লিচুর রাজ্য খ্যাত দিনাজপুরে এবার লিচুর ফলন কম হওয়ায় হতাশ লিচুচাষিসহ সংশ্লিষ্টরা। লিচুর রঙে নিজের মনটা রাঙাতে চাইলেও পারছেন না তারা। এবার তাপমাত্রার তারতম্যের কারণে এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে মুকুল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় লিচুর ফলন অন্তত ৩০ শতাংশ কমেছে। আর যে লিচু বাজারে উঠেছে তার চেহারাও ভালো নয়। বিরূপ আবহাওয়ায় লিচুর দানা বড় হয়নি। তাই লিচু যেমন স্বাদ হারিয়েছে, তেমনি বিষাদে পড়েছেন লিচুচাষিরা। তবে ফলন কম হওয়ায় একটু ভালো লিচু চড়া মূল্যে বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা। দিনাজপুর শহরের সবচেয়ে বড় লিচুর বাজার কালিতলা থেকে গোর-এ-শহীদ বড় ঈদগাহ ময়দানে স্থানান্তর করা হয়েছে। বৈশ্বিক মহামারী করোনা পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ী ও কৃষকরা যেন সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে বেচাকেনা করতে পারেন, সে জন্যই বাজার ফাঁকা মাঠে আনা হয়েছে বলে জানিয়েছেন দিনাজপুর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাকী।
দিনাজপুরের গোর-এ-শহীদ ময়দানের পাইকারি বাজারে গিয়ে দেখা যায়, লিচু ব্যবসায়ীরা অলস সময় পার করছেন। পাইকারি বাজারে কিছু ভিড় থাকলেও খুচরা বাজারে তেমন ক্রেতা লক্ষ করা যায়নি। ইতোমধ্যে পরিমাণে কম হলেও বাজারে সব ধরনের লিচুই চলে এসেছে। মাদ্রাজি, বেদানা, বোম্বাই ও চায়না-থ্রি জাতের লিচুর জমজমাট ব্যবসার এ মৌসুমে ব্যবসায়ীদের মোবাইলে গেম, লুডু খেলে সময় পার করতে দেখা গেছে। পাইকারি বাজারে বিক্রি করতে আসা লিচুচাষি ইলিয়াস হোসেন বলেন, আমি ২৬টি বাগান বিভিন্ন মেয়াদে চুক্তি নিয়েছি। অন্য বছর থেকে এবার ফলন খুব কম হয়েছে। সামান্য কিছু গাছে শুধু ফলন হয়েছে। বাগানে যা খরচ হয়েছে, তা তুলতে পারাই এখন কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে বাজারে দাম চড়া থাকায় হয়তো ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারব। তিনি বলেন, অন্য বছর এই সময় যেখানে আমি ১৫ থেকে ১৭ শ’ টাকা হাজার বিক্রি করতাম সেখানে আজ আমি ২২ শ’ টাকা বিক্রি করেছি। আড়তদার কমিটির সভাপতি রুস্তম আলী বলেন, জেলা প্রশাসক করোনার জন্য এবারো লিচুর বাজার বড় মাঠে স্থানান্তর করেছেন। এখানকার জায়গা ফাঁকা, কোনো রকমের ভিড় নেই। দূরত্ব বজায় রেখে লিচু বিক্রি করা হচ্ছে। বাজারে দেখা যায়, বর্তমানে মাদ্রাজি জাতের ১০০ লিচু বিক্রি হচ্ছে ২৫০-৩০০ টাকায়। বেদানা জাতের ১০০ লিচু বিক্রি হচ্ছে ৫০০-৭০০ টাকা দরে আর চায়না-থ্রি লিচু বিক্রি হচ্ছে ৮০০ থেকে ১২ শ’ টাকায়। পাইকারি বাজারে মাদ্রাজি লিচু প্রতি হাজার বিক্রি হচ্ছে ১৪ শ’ থেকে ২২ শ টাকা পর্যন্ত। বেদানা লিচু বিক্রি হচ্ছে চার হাজার থেকে ছয় হাজার টাকা পর্যন্ত। চায়না-থ্রি লিচু ছয় হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত।
২০ টাকায় এক প্লেট লিচু! দিনাজপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক প্রদীপ গুহ জানান, দিনাজপুরে ২০২০-২১ মৌসুমে ছয় হাজার ৫৪৬ হেক্টর জমিতে লিচুর চাষ হয়েছে। এ বছর লিচুর লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে প্রতি হেক্টরে ৪.৯৭ মেট্রিক টন। জেলায় পাঁচ হাজার ৪১৮টি লিচুবাগানে সাত লাখেরও বেশি গাছ রয়েছে। প্রতি বছর প্রায় ৪০০ কোটি টাকার বেচাকেনা হয় লিচুর মৌসুমে। তিনি জানান, বিরূপ আবহাওয়ার কারণে এবার লিচুর উৎপাদন প্রায় ৩০ শতাংশ কম হয়েছে। এতে সব ধরনের লিচুর ফলন কম হয়েছে এবং দানাও ভালো হয়নি। লিচুর ফলন কম হওয়ার কারণ জানতে চাইলে কৃষিবিদ এ কে এম সাজেদুর রহমান প্রিন্স বলেন, গত বছর কিন্তু লিচুর বাম্পার ফলন হয়েছিল। এই ফলনের পরে গাছের যে পরিচর্যার দরকার, হয়তো সেটি চাষিরা করতে পারেননি। আবার আবহাওয়ার বিরূপ প্রভাব তো রয়েছেই। এবার মুকুল আসার সময় এ অঞ্চলে কয়েক দফা শিলাবৃষ্টি হয়েছে, তাতে মুকুলের অনেকটা ক্ষতি হয়েছে। শুধু তাই নয়, যখন ফল পাকতে বা রঙ আসতে শুরু করে, তখনো শিলাবৃষ্টি হয়। যে কারণে ফল ফেটে যায় এবং ক্ষতস্থান গাছেই পচে যায়। এ ছাড়া ফল উৎপাদনের জন্য কার্বন ও নাইট্রোজেনের অভাব দেখা দেয়ায় মুকুল কম হয়। আর স্বাদ কম হওয়ার কারণ হলো- ফল পরিপূর্ণ হওয়ার পর একটি বৃষ্টি দরকার হয়। সাধারণত প্রতি বছর সেটি হয়; কিন্তু এবার সে বৃষ্টি না হওয়ায় লিচুর রস ও স্বাদে ঘাটতি দেখা দিয়েছে।