সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:২৮ অপরাহ্ন

ক্রোধ দূর করুন : সুস্থ থাকুন

জাফর আহমাদ :
  • আপডেট সময় বুধবার, ৯ জুন, ২০২১

আনাস রা: বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘তোমরা কি আবু দামদামের মতো হতে পারো না? সাহাবিরা প্রশ্ন করলেন, আবু দামদাম কে? তিনি বলেন, ‘তোমাদের আগের যুগের একজন মানুষ। তিনি প্রতিদিন সকালে বলতেন, ‘আমাকে যে গালি দেয় আমি আমার সম্মান তাকে দান করলাম।’ হাদিসটির সনদ সহিহ। (আবু দাউদ, কিতাবুল আদাব, বাব মা জাআ ফির রাজুলি) রাগ-ক্রোধ, হিংসা-বিদ্বেষ মন-মননকে কুলষিত করে, চরিত্রকে করে কালিমাযুক্ত, শরীর অসুস্থ হয়। আমরা যদি নিজেদেরকে এগুলো থেকে মুক্ত করতে পারি তাহলে নিজেই বেশি উপকৃত হবো। অন্তর হিংসার কঠিন ভার থেকে মুক্ত হবে। দেহ-মন সুস্থ থাকবে। সার্বিক প্রশান্তি লাভ করব। রাসূলুল্লাহ সা: এ ব্যাপারে বিশেষ তাগিদ দিয়েছেন এবং একটি দোয়া শিক্ষা দিয়েছেন। কারো প্রতি রাগ সৃষ্টি হলে বা কারো প্রতি বিদ্বেষ দানা বেঁধে উঠলে এই দোয়া পড়তে হবে, ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি কাদ তাসাদ্দাকতু বিইরদি আলা ইবাদিকা।’ অর্থাৎÑ ‘হে আল্লাহ! আমি আমার মর্যাদা-সম্মান আপনার বান্দাদের জন্য দান করলাম।’ চলুন, আমরা সবাই আবু দামদামের মতো হওয়ার চেষ্টা করি। যারা আমাদের গিবত করেছেন, নিন্দা করছেন, গালি দিচ্ছেন তাদের সবাইকে ক্ষমা করে দেই। কী লাভ এগুলোর প্রতিশোধ নিয়ে? বরং লাভের পরিবর্তে এগুলো আপনার আমার দেহ-মনকে ভারাক্রান্ত করে তুলে। বাংলা সাহিত্যের একজন পরিশীলিত সাহিত্যিক বলেছেন, ‘ভুলে যাওয়াটাও আল্লাহর এক বিশেষ রহমত’। তিনি বলেছেন, প্রতিদিন আমরা নানা প্রকৃতির লোকের সাথে যোগাযোগ করে থাকি। এদের অনেকে মনে কষ্ট দেয়, গালি দেয়, কটু কথা বলে, দুর্ব্যবহার করেÑ এগুলো যদি মানুষ নিজের মধ্যে জমা করে রাখত তাহলে আমাদের প্রাত্যহিক জীবন ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়ত। সামাজিক যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত। কিন্তু এগুলো আমরা ভুলে যাই বলে সমাজ ও সভ্যতা এখনো টিকে আছে। অন্যথায় সামাজিক বিপর্যয় সৃষ্টি হতো।
আমরা ক্ষমা করি। মহান আল্লাহ তায়ালাও ক্ষমা করতে বলেছেন। তাহলে আমরাও মহান প্রভুর ক্ষমা পাবো। আল্লাহ তায়ালা কুরআনে মুসলমানদের একটি গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক শিক্ষা দিয়েছেন। ‘হে আমাদের রব! আপনি আমাদের ক্ষমা করুন এবং আমাদের আগে যারা ঈমানের সাথে বিদায় হয়েছেন তাদেরকেও ক্ষমা করুন। আর মুমিনদের বিরুদ্ধে আমাদের হৃদয়ে হিংসা, বিদ্বেষ রাখবেন না। হে আমাদের রব! নিশ্চয় আপনি মহাকরুণাময়, পরম দয়ার্দ্য।’ (সূরা হাশর-১০)
এ আয়াতের দাবি হলোÑ কোনো মুসলমান অন্য কোনো মুসলমানের বিরুদ্ধে ঘৃণা-বিদ্বেষ ও শত্রুতা থাকা উচিত নয়। মুসলমানদের সঠিক জীবনাচার হলো, তাদের পূর্ববর্তী মুসলমান ভাইদের লানত বা অভিশাপ দেবে না কিংবা তাদের সাথে সম্পর্কহীনতার কথা বলবে না। বরং তাদের মাগফিরাতের জন্য দোয়া করতে থাকবে। যে বন্ধন মুসলমানদের পরস্পর সম্পর্কিত করেছে তা হলো ঈমানের বন্ধন। কোনো ব্যক্তির অন্তরে অন্য সব জিনিসের চেয়ে ঈমানের গুরুত্ব যদি অধিক হয় তাহলে ঈমানের বন্ধনের ভিত্তিতে তার ভাই, সে অনিবার্যভাবেই তাদের কল্যাণকামী হবে। তাদের জন্য অকল্যাণ, হিংসা-বিদ্বেষ এবং ঘৃণা কেবল তখনই তার অন্তরে স্থান পেতে পারে যখন ঈমানের মূল্য ও মর্যাদা তার দৃষ্টিতে কমে যাবে এবং অন্য কোনো জিনিসকে তার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে শুরু করবে। তাই ঈমানের সরাসরি দাবি, একজন মুমিনের অন্তরে অন্য কোনো মুমিনের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও হিংসা-বিদ্বেষ থাকবে না।
আনাস রা: থেকে বর্ণিতÑ তিনি বলেন, এক সময় রাসূলুল্লাহ সা:-এর মজলিসে একাধারে তিন দিন একটি ঘটনা ঘটতে থাকল। রাসূলুল্লাহ সা: বলতেন, ‘এখন তোমাদের সামনে এমন এক ব্যক্তির আগমন হবে যে জান্নাতের অধিবাসী। আর প্রত্যেকবারই একজন আনসারদের কোনো একজন হতেন সেই আগন্তুক। এতে আবদুুল্লাহ ইবনে আসের মধ্যে কৌতূহল দেখা দিলো যে, তিনি এমন কী কাজ করেন যার ভিত্তিতে নবী সা: তার সম্পর্কে বারবার এই সুসংবাদ দান করলেন। সুতরাং তার ইবাদতের অবস্থা দেখার জন্য একটা উপলক্ষ সৃষ্টি করে তিনি পরপর তিন দিন তার বাড়িতে গিয়ে রাত কাটাতে থাকলেন। কিন্তু রাতের বেলা তিনি কোনো প্রকার অস্বাভাবিক কাজ-কর্ম দেখতে পেলেন না। বাধ্য হয়ে তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ভাই আপনি এমন কী কাজ করেন, যে কারণে আমরা নবী সা:-এর মুখে আপনার সম্পর্কে বিরাট সুসংবাদ শুনেছি। তিনি বললেন, আমার ইবাদত-বন্দেগির অবস্থা তো আপনি দেখেছেন। তবে একটি বিষয় হয়তো এর কারণ হতে পারে। আর তা হলো, ‘আমি আমার মনে মধ্যে কোনো মুসলমানের জন্য বিদ্বেষ পোষণ করি না এবং মহান আল্লাহ তাকে যে কল্যাণ দান করেছেন সে জন্য তাকে হিংসাও করি না।’ (নাসায়ি)
তবে এর মানে এই নয় যে, কোনো মুসলমান অন্য কোনো মুসলমানের কথা ও কাজে যদি কোনো ত্রুটি দেখতে পান তাহলে তাকে তিনি ত্রুটি বলবেন না। কোনো ঈমানদার ভুল করলেও সেটাকে ভুল না বলে শুদ্ধ বলতে হবে কিংবা ভ্রান্ত বলা যাবে নাÑ ঈমানের দাবি কখনো তা নয়। কিন্তু কোনো জিনিসকে প্রমাণের ভিত্তিতে ভুল বলা এবং ভদ্রতা রক্ষা করে তা প্রকাশ করা এককথা আর শত্রুতা ও হিংসা-বিদ্বেষ পোষণ করা নিন্দাবাদ ও কুৎসা রটনা করা এবং গালমন্দ করা আরেক কথা। সমসাময়িক জীবিত লোকদের বেলায়ও এরূপ আচরণ করা হলে তা একটি বড় অন্যায়। কিন্তু আগের মৃত লোকদের সাথে এরূপ আচরণ করলে তা আরো বড় অন্যায়। কারণ এরূপ মন ও মানসিকতা এমনই নোঙরা যে, তা মৃতদেরও ক্ষমা করতে প্রস্তুত নয়।
হৃদয়কে হিংসা-বিদ্বেষ ও অন্যের অকল্যাণ চিন্তা থেকে পবিত্র রাখার অভাবনীয় সওয়াবের কথা আমরা জানতে পারলাম। আমরা দেখেছি, এভাবে হৃদয়কে বিদ্বেষ, হিংসা ও ঘৃণামুক্ত রাখা রাসূলুল্লাহ সা:-এর অন্যতম সুন্নাহ যা তিনি বিশেষভাবে পালন করার নির্দেশ দিয়েছেন। একটু চেষ্টা করলে আল্লাহর রহমতে আমরাও এ গুণ অর্জন করতে পারব। গালি শুনে, গিবতের কথা শুনে বা অন্য কোনো কারণে কারো বিরুদ্ধে মনের মধ্যে ক্রোধ, হিংসা, বা বিদ্বেষ সঞ্চিত হলে বেশি বেশি আল্লাহর জিকিরের মাধ্যমে মনকে যথাশিগগিরই শান্ত করার চেষ্টা করতে হবে। কিছুটা শান্ত হলে নিজের জন্য এবং ওই ব্যক্তির জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করতে হবে। যেন আল্লাহ আমাকে ও তাকে মাফ করে দেন এবং উভয়কে যেন আল্লাহ তার সন্তুষ্টির পথে চলার তাওফিক দেন। লেখক : ম্যানেজার, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড, জিন্দাবাজার শাখা, সিলেট।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com