সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:৩৮ পূর্বাহ্ন

১২শ’ লাশ দাফন করেও আক্রান্ত হয়নি কেউ

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় শনিবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২১

রাত্রির শেষ প্রহর। কিছুক্ষণ পরই ফজরের আজান হবে। ঘুম ভেঙ্গে গেল রজব আলীর। আজকাল ঠিক এই সময়ই ঘুম ভেঙ্গে যায় তার। বিছানা থেকে উঠে হালকা নীল রঙের পাঞ্জাবি আর গামছা নিয়ে খালি পায়ে বেরিয়ে পড়লো। পরনে তার পুরনো একটা লুঙ্গি আর সাদা গেঞ্জি। গন্তব্য রাজধানীর রায়েরবাজার গোরস্থান। রজব আলীর এখন ব্যস্ত সময় কাটে। কিছুদিন ধরে অনেক লাশ আসছে। সে লাশগুলোর পাশে থাকে না কোনো আত্মীয়-স্বজন। বাংলাদেশ জার্নালের সঙ্গে কথা হয় গোরখোদক রজব আলীর। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে খুব ব্যস্ত আছি। দেশে মহামারির কারণে যারা মারা যাচ্ছেন সেই লাশ গুলোর ভরসাতো আমরাই। যতটা সম্ভব যত্মসহকারে লাশগুলোকে দাফন করার চেষ্টা করি।’
তিনি আরো বলেন, ‘কবরে লাশ নামানোর কাজও আমরাই করি। লাশের ওপর বাঁশের চাটাই দেই। এরপর দুই হাত লম্বা বাঁশের টুকরাগুলো একটি একটি করে সাজিয়ে দেই। তারপর কোদাল দিয়ে মাটি দেয়া শুরু করি। এর মধ্যে স্বজনরা এক এক করে এসে এক মুঠো মাটি দেয় কবরে। আস্তে আস্তে কবরে মাটি ভরাট করার পর সমতল থেকে এক ফুট উচ্চতার মাটি বেশি করে স্থাপন করি। এভাবেই করোনায় মৃত ব্যক্তিদের দাফন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করি। সবশেষে দুই হাত তুলে মোনাজাত করি।’
এখানকার ৮ নম্বর ব্লকটি নির্ধারিত করা হয়েছে করোনায় মৃতদের জন্য। গত বছর মার্চ মাসে সারা দেশে করোনা ভাইরাস আক্রান্ত হওয়ার পর প্রথম দফায় খিলগাঁও তালতলা সরকারি কবরস্থানে মৃতদের দাফন শুরু হয়। কিন্তু স্থানসংকুলান না হওয়ায় ২৭ এপ্রিল থেকে রায়েরবাজার কবরস্থানে দাফন শুরু হয়। গতকাল শুক্রবার বিকেলে পর্যন্ত কবরস্থানে করোনায় মারা যাওয়া ১ হাজার ১৮৬টি লাশ দাফন হয়েছে।
সরেজমিনে সেই ব্লকে গিয়ে দেখা যায়, আগে থেকেই প্রায় ১০০ কবর তৈরি করে রাখা হয়েছে। কবরস্থানে লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স প্রবেশের পর দাফনের দায়িত্বে থাকা গোরখোদকরা ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন।
লাশবাহী ফ্রিজিং গাড়ি থেকে স্ট্রেচারে করে সাদা কাফনে মোড়ানো মনিরুজ্জামান নামে এক (৬০) লাশ নামিয়ে আনেন স্বেচ্ছাসেবীরা। মনিরুজ্জামান গাজীপুরে ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রার ছিলেন। করোনা আক্রান্ত হয়ে বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। মনিরুজ্জামানের লাশ গোরখোদকরা কবরে নামান। প্রধান গোরখোদক লিয়াকত আলী, শফিকুল ইসলাম, মানিক, হাসান, হৃদয়, রফিকুল ইসলাম ও সাইফুল ইসলাম একে একে বাঁশের চাটাই নামিয়ে দেন লাশের ওপর। এরপর বাঁশের লাঠি দেয়া হয়। ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি তুলে কোদাল দিয়ে মাটি নামাতে থাকেন কবরে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে মাটি দেয়া সম্পন্ন হয়। এরপর আবারও ব্যস্ত হয়ে পড়েন পাশের খালি কবরে আরেক জনের দাফন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে। রায়েরবাজার কবরস্থানের প্রধান গোরখোদক লিয়াকত আলী সরকার বলেন, এই কবরস্থানে ২৮ জন গোরখোদক রয়েছেন। গত বছর ২৭ এপ্রিল থেকে কবরস্থানের ৮ নম্বর ব্লকে করোনায় মৃত্যু হওয়া ১ হাজার ১৮৫টি লাশ দাফন করেছি। কিন্তু গোরখোদকদের কেউই করোনা আক্রান্ত হননি।
গত বছরের ভয়ংকর অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ওই সময় তো কবরস্থানে আমরা কাউকে পাইনি। এমনও দেখেছি যে অ্যাম্বুলেন্সে করে লাশ এসেছে, কিন্তু কোনো স্বজন আসেননি। স্বেচ্ছাসেবী ও আমরাই লাশ দাফন করেছি। অনেক সময় কবরস্থানের প্রবেশ গেটে দূর থেকে দাঁড়িয়ে স্বজনদের কাঁদতে দেখেছি। তারা একবার লাশ দেখতে চেয়েও লাশ দেখতে পাননি।
তিনি আরো বলেন, কার লাশ কে দাফন করে! এমনও হয়েছে, লাশ দাফনের এক মাস পরে স্বজনরা এসে কবরে নামফলক টাঙিয়ে দিয়েছেন। তখন ছিল করোনার এক অন্ধকার যুগ। এখন তো লাশ দাফন করতে স্বজনরাই আসেন। গোরখোদক সাইফুলের বাড়ি নেত্রকোনার দুর্গাপুরের বাকল জোড়া গ্রামে। ঢাকার রায়েরবাজারে স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে থাকেন। গত বছর এপ্রিল থেকে করোনায় মৃতদের দাফন করছেন। প্রতিদিন কবর খনন ও দাফনকাজ শেষে রাত ১২-১টার দিকে বাসায় ফেরেন। বর্তমানে কেউ কেউ ভোর অবদি কাজ করেন। বাসায় ফেরার পর গোসল করে কাপড় পরিবর্তন করেন। এটুকুই নিরাপত্তাব্যবস্থা। এখন পর্যন্ত তার স্ত্রী ও পরিবারের কেউই করোনা আক্রান্ত হননি। গোরখোদক শফিকুল ইসলাম বলেন, কবর খোঁড়া ও দাফনকাজ শেষ করে রাতে বাসায় ফেরার সময় শুধু মনে হয়, আল্লাহ রাস্তায় জীবনটা সঁপে দিয়েছি। এই করোনায় কত মানুষ আতঙ্কে রয়েছেন। আমরা শুধু জীবন-জীবিকার জন্য কবর খনন করে যাচ্ছি।
একই কথা জানান গোরখোদক মানিকও। তিনি বলেন, স্ত্রী ও দুই মেয়েকে নিয়ে রায়েরবাজার এলাকায় থাকি। কবর খোঁড়া ও লাশ দাফনের পর স্বজনরা ১ হাজার ৫০০ টাকা দেন। এর বেশিও কেউ কেউ দিয়ে থাকেন। তবে ১ হাজার ৫০০ টাকা নেয়া হয় বাঁশ ও চাটাইয়ের দাম হিসেবে। কেউ যদি দিতে না চান, আমাদের কোনো দাবি নেই। আবার অনেকেই খুশি হয়ে এর বেশিও দেন। কবর দেখাশোনার জন্য কেউ কেউ টাকা দেন। তবে সিটি করপোরেশন থেকে কোনো টাকা বা পারিশ্রমিক দেয়া হয় না। রায়েরবাজার কবরস্থানের সিনিয়র মোহরার আব্দুল আজিজ বলেন, ২৭ এপ্রিল থেকে ১৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত করোনায় মারা যাওয়া ৮৪২ জনের লাশ দাফন হয়। প্রতিদিনই পাঁচ থেকে ১০ জন করে দাফন করা হয়। এর পর থেকে দাফনের সংখ্যা কমতে থাকে। তবে ১ এপ্রিল থেকে প্রতিদিন আট থেকে ১০টি লাশ দাফন করা হচ্ছে। শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত করোনায় মৃত ১ হাজার ১৮৬টি লাশ দাফন করা হয়েছে।-বাংলাদেশ জার্নাল




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com