ঊর্ধ্বমুখী চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে বেসরকারিভাবে ১০ লাখ টন সেদ্ধ চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। খাদ্যশস্যের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা বিষয়ে অনলাইন মতবিনিময় সভায় কার্যবিবরণী থেকে এ তথ্য জানা গেছে। গত ১ জুলাই এই সভা হয়, খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার এতে সভাপতিত্ব করেন। সভায় সিদ্ধান্ত হয়, প্রাথমিকভাবে ২৫ শতাংশ আমদানি শুল্কে ১০ লাখ টন চাল বেসরকারি পর্যায়ে আমদানির প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। বাজারদর স্থিতিশীল রাখার স্বার্থে খাদ্য মন্ত্রণালয় প্রয়োজনে এ পরিমাণ কমাতে-বাড়াতে পারবে। ওই সভায় খাদ্যমন্ত্রী বলেন, মোটা চালের ব্যবহার কমে এখন চিকন চালের চাহিদা বেড়েছে। যদি বেসরকারিভাবে নন বাসমতি সিদ্ধ/আতপ সরু চাল আমদানি করা হয়, তাহলে বাজারে দাম কিছুটা নিয়ন্ত্রণ হবে।
কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, এবার প্রতি মণ ধানের দাম এক হাজার ৮০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে কৃষক ন্যায্যমূল্য পেয়েছে কারণ একজন কৃষকের মণপ্রতি উৎপাদন খরচ ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকার বেশি হয়নি। অতএব আমদানি করলে কৃষক কোনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। বোরো ধান কাটার পরও চালের দাম বেড়েছে, তাই আগের ধারাবাহিকতায় সরকারি আমদানির সঙ্গে বেসরকারিভাবে চাল আমদানি করতে হবে। সভায় চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে আমদানি শুল্ক কমিয়ে বেসরকারিভাবে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ চাল আমদানির পরামর্শ দেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। খাদ্য সচিব মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম বলেন, নীতিমালা অনুযায়ী ১০ লাখ টন খাদ্যশস্য মজুদ রাখতে হয়। এক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ সংগ্রহের মাধ্যমে প্রায় ৫ লাখ টন এবং বৈদেশিক সংগ্রহের মাধ্যমে প্রায় ৫ লাখ টন সংগ্রহ হবে। যা বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য পর্যাপ্ত নয়। কৃষককে ধানের ন্যায্যমূল্য প্রদান, সেই সঙ্গে বাজার নিয়ন্ত্রণে বেসরকারি পর্যায়ে আমদানি প্রয়োজন।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মেজবাহুল ইসলাম বলেন, ‘কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর ও বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী বোরো ধান ২ কোটি ৮ লাখ টন হওয়ার পরও দেখা যাচ্ছে চালের দাম বেশি। চালের দাম বৃদ্ধির কারণ জানতে হলে হিউম্যান খাতে খাদ্যশস্য ও নন-হিউম্যান খাদ্যশস্যের প্রকৃত চাহিদার পরিমাণ কত তা জানতে হবে।’
ফলন বাম্পার তবুও কেন চাল আমদানি? সদ্যবিদায়ী ২০২০-২১ অর্থবছরেও বোরোর বাম্পার ফলন হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হওয়ায় এ পর্যন্ত বোরো ধানের সংগ্রহ পরিস্থিতিও সন্তোষজনক। করোনা মহামারির এই বিদ্যমান পরিস্থিতিতেও ধান, চাল ও গমের সরবরাহ স্বাভাবিক। এখনও পর্যন্ত চাহিদা মিটিয়েও ৩০ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকার কথা। তারপরও কেন আবার চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার? খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মিলার ও ব্যবসায়ীদের কঠিন যোগসাজশ ও কারসাজিতে বাড়ছে চালের দাম। দেশে চালের উৎপাদন, সরবরাহ, আমদানি ও মজুত পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকার পরও বাড়ছে চালের দাম। কারণে অকারণেই সুযোগ পেয়েই চালের দাম বাড়িয়ে অনৈতিক মুনাফা করছেন ব্যবসায়ীরা। কোনওভাবেই চালের বাজারের এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। আমদানি করা হলেও চালের বাজার স্থিতিশীল করা যায়নি। আগামীতে চাল নিয়ে যাতে কোনওপ্রকার বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে না হয় সেজন্যই সরকার আবারও চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানা গেছে। খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, কোনওভাবেই চালের বাজার অস্থিতিশীল হতে দেওয়া হবে না। এ কারণেই অভ্যন্তরীণ চাল সংগ্রহ আরও জোরদার করার পাশাপাশি বিদেশ থেকেও চাল আমদানি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ কারণেই ২৫ শতাংশ কর আরোপ করে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় শিগগিরই নন বাসমতি সেদ্ধ চাল আমদানির করা হবে। গত ১ জুলাই খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ওই সভায় বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ও কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, সদ্য বিদায়ী ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে চলতি ২০২১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত দেশে চালের চাহিদা মিটিয়ে আরও ৩০ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকবে। দেশে প্রতি মাসে চালের চাহিদা রয়েছে ২০ লাখ ২৮ হাজার টন। সেই হিসেবে বছরে দেশে চালের চাহিদা প্রায় ২ কোটি ৪৩ লাখ ৩৬ হাজার টন। সদ্য বিদায়ী ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে ধান ও গম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩৯৫ কোটি ৫৩ লাখ টন। ২০১৯-২০ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছে ৩৭৬ কোটি ৩২ লাখ টন। সদ্যবিদায়ী ২০২০-২১ অর্থবছরের মে মাস পর্যন্ত খাদ্য আমদানি হয়েছে ৬১ লাখ ৮২ টন। এর আগের ২০১৯-২০ অর্থবছরে আমদানি হয়েছিল ৬০ লাখ ৪০ হাজার টন।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, কোনওভাবেই দেশে আবারও চাল আমদানির মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি। কিন্তু মিলার ও ব্যবসায়ীদের কারসাজির কারণে সৃষ্ট অস্থির চালের বাজারে স্থিতিশীলতা আনতেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। কারণ বিদ্যমান করোনা পরিস্থিতিতে সরকারের নানামুখী কর্মসূচির আওতায় কর্মহীন পরিবারগুলোকে খাদ্য সহায়তা বাবদ চাল দেওয়া হচ্ছে। করোনা যতদিন থাকবে সরকারের এসব কর্মসূচি চলবে, তাই এসব কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সরকার যাতে কোনওভাবেই বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি না হয় সে জন্যই চাল আমদানি করে নিজস্ব মজুত গড়তে চায়। এদিকে নানা অজুহাতেই চালের দাম বাড়তি মূল্যে স্থিতিশীল হয়ে আছে। কোনওভাবেই মোটা চালের কেজি ৫০-৫৫ টাকার নিচে নামছে না। এমন পরিস্থিতিতে করোনার কারণে চলমান লকডাউন পরিস্থিতিতে কর্মহীন পরিবারের জন্য চাল কিনতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন এসব পরিবারের অভিভাবকরা। ৩০ টাকা কেজি দরে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার রাস্তার ধারে বিক্রি করা খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ভ্রাম্যমাণ ট্রাক এবং ভর্তুকি মূল্যে ডাল, তেল, চিনি বিক্রি করা টিসিবির ট্রাকের সামনে ক্রেতাদের লাইন প্রতিদিনই লম্বা হচ্ছে। পাঁচ কেজি চাল কেনার জন্য এসব ট্রাকের সামনে একজন ক্রেতাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাড়িয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে।
নওগাঁর মিলার লায়েকুজ্জামান জানিয়েছেন, ধানের উৎপাদন ভালো হয়েছে, বাম্পার ফলন হয়েছে, সবই ঠিক আছে। কিন্তু সেই ধান তো বাজারে আসেনি। ধান বেশি দামের আশায় কৃষকরা নিজের গোলায় রেখে মজুত করেছে। কৃষকরা ধান বিক্রি করছেন না। তারা বেশি দাম পেলে বিক্রি করবেন। এ কারণে ধানের সরবরাহ কমেছে বিধায় দাম বেড়েছে ধানের। এমন পরিস্থিতিতে মিলাররা বাধ্য হয়ে তাদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে বেশি দামেই ধান কিনছে। এর ফলে উৎপাদিত চালের দাম বাড়ছে। এদিকে বাদামতলীর পাইকারি ব্যবসায়ী আব্দুল লতিফ জানিয়েছেন, বাজারে চালের কোনও ঘাটতি নেই। বাজার ভরা চাল আছে। তবু মিলাররা দাম বাড়াচ্ছেন। ফলে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে দামও বাড়ছে। রাজধানীর কোনাপাড়ার খুচরা ব্যবসায়ী আবুল হাশেম জানিয়েছেন, পাইকারি বাজারে দাম ও পরিবহণ খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণে চালের দাম বেড়েছে। বাজারে খোজ নিয়ে জানা গেছে, সম্প্রতি সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের ফলে জুনের শেষ সপ্তাহে বিভিন্ন প্রকার চালের দাম কেজিতে ২ টাকা কমলেও তা এখনও ক্রেতাদের ক্রয়সীমার অনেক বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। মিনিকেটের দাম কেজিতে ১৫ টাকা বেড়ে হয়েছে ৬৫ টাকা। এ থেকে কমেছে ২ টাকা। এখন মিনিকেট বিক্রি হয়েছে ৬৩ টাকা কেজি দরে। জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে একদিকে লকডাউন অপরদিকে অতিবৃষ্টির অজুহাতে সেই মিনিকেট এখন বিক্রি হচ্ছে ৬৭ থেকে ৬৮ টাকা কেজি দরে। আর মধ্যমানের নাজিরশাইল ৬৮ থেকে ৭২ টাকা কেজি দরে বিক্রি হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, নানা ধরনের কারসাজি করেই মুনাফা লুটে নিতে ব্যবসায়ীরা চালের বাজারকে অস্থির করে রেখেছে। এর সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা না হওয়ার কারণেই মূলত একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। খাদ্যমন্ত্রী বারবার এ বিষয়ে হুঁশিয়ারি দিলেও তা সেখানেই থেমে আছে। ফলে অসাধু ব্যবসায়ীরা নানা অজুহাতে ভোক্তাদের পকেট থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে নিচ্ছে। ফলে ধানের বাম্পার ফলন, বিদেশ থেকে চাল আমদানির পরও সুফল পাচ্ছেন না ক্রেতারা। এদিক চাল আমদানির বিষয়ে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার জানিয়েছেন, কোনওভাবেই চালের বাজার অস্থিতিশীল হতে দেওয়া হবে না। যে কোনও নেতিবাচক পরিস্থিতি এড়াতে অভ্যন্তরীণ চাল সংগ্রহ জোরদার করার পাশাপাশি বিদেশ থেকেও চাল আমদানি করা হবে। খাদ্যমন্ত্রী বলেন, প্রান্তিক কৃষক অনেক আগেই ধান বিক্রি করে দিয়েছেন। মিল মালিকরা বলছেন অতিরিক্ত লাভের আশায় কৃষক নন এমন অনেকেই ধান মজুত করছেন। কেউ যদি অবৈধ মজুত করে থাকেন তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনা হবে। কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক জানিয়েছেন, কৃষক ধানের ন্যায্যমূল্য পেয়েছে। আমদানি করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করলে প্রকৃত কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি জানিয়েছেন, খাদ্য চাহিদার সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলে বেশি আমদানি কৃষকের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। আবার কম আমদানিতে ভোক্তার কষ্টের কারণ হতে পারে। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে চাল আমদানির অনুমতি দেওয়া হবে।