২০১৪ সালে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ মীমাংসায় আন্তর্জাতিক সালিশ আদালতের এক রায়ে বাংলাদেশ নতুন প্রায় সাড়ে ১৯ হাজার বর্গকিলোমিটার সমুদ্র এলাকা পেয়েছে । বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশ কন্টিনেন্টাল শেলফ বা মহীসোপানের যে দাবি করেছে, তাতে আপত্তি জানিয়েছে ভারত। জাতিসঙ্ঘের মহীসোপান নির্ধারণসংক্রান্ত কমিশনে (সিএলসিএস) ভারতের বক্তব্য, সমুদ্রপৃষ্ঠের যে বেসলাইনের ভিত্তিতে বাংলাদেশ মহীসোপান নির্ধারণ করেছে, তা ঠিক নয়, সেটি বরং ভারতের মহীসোপানের অংশ। ভারতের আগে এ বছরের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের দাবির বিষয়ে পর্যবেক্ষণ দিয়েছে মিয়ানমার, তবে ভারতের মতো তারা আপত্তি জানায়নি। বাংলাদেশ বলছে, ভারতের এই আপত্তির আইনগত কোনো ভিত্তি নেই বলেই তারা মনে করে। এই বিষয়ে তারা সিএলসিএসে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরবে।
মহীসোপান কী? কন্টিনেন্টাল শেলফ বা মহীসোপান হচ্ছে সমুদ্র তীরবর্তী দেশগুলোর সমুদ্রের দিকে পানির নীচে যে ভূখ- ধীরে ধীরে ঢালু হয়ে যে নেমে যায়, তাকে ভূগোলের ভাষায় বলা হয়ে থাকে মহীসোপান, যাকে উপকূলীয় ওই দেশের বর্ধিত অংশ বলে ধরা হয়ে থাকে।
১৯৫৮ সালের কনভেনশন অনুযায়ী, সমুদ্র তীরবর্তী দেশগুলোর স্থলভাগের বেসলাইন থেকে লম্বালম্বিভাবে সমুদ্রের ২০০ মাইল পর্যন্ত এলাকার মালিকানা সম্পূর্ণ ওই দেশের। একে বলা হয় এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক অ ল (ইইজেড) বা একচেটিয়া অর্থনৈতিক অ ল, যেখানে সমুদ্রের পানি ও তলদেশের ওপর ওই দেশের একছত্র অধিকার থাকে। সেখানকার সমুদ্রে অন্য কোন দেশ মাছ ধরতে পারে না। এরপর থেকে দেড়শ মাইল পর্যন্ত সীমার সমুদ্র তলদেশের খনিজ সম্পদের মালিক হবে ওই দেশ, তবে পানিতে থাকা মাছ ধরতে পারে অন্য দেশও। এই পুরো সাড়ে তিনশো মাইলকে ওই দেশের মহীসোপান বলা হয়। দেশের আকার ভেদে এই মহীসোপানের দৈর্ঘ্য কমবেশি হতে পারে। যেমন অস্ট্রেলিয়ার মহীসোপানের আয়তন অনেক বেশি। বাংলাদেশ নিজের ভূখ- থেকে লম্বাভাবে সাড়ে তিনশো মাইল এলাকার মহীসোপান নিজের বলে জাতিসঙ্ঘে দাবি করেছে।
মহীসোপান যে কারণে গুরুত্বপূর্ণ? মহীসোপান মূলত একটি দেশের সীমানারই অংশ। ভূখ-ের মতো সাগরের এই মহীসোপান নানা দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। দেশের ভূখ-ের বেসলাইন থেকে লম্বাভাবে প্রথম ২০০ মাইল একচেটিয়া অর্থনৈতিক অ ল বা ইইজেড। এখানে যেমন ওই দেশটি একচেটিয়াভাবে মৎস্য আহরণ করতে পারে। আবার সেখানকার সাগর তলে থাকা সকল খনিজ সম্পদের মালিকও ওই দেশ। সেই সাথে মহীসোপানের যে বর্ধিত অংশটি থাকে, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যেমন আরও ১৫০ মাইল, সেটিও আসলে ওই দেশের একটি বর্ধিত অংশ।
এখানে উদাহরণ দিয়ে বলা হয়, বর্ধিত অংশের পানি বাংলাদেশসহ অন্য দেশ মাছ ধরতে যেমন পারবে। ফলে তার মৎস্য আহরণের সীমানা আরও বিস্তৃত হচ্ছে। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, এই মহীসোপান এলাকায় পানির নীচে পাওয়া সব খনিজ সম্পদের মালিক হবে দেশটি। যেমন বাংলাদেশের একচেটিয়া অ লের ২০০ মাইল আর বর্ধিত মহীসোপানের ১৫০ মাইল- এই সাড়ে তিনশো মাইলে পাওয়া যেকোনো খনিজ সম্পদের মালিক হবে বাংলাদেশ। আবার এই পুরো এলাকায় বাংলাদেশের ট্রলার ইচ্ছেমত মাছও ধরতে পারবে। মহীসোপান সব দেশের কাছেই বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সাধারণত মহীসোপান এলাকার ভেতরে তেল-গ্যাস বা অন্য খনিজ সম্পদ পাওয়া যায়, তা উত্তোলনে খরচ কম হয়ে থাকে। ফলে সেটি উত্তোলনযোগ্য এবং ব্যবহারযোগ্য হয়ে থাকে। ফলে এই সীমানা অর্থনৈতিকভাবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণেই অনেক সময় মহীসোপানের এলাকা নিয়ে প্রতিবেশী বিভিন্ন দেশের মধ্যে বিরোধ দেখা যায়।
অ্যাডমিরাল (অব) খুরশীদ আলম বলছেন, ‘খনিজ সম্পদের কারণেই মহীসোপানের এতো গুরুত্ব। তেল, গ্যাস, সালফার, মেটালিক মডিউল, কোবাল-সব কিছুর মালিক আপনি।’ যেমন এসব এলাকার মধ্যে বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্লক রয়েছে।
২০১৪ সালে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ মীমাংসায় আন্তর্জাতিক সালিশ আদালতের এক রায়ে বাংলাদেশ নতুন প্রায় সাড়ে ১৯ হাজার বর্গকিলোমিটার সমুদ্র এলাকা পেয়েছে । এর মধ্য দিয়ে নিজস্ব সমুদ্রসীমার বাইরে মহীসোপানে এক বিরাট এলাকার ওপর বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
এই এলাকায় মৎস্য আহরণ ও সমুদ্রের তলদেশে প্রাকৃতিক সম্পদ অনুসন্ধান ও উত্তোলনে বাংলাদেশের অধিকার নিশ্চিত হয়েছে বলে বাংলাদেশের কর্মকর্তারা বলেছেন। ‘এ রায়ের ফলে বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারের বেশি টেরিটোরিয়াল সমুদ্র, ২০০ নটিক্যাল মাইল একচ্ছত্র অ ল এবং চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানের তলদেশ অবস্থিত সব ধরণের প্রাণীজ ও অপ্রাণীজ সম্পদের উপর সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে।’ বলেছিলেন তখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী।
বাংলাদেশ ও ভারতের মহীসোপান ইস্যু: ২০১১ সালে জাতিসংঘে মহীসোপানের নিজেদের প্রাপ্য দাবি করে আবেদন করে বাংলাদেশ। যদিও ২০২০ সালের অক্টোবরে ওই দাবির বিষয়ে সংশোধনী দেয় ঢাকা। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিটের সচিব রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব) মোঃ খুরশীদ আলম বলছেন, ‘মহীসোপান সব দেশেরই একটা অধিকার। সব দেশে ২০০ মাইল পর্যন্ত ইইজেড পাবে, আর সাড়ে তিনশো মাইল পর্যন্ত মহীসোপান পাবে।’
বাংলাদেশ নিজেদের মহীসোপান এলাকা দাবি করে ২০১১ সালে জাতিসঙ্ঘের মহীসোপান নির্ধারণ বিষয়ক কমিশনে (সিএলসিএস) আবেদন করেছিল। মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্র সীমা নির্ধারণ বিষয়ক আন্তর্জাতিক মামলায় যথাক্রমে ২০১২ এবং ২০১৪ সালে প্রদত্ত রায়ে বাংলাদেশ জয়লাভ করে।
সেই রায়ে মহীসোপানের সীমানা আলাদাভাবে নির্ধারণ করার কারণে ২০২০ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশ সিএলসিএসে সংশোধনী জমা দেয়। গত শুক্রবার ওই সীমানার ব্যাপারে আপত্তি দিয়ে ভারত বলছে, বাংলাদেশ ভূখ-ের যে বেসলাইনের ওপর ভিত্তি করে মহীসোপান নির্ধারণ করেছে, সেটির মাধ্যমে ভারতের মহীসোপানের একটি অংশ দাবি করছে বাংলাদেশ। এছাড়া সেখানে বঙ্গোপসাগরে থাকা গ্রে এরিয়া সম্পর্কে বাংলাদেশ কোন তথ্য দেয়নি। এর আগে ভারত যে বেসলাইনের ভিত্তিতে মহীসোপানের দাবি তুলেছিল, সেটির বিরুদ্ধেও বাংলাদেশ ২০০৯ সালে আপত্তি জানিয়েছে। সেই আপত্তি এখনো রয়েছে। যদিও বঙ্গোপসাগরের প্রতিবেশী আরেক দেশ মিয়ানমার বাংলাদেশের মহীসোপান দাবি ইস্যুতে কোন আপত্তি তোলেনি।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিটের সচিব রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব) মোঃ খুরশেদ আলম বলছেন, ‘ভারতের আপত্তির ব্যাপারে আমি আইনগত জোরালো কোন ভিত্তি দেখছি না। কারণ আমাদের মহীসোপান আদালত থেকে ফয়সালা করে দেয়া হয়েছে। সুতরাং ভারতের আপত্তির কোন আইনগত ভিত্তি নেই বলেই আমি মনে করি। তারপরেও তাদের আপত্তির বিষয়টি পরীক্ষা নিরীক্ষা করে আমরা জাতিসঙ্ঘে জবাব দেবো।’ তিনি বলছেন, আপত্তির যেসব পয়েন্ট ভারত তুলে ধরেছে, তার সঙ্গে মহীসোপানের কোন সম্পর্ক নেই। কারণ পানির বিষয়ে আপত্তির সঙ্গে তো মহীসোপানের বিষয় মেলে না।
এই বিরোধের ব্যাপারে কারা সিদ্ধান্ত দেবে? বাংলাদেশ ও ভারতের মহীসোপান সংক্রান্ত বিরোধের ব্যাপারে সুপারিশ দেবে জাতিসঙ্ঘের মহীসোপান নির্ধারণসংক্রান্ত কমিশন (সিএলসিএস)। দুই দেশের বক্তব্য বিচার বিশ্লেষণ করে সংস্থাটি তাদের সুপারিশ জানাবে। সেই সুপারিশের ব্যাপারেও আবার আপত্তি জানানো যাবে। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যেহেতু আদালত সীমানা নির্ধারণ করে দিয়েছে, তার বাইরে বাংলাদেশের যাওয়ার সুযোগ নেই। ‘কোর্টের রায় যেটা আমরা পেয়েছি, সেটাই আমরা পাবো। সেটার ওপরেই চেয়েছিলাম যে, তাদের (জাতিসংঘের) যে একটা রোল এখানে আছে, সেটাই যেন তারা পূর্ণ করে।’ বলছিলেন আলম। কোন দেশ মানতে রাজি না হলে তারা পুনর্বিবেচনার পর আবার সিএলসিএসে যেতে পারে। কিন্তু চূড়ান্ত যে সুপারিশ তারা দেবে, সেটা সব দেশকে মানতে হয়, সেটাই নিয়ম, বলছেন অ্যাডমিরাল খুরশীদ আলম। এখানে আদালতের মতো কোন শুনানি হয় না। তবে সিএলসিএসের যে কমিটি রয়েছে, সেখানে সংশ্লিষ্ট দেশ তথ্য-প্রমাণসহ একটি প্রেজেন্টেশন দিতে পারে। সূত্র : বিবিসি