বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড অনুযায়ী, টানা দুই সপ্তাহ দৈনিক শনাক্তের হার পাঁচ শতাংশের নিচে থাকলে করোনা পরিস্থিতি ‘নিয়ন্ত্রণে আছে’ ধরা হয়। সেই হিসেবে দেশে করোনা সংক্রমণ এখন নিম্নমুখী। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঈদের আগে-পরে সরকারঘোষিত বিধিনিষেধের কারণে গত কয়েকদিনে শনাক্তের হার ও মৃত্যু কমেছে। কিন্তু কোনোভাবেই এতে আত্মতুষ্টিতে থাকা যাবে না। বরং, মানুষ এখন যে স্বাস্থ্যবিধি মানছে না, তাতে সংক্রমণের হার ফের বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন তারা।
দুই মাসের মধ্যে করোনায় সর্বনিম্ন মৃত্যু হলো গত ২৪ ঘণ্টায়। এ সময় ১০২ জনের মৃত্যুর খবর দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। গত ২৪ ঘণ্টায় শনাক্ত হয়েছেন চার হাজার ৬৯৮ জন। শনাক্তের হার ১৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ। গতকাল শনাক্তের হার ছিল ১৫ শতাংশের নিচে। টানা ৭০ দিন পর দেশে শনাক্তের হার ১৫ শতাংশের কম হলো গত বৃহস্পতিবার। ‘এখন সংক্রমণ কমছে, মৃত্যুও কমছে।’ এমনটা জানিয়ে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)-এর উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ঈদের আগে-পরে যে বিধিনিষেধ ছিল, ১০ আগস্ট পর্যন্ত তারই প্রতিফলন দেখা গেছে। ‘মৃত্যু আরও তিন সপ্তাহ পর্যন্ত কমতে পারে। তবে এরপর সংক্রমণ বাড়তে পারে। কিন্তু সেটা ধীরে ধীরে বাড়বে নাকি দ্রুত বাড়বে তা নির্ভর করছে সংক্রমণের ক্লাস্টারগুলো ভেঙে দেওয়া গেছে কিনা তার ওপর।’ বলেন মহামারি বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন।
‘ক্লাস্টার (একই জায়গায় কম দূরত্বে একাধিক রোগী) যদি ভেঙে যায়, তবে ধীরে ধীরে সংক্রমণ বাড়বে। এক-দুই মাস সময় নেবে বিপজ্জনক মাত্রায় উঠতে। আর যদি ক্লাস্টার থাকে, তবে গত ঈদের পর যেভাবে বেড়েছিল সেভাবে বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।’ বলেন তিনি।
ডা. মুশতাক বলেন, ‘কর্তৃপক্ষের কাজ হচ্ছে প্রতিটি শনাক্ত রোগীকে ব্যবস্থাপনায় নিয়ে আসা। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে সহায়তা করা। কমিউনিটিরও এ দায়িত্ব আছে। টিকাদান কর্মসূচিতেও সবার অংশগ্রহণে সহায়তা করতে হবে। তবেই সংক্রমণ কমবে।’ সাধারণ মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে সরকারকে ‘কঠোর’ হওয়া উচিত কিনা প্রশ্নে ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘কঠোর শব্দটির সঙ্গে একমত নই। সরকারকে সহায়তা দিতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে যেসব উপকরণ দরকার তাতেও যেন ঘাটতি না থাকে।’
এদিকে সারা বিশ্বে ডেলটার দাপট চলছে এখনও। অন্তত ১৪২টি দেশে করোনার অতিসংক্রামক এ ধরন ছড়িয়েছে। ডেল্টার দাপটে ২৫ জুলাই থেকে ১২ আগস্ট পর্যন্ত প্রতিদিন দেশে দুই শ’রও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ৫ ও ১০ আগস্টে একদিনে সর্বোচ্চ ২৬৪ জনের মৃত্যুর রেকর্ড হয়েছে দেশে। এদিকে ১০ আগস্ট সর্বোচ্চ মৃত্যুর দিনে করোনায় দেশে মোট মৃত্যু ছাড়িয়ে গেছে ২৩ হাজার। ২৮ জুলাই একদিনে সর্বোচ্চ ১৬ হাজার ২৩০ জন শনাক্ত হন। ঈদের পরে কঠিন বিধিনিষেধের কারণে ধীরে ধীরে কমতে থাকে শনাক্তের সংখ্যা। গত ১৩ আগস্টে দৈনিক শনাক্ত ১০ হাজারের নিচে নেমে আসে।
করোনা কি চলে যাচ্ছে? ভারতের কলকাতা থেকে প্রকাশিত বিখ্যাত আনন্দবাজারের এক প্রতিবেদনে ্এি প্রশ্নের বিস্তারিত উত্তর তুলে ধরা হয়েছে গতকাল শুক্রবার। প্রতিবেদনটি দৈনিক খবরপতের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা ধরা হলো: ‘শেষের সে দিন ঘনিয়ে আসছে? পুজো কাটবে নিশ্চিন্তে? নাকি তৃতীয় তরঙ্গ কিছু দিনেই দরজায় কড়া নাড়বে? এ নিয়ে জল্পনা, আলোচনা চলছিলই। তাতে ঘি ঢেলেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)। তাদের প্রধান বিজ্ঞানী সৌমা স্বামীনাথন জানিয়েছেন, সম্ভবত পরিস্থিতি বদলাচ্ছে ভারতে। এন্ডেমিক কিংবা জাতিগত রোগে পরিণত হচ্ছে করোনা।
এ কি আদৌ আশার কথা? নাকি চিন্তার? যে পর্যায়ে পৌঁছে একটি জাতি ভাইরাসকে সঙ্গে নিয়েই বাঁচতে শিখে যায়, ভাইরাসকে সঙ্গী করেই জীবন কাটায়, সেই পর্যায়কে বলা হয় ‘এন্ডেমিক’। ভারত অতিমারির এই পর্যায়ের দিকেই এগোচ্ছে বলে মনে করছে ‘হু’। আমেরিকার সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি)-এর মতে, কোনও ভৌগোলিক এলাকায় যে রোগ জনজাতির মধ্যে সর্বদাই উপস্থিত থাকে, তাকেই বলে জাতিগত রোগ। এই ব্যাখ্যা ধরে যদি এগোই, তবে কী বুঝতে হবে? করোনার দাপট খানিকটা সয়ে গিয়েছে এ দেশের মানুষের। ভাইরাসের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েই চলতে শিখছে সমাজ। করোনার সঙ্গে আপস করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সকলের শরীরও। কেউ এক বার সংক্রমিত হচ্ছেন। কেউ একাধিক বার। কেউ আবার এক বারও নয়। কিন্তু শরীর পরিচিত হচ্ছে ভাইরাসের সঙ্গে। গত দেড় বছরে অনেক বেশি মানুষের শরীর করোনার সঙ্গে পরিচিত। সব মিলে সমাজের নানা স্তরে মিশে গিয়েছে এই ভাইরাস। এখন আর তা অচেনা শত্রু নয়।
শুধু ভারত নয়, সর্বত্রই এমনটা হওয়ার কথা বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা। মাস কয়েক আগে ‘নেচার’ পত্রিকায় প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে বলা হয়েছিল, বছর পাঁচ পরে হঠাৎ সর্দি-জ্বর হলে সেটা আবার আগের মতো স্বাভাবিক মনে হবে। হয়তো পরীক্ষা করলে দেখা যাবে, সংক্রমণের উৎসে রয়েছে সেই করোনাভাইরাস, যা কিছু বছর আগে বিশ্ব জুড়ে প্রাণ কেড়েছে কোটি কোটি মানুষের। এ ভাবেই একটি মহামারি ধীরে ধীরে জাতিগত রোগের আকার নেয়। অর্থাৎ, যে রোগের শেষ নেই। কারণ, সেই রোগ মিশে যায় সমাজের বিভিন্ন স্তরে। আর পাঁচটি অসুখের মতোই হয়ে যায়।
কিন্তু করোনাভাইরাস যে সর্বত্র রূপ বদলে ফিরে আসছে? নিত্য নতুন উপসর্গও দেখা দিচ্ছে। ঘরে ঘরে করোনায় মৃত্যুর খবর এখনও আসছে। কিন্তু হাসপাতালে শয্যার ঘাটতি কমছে। ডেল্টা রূপ নিয়ে চিন্তার মেঘ ঘন হচ্ছে ঠিকই। বিভিন্ন দেশে নতুন করে লকডাউনও চালু হচ্ছে। আবার যে ডেল্টারূপী ভাইরাস নিয়ে এত ভয়, দেখা যাচ্ছে তাতে সংক্রমিত হওয়ার পরেও অনেকের স্বাদ-গন্ধের অনুভূতি আগের মতোই আছে। হয়তো বা সাধারণ জ্বর-সর্দির মতো কয়েক দিনে কেটে যাচ্ছে অসুস্থতা। অর্থাৎ পরিস্থিতির তীব্রতা কমছে।
এর মানে কী? করোনা কি চলে যাচ্ছে? নাকি মানুষের সঙ্গে কখনও ছাড়বে না এই ভাইরাস? আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিমারি বিশারদের বক্তব্য, ভাইরাস তা-ব কমাতে পারে। কিন্তু অত সহজে নিরুদ্দেশ হয় না। হার্ভার্ডের ইম্যুনোলজি অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজের তিন অধ্যাপক ইয়োনাতন গ্রাড, মেলভিন জে এবং জেরালডিন গ্লিমচার গবেষণার পর জানিয়েছেন, কখনও উধাও হয়ে যাবে না করোনাভাইরাস। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পত্রিকায় প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে তাঁরা আরও জানিয়েছেন, কত দিনে করোনাভাইরাস সংক্রান্ত রোগ একেবারে স্বাভাবিক হয়ে যাবে, তা এখনও বলা যাবে না। তবে ধীরে ধীরে সে দিকেই ঘুরছে গোটা পরিস্থিতি। ভাইরাসের বিরুদ্ধে অনেকাংশ মানুষের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়লে তবেই সে সংক্রান্ত সংক্রমণ জাতিগত রোগে পরিণত হয়। হু-এর প্রধান বিজ্ঞানীর বক্তব্যÍ সেই প্রক্রিয়া সম্ভবত শুরু হয়ে গিয়েছে ভারতে।
একটি রোগ যখন কোনও অঞ্চলে মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গে মিশে যায়, তখন সাধারণত মৃত্যুর হারও এতটা থাকে না। চিকিৎসার উপায় বেরোয়। প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয়। যেমন এ ক্ষেত্রেও হচ্ছে। আর দেখা যাচ্ছে, প্রতিষেধক দেওয়া শুরু হতেই সংক্রমণ না কমুক, রোগের তীব্রতা কমছে। সম্প্রতি আমেরিকার সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে সেখানকার চিকিৎসক জানিয়েছেন, ইতিমধ্যেই সে দেশে অনেক করোনা রোগীর উপসর্গ সাধারণ ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো হয়ে গিয়েছে। কারও বা হাল্কা জ্বরজ্বর, গলাব্যথা। কারও তা-ও নয়। শুধু নাক দিয়ে জল পড়া, হাঁচি। করোনার সময় না হলে হয়তো পরীক্ষাও করাতেন না তাঁরা। চিকিৎসকের কাছেও যেতেন না। এমন শুধু আমেরিকা নয়, ইওরোপের কিছু অঞ্চলেও শোনা যাচ্ছে। খানিক যেন তেজ কমেছে ভাইরাসের।
কলকাতা শহরের একটি বেসরকারি হাসপাতালের কোভিড বিভাগের চিকিৎসক সুস্মিতা রায়চৌধুরী জানাচ্ছেন, চিত্রটি বদলাচ্ছে এখানেও। তিনি বলেন, ‘‘এখানে অনেকে উপসর্গ আলাদা ভাবে বুঝতে পারছেন না বলে পরীক্ষাও কম হচ্ছে। অল্প সর্দি হলে সাধারণ ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাবছেন। আর উপসর্গও তো বেশির ভাগ এখন ইনফ্লুয়েঞ্জার মতোই দেখা দিচ্ছে।’’ ফলে অনেকেই আর চিকিৎসকের কাছে যাচ্ছেন না। কেউ কেউ হয়তো ওষুধ খাওয়ার কথাও ভাবছেন না। সংক্রমণের তীব্রতা কম। তাই পরীক্ষা করানোর প্রয়োজনীয়তাও টের পাচ্ছেন না। অতিমারি যখন ধীরে ধীরে জাতিগত রোগের আকার নেয়, তখন এমনই হয়, বক্তব্য এই চিকিৎসকের।
তার মানে কি ভয়ের সময় কেটে গিয়েছে? তৃতীয় তরঙ্গ কি আর আসবে না? সে সব বুঝতে সময় লাগবে বলেই বক্তব্য চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীদের। বরং বুঝে নেওয়া জরুরি, করোনা নানা ভাবে ঘুরে ফিরে আসবে। তার সঙ্গে মানিয়ে নিতে শিখবে শরীর। এমনই বক্তব্য বিজ্ঞানীদের। গত দেড় বছরে বারবার উঠেছে ১৯১৮-র প্রসঙ্গ। এ/এইচ১এন১ ভাইরাসই ছিল সে বারের অতিমারির জন্য দায়ী। ১৯৫৭ ফ্লু অতিমারিতে এল এ/এইচ২এন২। ১৯৬৮ সালে আর এক অতিমারি ঘটাল এ/এইচ৩এন২। আবার ২০০৯ সোয়াইন ফ্লু ঘটাতে ফিরে এল আর এক এ/এইচ১এন১ ভাইরাস। সব ক্ষেত্রেই সংক্রমণের শুরুতে মৃত্যুর হার বেশি ছিল। ধীরে ধীরে তা কমেছে। মানুষও স্বাভাবিক অসুখ হিসাবেই এখন নিচ্ছে এই সব ভাইরাসের সংক্রমণ। সে সব ভাইরাস উধাও হয়নি। কিন্তু তা ঘিরে অতিমারির আতঙ্কও আপাতত নেই। হার্ভার্ডের বিশেষজ্ঞদের দাবি, সর্বত্র এমন হতে চলেছে করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রেও। সে প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছে বলেই জানা যাচ্ছে চিকিৎসকদের অভিজ্ঞতা থেকে। ‘হু’-এর প্রধান বিজ্ঞানীর বক্তব্য মন দিয়ে পড়লে দেখা যাবে, ভারত সে দিক থেকে এগিয়ে।’