হজরত থানভী রহ: বলেন, ‘অনেক সময় ধারণা হয় আমরা আমাদের ছোটদের কাছে যদি সরাসরি বাক্যে ক্ষমা চাই, তাতে তারা বে আদব হয়ে যাবে এবং আরো বেশি অবাধ্যতা করবে।’ এ ক্ষেত্রে কেউ যদি এটা ভেবে থাকে তবে সাময়িকভাবে অহঙ্কারি মনে না হলেও তাৎপর্য থেকে বোঝা যায় আসলেই অহঙ্কারের কারণেই মূলত ক্ষমা চাওয়া থেকে নিজেকে বিরত রাখতে চায়। কারণ অফিসের কোনো কর্মচারীর সাথে যদি খারাপ আচরণ করে থাকে তবে তার সাথে সম্পর্ক রাখতে চাইলে তাকে কিছু উপহার দিয়ে ক্ষমা চাওয়ার মতো আচরণ করা যায়। আর যদি তাকে কাজে রাখার ইচ্ছে না থাকে তবে সরাসরি তার কাছে ক্ষমা চেয়ে বলতে হবে এই কাজের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী এবং কাজ থেকে বিদায় দিতে হবে। এরপরও জুলুমের অপরাধ তো থেকেই যায়। বিখ্যাত আরব কবি মুতানাব্বী বলেন, ‘তুমি কোনো ভদ্রলোককে সম্মান করলে সে তোমার গোলাম হয়ে যাবে এবং তুমি তার মালিক হয়ে যাবে পক্ষান্তরে তুমি কোনো ইতরজনকে যদি সম্মান করো, সে উদ্ধত হয়ে যাবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘যেখানে তরবারি ব্যবহার সমীচীন, সেখানে উদার আচরণ করলে তা ঠিক সেরকমই ক্ষতিকর হয়, যেমন ক্ষতি হয় উদারতার স্থানে তরবারির ব্যবহার।’ দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন আচরণের মানুষ বিদ্যমান থাকায় এক একজনের সাথে এক এক রকমের আচরণ বা ক্ষমা চাইতে হয়। কারো প্রতি নম্র আচরণ করলে সে এমনই বিগলিত হবে যে, পরবর্তীতে আর কখনো অবাধ্যাচরণের চিন্তাও করবে না। আবার কেউ কেউ হয় দুর্বিনীত, যে নম্র আচরণের উপযুক্ত নয়।
নিজ কর্মচারীর কাছে যখন ছোট হয়ে ক্ষমা চেয়ে নেয়া হবে তখন সেটি হবে অহঙ্কারের চিকিৎসা। এটাই অহঙ্কারের এলাজ। সরাসরি যখন স্পষ্টত ক্ষমা চাওয়া হবে তখন সেটা আখিরাতের মুক্তির কারণ হবে আবার দুনিয়ার অহঙ্কারের সর্বোত্তম চিকিৎসা হয়ে যাবে। আমাদের প্রিয়নবী মর্যাদার দিক থেকে পৃথিবীর সবার ঊর্ধ্বে আবার কখনো কারো সাথে এতটুকুও খারাপ আচরণ করেননি। কিন্তু তিনি সবার সামনে দাঁড়িয়ে প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন যে, ‘আচার-আচরণকালে কারো প্রতি যদি আমার দ্বারা কোনো রকম বাড়াবাড়ি হয়ে থাকে, কারো জান-মাল ও ইজ্জত-আবরুর ক্ষতি যদি আমি করে থাকি, তবে আজ আমি সবার সামনে উপস্থিত আছি, চাইলে সে আমার থেকে প্রতিশোধ নিয়ে নিক অথবা আমাকে ক্ষমা করে দিক।’ একজন সাহাবি এ কথা শুনে দাঁড়িয়ে গিয়ে বললেন, তিনি বদলা নিতে চান। মহানবী সা: কিসের বদলা জানতে চাইলে সাহাবি বললেন, একদিন তিনি তার কোমরে আঘাত করেছিলেন, সেই আঘাত দিতে চান। এরপর রাসূল সা: কোমর এগিয়ে দিলে সাহাবি বললেন, আপনি যখন মেরেছেন তখন আমার গায়ে কোনো কাপড় ছিল না, তাই আপনার কাপড় সরিয়ে দিন। তখন প্রিয়নবী কাপড় সরিয়ে বদলা নিতে বললে সাহাবি তাঁর নবুওয়াতি মোহরে চুমু খেতে লাগলেন। ভাবলেই অবাক লাগে, কতটা উদার মনের মানুষ হলে জনসমাবেশে এভাবে নিজেকে বাড়িয়ে দিয়ে বদলা নিতে বলা যায়।
‘মন্দের প্রতিফল অনুরূপ মন্দ। আর যে ক্ষমা করে দেয় ও আপস-নিষ্পত্তি করে, তার পুরস্কার আল্লাহর কাছে আছে, নিশ্চয়ই আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীদের পছন্দ করেন না।’ এটি হলো ‘কেসাস’ (অনুরূপ প্রতিশোধ নেয়া) এর অনুমতি। মন্দের বদলা যদিও মন্দ নয়, তবুও (শব্দে ও কর্মে) সাদৃশ্য বর্তমান থাকার কারণে এটিকেও মন্দ বলা হয়েছে।
রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের সম্ভ্রমহানি বা অন্য কোনো বিষয়ে জুলুমের জন্য দায়ী থাকে, সে যেন আজই তার কাছ থেকে মাফ করিয়ে নেয়, সে দিন আসার আগে যেদিন তার কোনো দিনার বা দিরহাম থাকবে না। সে দিন তার কোনো সৎকর্ম না থাকলে তার জুলুমের পরিমাণ তা তার কাছ থেকে নেয়া হবে আর তার কোনো সৎকর্ম না থাকলে তার প্রতিপক্ষের পাপ হতে নিয়ে তা তার ওপর চাপিয়ে দেয়া হবে’ (বুখারি : ২৪৪৯)। তাই ক্ষমার দরজা বন্ধ হওয়ার আগেই আমাদের ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে।
‘আরোয়াহে ছালাছা’ গ্রন্থে হজরত থানভী রহ: একটি ঘটনা লিখেছেন, এক ব্যক্তি এক বুজুর্গের কাছে বলল যে শুনেছি বুজুর্গদের বিভিন্ন রঙ হয়, তা আমি দেখতে চাই। কিন্তু বুজুর্গ বললেন, নিজের কাজ করো এসব কথায় ব্যস্ত হতে হবে না। ব্যক্তিটি নাছোড়বান্দা, তা দেখেই ছাড়বে। বুজুর্গ বললেন, এক মসজিদের সামনে তিন বুজুুর্গ আল্লাহর জিকিরে মশগুল আছেন। সবাইকে একটি করে ঘুষি মারবে। পরে তাদের প্রতিক্রিয়া কি তা এসে আমাকে জানাবে। যেই কথা সেই কাজ, পরিশেষে দেখা গেল একজন বুজুর্গ এক এক রকম আচরণ করলেন। তিনজনের তরিকাই জায়েজ ছিল। প্রথমটা জায়েজ ছিল এ কারণে যে, তিনি ঘুষির পরিবর্তে ঘুষি দেন। এতে সমপর্যায়ের বদলা নেয়া হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘মন্দের প্রতিশোধ অনুরূপ মন্দ’ (শূরা :৪০)। বুজুর্গ ভাবলেন তার ওপর সমপর্যায়ের বদলা নিয়ে তার কল্যাণকামী হতে, কারণ এর জন্য যেন সেই ব্যক্তিকে হাশরের দিন পাকড়াও করা না হয়। দ্বিতীয় বুজুর্গ ব্যক্তিটিকে ক্ষমা করে দেন এবং কোনো রকম বাড়াবাড়ি করতে চাননি। এটাও জায়েজ। আল্লাহ বলেন, ‘অবশ্য যে সবর করে ও ক্ষমা করে দেয়, তা তো দৃঢ় সঙ্কল্পেরই কাজ’ (শূরা : ৪৩)। বস্তুত ক্ষমা করাই রাসূল সা:-এর সুন্নত। আর সময়ের মূল্য দিতে গিয়ে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। আর তৃতীয় বুজুর্গটি সম্পূর্ণ ভিন্ন রঙের। তিনি নিজের ব্যথার কথা ভুলে বরং সেই ব্যক্তিটির ব্যথার কথা ভাবছিলেন। তাই উঠে সেই ব্যক্তির হাত টিপে দিচ্ছিলেন। আসলেই বান্দার হক ক্ষমার যোগ্য না আল্লাহর দরবারে। আজকাল তো কেউ কাউকে ছোট করে কথা বলা ও অপমান করা কোনোভাবেই ছাড় দেয় না। অথচ মানুষের জান-মাল আর ইজ্জত এত বেশি মর্যাদাবান যে প্রিয়নবী পবিত্র কাবারও ওপরে মানুষের সম্মানকে স্থান দিয়েছেন। কেউ কোনো মুসলিমের জান-মালের ওপর হামলা করলে সে যেন পবিত্র কাবার ওপর হামলা করল। আল্লাহ আমাদের হেফাজত করুন। আমীন। লেখিকা : গবেষক