবে- সাল্লিম সাল্লিম।’ (হে আল্লাহ আমাদের শান্তিতে রাখুন)
জাহান্নামিরা অতিক্রম না করতে পেরে এখানেই থেকে যাবে। তাদের মধ্য থেকে একটি দলকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে এবং জাহান্নামকে প্রশ্ন করা হবে, তোর পেট ভরেছে কি? সে বলবে, আরো আছে কি? আবার আরেকটি দলকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে এবং প্রশ্ন করা হবে, তোর পেট ভরেছে কি? সে বলবে, আরো আছে কি? এভাবে সমস্ত জাহান্নামিকে যখন জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে, তখন দয়ালু প্রভু আল্লাহ পায়ের ওপর রাখবেন এবং এর এক অংশ আরেক অংশের সাথে সঙ্কুুচিত হয়ে যাবে। তিনি বলবেন, যথেষ্ট হয়েছে তো। জাহান্নাম বলবে, হ্যাঁ, যথেষ্ট হয়েছে, যথেষ্ট হয়েছে।
এরপর আল্লাহ যখন জান্নাতিদের জান্নাতে এবং জাহান্নামিদের জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন, তখন মৃত্যুকে গলায় কাপড় বেঁধে টেনে আনা হবে এবং জান্নাতি ও জাহান্নামিদের মাঝখানের প্রাচীরে রাখা হবে। তারপর ডেকে বলা হবে, হে জান্নাতিগণ! তারা ভয়ে ভয়ে আত্মপ্রকাশ করবে। তারপর বলা হবে, হে জাহান্নামিগণ! তারাও সুসংবাদ মনে করে শাফায়াত লাভের আশায় আত্মপ্রকাশ করবে। তারপর জান্নাতি ও জাহান্নামিদের প্রশ্ন করা হবে, তোমরা কি একে চেনো? জান্নাতি ও জাহান্নামিরা বলবে, হ্যাঁ, আমরা একে চিনে ফেলেছি। এটা মৃত্যু, যা আমাদের ওপর নির্দিষ্ট করা হয়েছিল। তারপর মৃত্যুকে চিৎ করে শোয়ানো হবে এবং জান্নাত ও জাহান্নামের মধ্যকার প্রাচীরের ওপর জবাই করা হবে। তারপর বলা হবে, হে জান্নাতিগণ! তোমরা চিরকাল জান্নাতে থাকবে। এরপর আর মৃত্যু নেই। হে জাহান্নামিগণ! তোমরা চিরকাল জাহান্নামে থাকবে, এরপর আর মৃত্যু নেই। (তিরমিজি-২৫৫৭, তাখরিজ তাহাভিয়া-৫৭৬, বুখারি ও মুসলিম)
কিয়ামত কী? কিয়ামত শব্দের অর্থ উঠে দাঁড়ানো। এটি আরবি শব্দ কিয়াম থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ শোয়া বা বসা থেকে ওঠা। ইসলামী আকিদা অনুসারে, ইসরাফিল আ: শিঙ্গায় ফুৎকার দিলে কিয়ামত হবে, অর্থাৎ বিশ্বজগৎ ধ্বংস হবে। প্রথম ফুৎকার দেয়ার সাথে সাথেই আকাশ ফেটে যাবে, তারকাসমূহ খসে পড়বে, পাহাড়-পর্বত ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে তুলার মতো উড়তে থাকবে। সব মানুষ ও জীবজন্তু মরে যাবে, আকাশ ও সমগ্র পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। দ্বিতীয় ফুৎকার দেয়ার সাথে সাথেই পৃথিবীর সৃষ্টি থেকে কিয়ামত পর্যন্ত সৃষ্টজীবের সবাই মাটির ভেতর থেকে জীবিত হয়ে উঠে দাঁড়াবে।
শিক্ষা : এক. আল্লাহ হাশরের মাঠে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের সামনে বিচারক হিসেবে উপস্থিত হবেন।
দুই. তিনি ক্রুশপূজারি, মূর্তিপূজারি, অগ্নিপূজকসহ মুসলিমবহির্ভূত সব ধর্ম-আদর্শের মানুষকে তাৎক্ষণিকভাবে নিজেদের সৃষ্ট সেই উপাস্যের সাথেই চলতে বাধ্য করবেন।
তিন. মুসলিমরা তাদের নির্দিষ্ট জায়গাতেই বসে থাকা অবস্থায় আল্লাহ তাদের সামনে একাধিকবার প্রকাশিত হবেন এবং অমুসলিমদের সাথে না যাওয়ার কারণও একাধিকবার জিজ্ঞেস করবেন। শিরকমুক্ত মুসলিমরা তাকেই প্রভু হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সেখানে তার দর্শনের আশায় থাকার জন্য অটলতা প্রকাশ করবে। আল্লাহ তাদের সেখানেই অবস্থান করার জন্য অনুমতি দেবেন। চার. সাহাবিদের প্রশ্নোত্তরে রাসূল সা: জানান, অগুনতি ও কোটি কোটি মানুষের ভিড়ে জান্নাতি মুসলিমরা আল্লাহকে পূর্ণিমা রাতে চাঁদের মতোই সুস্পষ্টভাবে দেখতে পাবেন।
পাঁচ. আল্লাহ মুসলিমদের সামনে কয়েকবার উপস্থিত হবেন এবং সবশেষে নিজেকে বিশ্বজগতের প্রভু হিসেবে পরিচিতি দিয়ে তাকেই অনুসরণ করে তাদের জান্নাতের দিকে যাওয়ার নির্দেশ দেবেন। জান্নাতের পথে পুলসিরাত বা ব্রিজ স্থাপন করা হবে। মুসলিমরা নির্বিঘেœ দ্রুতগামী ঘোড়া ও উটের মতো পুলসিরাত পার হয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবে।
ছয়. জাহান্নামিরা পুলসিরাত পার হতে ব্যর্থ হওয়ার পর তাদের একের পর একেকটি দলকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।
অযৌক্তিক প্রশ্নোত্তর : মৃত্যুকে গলায় গামছা বেঁধে টেনে আনা এবং জবাই করার কথা শুনে অনেকের ঈমান নড়বড়ে হতে পারে যে, এটা কিভাবে সম্ভব? তাদের বিরুদ্ধবাদীরা আবার বিনা যুক্তিতে বলতে পারেন যে, আল্লাহর কাছে সব কিছুই সম্ভব! কথা সত্য। তবুও মানুষের আবিষ্কৃত অশরীরী ও প্রাণহীন কার্টুন এবং অবিশ্বাস্য সব ভার্চুয়াল গেমের নজির দিয়েই আমরা প্রমাণ করতে পারি, মৃত্যুকেও গলায় গামছা বেঁধে আনা এবং জবাই করাটা সম্ভব এবং বিজ্ঞানসম্মত। অঙ্কন করা ছবি ও কার্টুনকে যদি জীবন্ত মানুষের মতো রূপদান করা যায়, তাহলে প্রাণসর্বস্ব অদৃশ্য মৃত্যুকেও শরীরী রূপ দেয়া যাবে না কেন? তা ছাড়া বিজ্ঞান আজ প্রমাণ করেছে, অদৃশ্যকে দৃশ্যমান করা যেমন সম্ভব, তেমনি দৃশ্যমানকেও অদৃশ্যমান করা সম্ভব। এসডি কার্ড, মেমোরি কার্ড, সিডি-ডিভিডি, পেনড্রাইভ ইত্যাদিতে পাহাড় সমান বই-পুস্তক বা জিনিস যেমন অদৃশ্যমান করে রাখা সম্ভব, তেমনি প্রিন্ট বা বস্তুগত রূপ দিয়ে তাদেরও বিশালাকৃতির দৃশ্যমান রূপ দেয়া হয় না? সৃষ্টির মূলবস্তু পানিকেও কি আমরা কঠিন, বায়বীয়, তরল ও অদৃশ্য পদার্থে রূপান্তরিত করতে পারি না? তেমনই মৃত্যুকে দৃশ্যমান শরীর দেয়াটা আল্লাহর পক্ষে অসম্ভব কিছু নয়!




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com