সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০১:৩৭ অপরাহ্ন

বরিশালে বেদে পেশা পরিবর্তন করে রঙিন স্বপ্ন দেখছেন ওরা

শামীম আহমেদ বরিশাল প্রতিনিধি :
  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২১

আগে ওরা আজন্ম ভেসে বেড়াতো। ওদের জন্ম, মৃত্যু ও বিয়ে সবকিছুই হতো জলের ওপর। একেক দলে ২৫/৩০টি সাড়িবদ্ধ নৌকায় পুরো পরিবার নিয়ে ওরা একেকস্থানে ৭ থেকে ১০দিন অবস্থান করে গ্রামের মেঠোপথে ঘুরে পুরুষ সদস্যরা সাপ ধরা ও খেলা এবং নারীরা সিংগা লাগিয়ে ঝাড়ফুঁক দেয়াসহ তাবিজ-কবজ বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। কালের বির্বতনে গত ৩৫ বছর ধরে জল ছেড়ে ওরা গৃহস্থের কাছ থেকে জমি ক্রয়ের মাধ্যমে স্থায়ী বসবাস শুরু করেছেন। ইতোমধ্যে অধিকাংশরা পরিবর্তন করেছেন পূর্ব পুরুষদের পেশা। পুরুষ সদস্যরা স্থায়ী ব্যবসা বাণিজ্য, নদীতে মাছ ধরা ও দিনমজুরের কাজের সাথে নিজেদের জড়িয়ে নিয়ে সমাজের অন্যসব মানুষের মতো বেঁচে থাকার রঙিন স্বপ্ন দেখছেন। নারীরা ছেড়ে দিয়েছেন তাদের পূর্বের পেশা। উচ্চ শিক্ষার আশায় ছেলে-মেয়েদের ভর্তি করেছেন বিভিন্ন স্কুল ও কলেজে। যুবকদের অনেকেই পাড়ি জমিয়েছেন প্রবাসে। এছাড়াও গৃহস্থের ছেলেদের কাছে পল্লীর মেয়ে বিয়ে কিংবা গৃহস্থের মেয়েদের বউ করে এনেছেন পল্লীর ছেলেদের জন্য। ঘটনাটি আড়িয়াল খাঁ নদীর শাখা পালরদী নদীর তীরবর্তী বরিশালের গৌরনদী পৌর এলাকার ২নং ওয়ার্ড টরকীচর এলাকার স্থায়ী বেঁদে পল্লীর। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিগত ৩৫ বছর ধরে নদীর তীরবর্তী ওই এলাকায় জমিক্রয় করে স্থায়ীভাবে বসবাস করে আসছেন শতাধিক বেঁদে পরিবার। এসব পরিবারে সদস্য সংখ্যা প্রায় সহস্রাধীক। টানা ৩৫ বছরে স্থায়ী বসবাস করা বেঁদে পল্লীর লোকজন স্থানীয় বাসিন্দাদের মতো যখন নিজেদের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটিয়েছেন। ছেলেদের প্রবাসে পাঠিয়ে যখন স্থায়ী পল্লীতে গৃহস্থের মতো পাকা বাড়ি করে করে আয়েশি জীবনযাপন করছেন, ঠিক তখনই ওই পল্লীর বাসিন্দাদের ওপর লোলুপ দৃষ্টি পরেছে কতিপয় প্রভাবশালী ব্যক্তির। তারা দীর্ঘদিন থেকে পল্লীর বাসিন্দাদের বিভিন্ন ধরনের হয়রানী করে আসছেন। স্থায়ী বেঁদে পল্লীর বাসিন্দারা জানান, তাদের এ পল্লীর প্রায় অর্ধশতাধিক শিশুরা স্থানীয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত রয়েছে। এছাড়াও প্রায় বিশজন ছেলে-মেয়ে বিভিন্ন মাধ্যমিক স্কুল ও কলেজে পড়াশুনা করছে। তারা আরও জানান, তাদের এ পল্লীতে ভোটার সংখ্যা প্রায় পাঁচ শতাধিক। প্রতিবার ভোটের আগে প্রার্থীরা ভোট নেয়ার জন্য স্থায়ী বেঁদে পল্লীর বাসিন্দাদের জীবনমান উন্নয়নে অসংখ্য প্রতিশ্রুতির ফুল ঝুঁড়ি দিলেও ভোটে বিজয়ী হওয়ার পর আর তাদের খুঁজে পাওয়া যায়না। টরকী বন্দরের সাথে বেঁদে পল্লীর যোগাযোগ ব্যবস্থাই প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। একমাত্র কাঁচা রাস্তাটির দুরবস্থার কারণে এ পল্লীর কোমলমতি শিশু-কিশোরদের স্কুল-কলেজেসহ পল্লীর বাসিন্দাদের যাতায়াতে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। প্রায় দশ একর জমির ওপর গড়ে ওঠা স্থায়ী বেঁদে পল্লীতে নেই স্থায়ী কোন কবরস্থান। অথচ এ বেঁদে পল্লীর পাশে সরকারি অসংখ্য খাস জমি রয়েছে। পল্লীর বাসিন্দারা সেখানে সরকারিভাবে একটি কবরস্থান নির্মানের দাবি জানিয়ে আসছেন দীর্ঘদিন থেকে। সূত্রমতে, সম্প্রতি স্থানীয় সংসদ সদস্য আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর হস্তক্ষেপে ওই পল্লীর বাসিন্দাদের বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত করা হয়েছে। বেঁদে পল্লীর বাসিন্দারা বলেন, স্থানীয় একটি প্রভাবশালী মহল দীর্ঘদিন থেকে চাঁদার দাবিতে তাদের বিভিন্ন ধরনের হয়রানী করে আসছেন। পল্লীর বাসিন্দা হারুন সরদার, স্বপন সরদার, পিন্টু সরদার, বাদল সরদার, রানা সরদার, ইমরান সরদার, মকাই সরদার, লিটন সরদারসহ অন্যান্যরা ওই চক্রের বিরুদ্ধে একাধিকার তীব্র প্রতিবাদ করেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে প্রভাবশালীরা নতুন করে উল্লেখিতদের বিরুদ্ধে হয়রানীর জন্য বিভিন্ন ধরনের অপপ্রচার শুরু করেছেন। স্থানীয় ওই প্রভাবশালীদের ষড়যন্ত্র থেকে মুক্তি পেতে বেঁদে পল্লীর বাসিন্দারা স্থানীয় সংসদ সদস্যসহ প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। পল্লীর বাসিন্দা আব্দুর রব সরদার, লিটন হাওলাদার, উজ্জল বালী, ইলিয়াস খান ও মহিউদ্দিন হাওলাদার জানান, তাদের পূর্ব পুরুষরা বেঁদে সম্প্রদায়ের হলেও যুগের স্রোতধারায় বর্তমানে তাদের বহু পরিবার মৎস্যজীবী, দিনমজুর, ব্যবসায়ী ও প্রবাসী পরিচয় ধারণ করেছেন। আগে তারা সাপ ধরা, সাপ খেলা দেখানো, বিভিন্ন তাবিজ-কবজ বিক্রি, সিংগা দেয়ার কাজ করলেও এখন আর তারা ওইসব কাজের সাথে যুক্ত নেই। তারা আরও জানান, আগে বেঁদে পরিবারের নারীরাই সংসারের মূল আয়ের দায়িত্ব পালন করতেন। এখন গৃহস্থের ন্যায় পুরুষরা আয় করেন আর নারীরা বাড়িতে বসে ছেলে-মেয়েদের স্কুল-কলেজে পাঠানোসহ সংসারের সকল দায়িত্ব পালন করছেন। ওই পল্লীর বাসিন্দা লালন খানের স্ত্রী তমা বেগম জানান, নৌকায় বসবাসরত অবস্থায় গত ২০ বছর পূর্বেও তিনি গ্রামঘুরে সিংগা লাগিয়ে তাবিজ-কবজ বিক্রি করেছেন। টরকীচরে তার স্বামী তাদের নিয়ে স্থায়ী বসবাসের পর সে (লালন) স্থানীয়ভাবে ব্যবসা শুরু করেছেন। এরপর থেকেই তিনি (তমা) পূর্বের পেশা ছেড়ে দিয়ে এখন সন্তানদের শিক্ষিত করার স্বপ্ন দেখছেন। বরিশাল পলিটেকনিক ইনষ্টিটিউটে অধ্যায়নরত এ পল্লীর বাসিন্দা পান্নু সরদার, সরকারি গৌরনদী কলেজে অধ্যায়নরত মনির হোসেন, টরকীবন্দর বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে অধ্যায়নতর মহিমা আক্তার, বাঁধন খানমসহ অন্যান্য শিক্ষার্থীরা বলেন, আমার উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে চাই। স্থানীয় কতিপয় প্রভাবশালী কর্তৃক বেঁদে পল্লীর বাসিন্দাদের হয়রানীর ব্যাপারে গৌরনদী মডেল থানার ওসি মোঃ আফজাল হোসেন বলেন, এ ব্যাপারে থানায় এখনও কেউ লিখিত অভিযোগ দায়ের করেননি। অভিযোগ পেলে গুরুত্বের সাথে তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। গৌরনদী উপজেলা নির্বাহী অফিসার বিপিন চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, বর্তমান সরকার সর্বক্ষেত্রে দলিত ও বেঁদে সম্প্রদায়ের জন্য বিশেষ কোঠা বরাদ্দ করেছেন। সেই কোঠা থেকে টরকীচরের স্থায়ী বেঁদে পল্লীর বাসিন্দারা যেন বঞ্চিত না হয় সে বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, খুব শীঘ্রই স্থায়ী বেঁদে পল্লীটি সরেজমিনে পরিদর্শন করে তাদের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে দ্রুত সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com