পবিত্র কুরআনে আল্লাহ পাক ঘোষণা করেছেন, পরকালীন জিন্দেগিতে ঈমান এবং নেক আমলের বরকতে যারা ভাগ্যবান হবে, আর এ দু’টি জিনিসের অভাবে যারা হতভাগা হবে তাদের মধ্যে কখনো কখনো আলাপ-আলোচনা হবে। পবিত্র কুরআন সে আলাপ-আলোচনা তুলে ধরেছে মানুষের সামনে। পবিত্র কুরআনের মর্মকথা যারা উপলব্ধি করেন, তারা এ আলোচনার ভাষা পাঠ করে যেমন ভীতসন্ত্রস্ত হন, তেমনি পরকালীন জিন্দেগির প্রস্তুতিতে আত্মনিয়োগ করেন।
আল্লাহ বলেন, জান্নাতিরা জাহান্নামীদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করবে, কী কারণে তোমরা জাহান্নামে পতিত হলে? জাহান্নামীরা বলবে, আমরা দুনিয়াতে নামাজ আদায় করতাম না, গরিব-দুঃখীকে খাবার দিতাম না, আমরা সত্য ধর্ম সম্পর্কে তর্ককারীদের সাথে তর্কে মেতে উঠতাম, শেষ পর্যন্ত এ অবস্থাতেই আমাদের মৃত্যু এসে উপস্থিত হলো। অতএব সুপারিশকারীদের সুপারিশ তাদের কোনো কাজে আসবে না।’ (সূরা মুদ্দাসির আয়াত : ৪০-৪৮) জাহান্নামীদেরও সেদিন এ সুযোগ দেয়া হবে যে, তারা ইচ্ছা করলে জান্নাতি আত্মীয়স্বজন, বন্ধু বান্ধবদের সাথে কথা বলতে পারবে। তাদের মনের ব্যথা প্রকাশ করতে পারবে। পবিত্র কুরআন এমনি একটি সংলাপ তুলে ধরেছে মানবজাতির সামনে এবং এর মাধ্যমে কল্যাণকামী মানুষকে সতর্ক করে দিয়েছে কুরআনুল কারিম। ইরশাদ হচ্ছে, ‘এবং দোজখবাসীরা জান্নাতবাসীদের ডাক দিয়ে বলবে যে, আমাদের জন্য সামান্য পানি বা যে খাদ্য আল্লাহ পাক আপনাদের দান করেছেন তার কিছু উচ্ছিষ্ট আমাদের দান করুন যেভাবে পৃথিবীতে ভাগ্যবান লোকেরা আহার করে পরিতৃপ্তি লাভের পর উচ্ছিষ্ট ফেলে দিলে ভাগ্যাহত লোকেরা তা রাস্তা থেকে কুড়িয়ে খেতে চেষ্টা করে। ঠিক তেমনি জান্নাতবাসী ভাগ্যবানদের কাছে তাদের নিক্ষিপ্ত উচ্ছিষ্ট দান করাতে দোজখবাসী সবিনয় নিবেদন করবে। তখন জান্নাতবাসীরা জবাব দিয়ে বলবেন, আল্লাহ পাক জাহান্নামবাসীদের জন্য খাদ্য পানি হারাম করে দিয়েছেন।’ (সূরা আরাফ : ৫০) অন্য আয়াতে জাহান্নামীদের খাদ্যদ্রব্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, নিশ্চয়ই জাক্কুম বৃক্ষই গুরুতর অপরাধী লোকদের খাদ্য হবে, যা তেলের গাদের মতো কুৎসিৎ হবে, যা উদরের মধ্যে ফুটতে থাকবে, যেভাবে উত্তপ্ত পানি ফুটতে থাকে, তখন ফেরেশতাদের প্রতি আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের হুকুম হবে, তাকে ধরো! দোজখের মধ্যস্থলে টেনে নিয়ে যাও। আর তার মাথার ওপর যন্ত্রণাদায়ক উত্তপ্ত পানি ঢালতে থাকো। (তখন তাকে বিদ্রুপ করে বলা হবে) এবার শাস্তির মজা আস্বাদন করো, কারণ পৃথিবীতে বিরাট ক্ষমতার অধিকারী ও বিশিষ্ট সম্মানিত ব্যক্তি ছিলে। আর নিশ্চয়ই এটি সেই শাস্তি, যে সম্পর্কে তুমি দুনিয়াতে সন্দেহ পোষণ করতে।’ (সূরা দুখান : ৪৩-৫০)
পবিত্র কুরআন শুধু পরকালীন জিন্দেগির শাস্তির কথাই ঘোষণা করেনি বরং যারা এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে তার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করবে, তাদের জন্য যে অনন্ত অসীম নিয়ামত রয়েছে তার খোশখবরিও স্থান পেয়েছে। পবিত্র কুরআনে যেমন ইরশাদ হয়েছে, নিশ্চয় যারা আল্লাহ পাককে ভয় করে জীবনযাপন করে তারা সেদিন থাকবে নিরাপদ স্থানেÑ উদ্যানসমূহ ও নহরসমূহের মাঝে, তারা সেদিন পরিধান করবে মসৃণ ও পুরু রেশমের পোশাক এবং তারা উপবিষ্ট হবে একে অন্যের সম্মুখীন হয়ে আর তা এভাবেই হবে। আর আমি তাদের বিয়ে করিয়ে দেবো বড় বড় চক্ষুবিশিষ্ট হুরিদের সাথে সেখানে নিশঙ্ক মনে শান্ত চিত্তে তারা রকমারি ফল-ফলারি চেয়ে নেবে। আর সেখানে তারা সেই মৃত্যু ব্যতীত (যা পৃথিবীতে হয়েছিল) আর কোনো মৃত্যুর আস্বাদন গ্রহণ করবে না। (অর্থাৎ তারা চিরঞ্জীব হবে, লাভ করবে অমরত্ব) আর আল্লাহ পাক তাদেরকে দোজখের আজাব থেকে রক্ষা করবেন। কিয়ামতের কঠিন দিনের ব্যাপারে আল্লাহ ঘোষণা করেছেন, আল্লাহ পাকের অনুমতি ব্যতীত কেউ কথা বলতে পারবে না। দুনিয়াতে যদি কারো কথা বলার সুযোগ না থাকে তবে অন্যের মাধ্যমে মনোভাব প্রকাশ করার ব্যবস্থা থাকে, কিন্তু কিয়ামতের কঠিন দিনে সে ব্যবস্থারও অনুমতি হবে না। কেননা, সেদিন কেউ কারো সাহায্য করতে সক্ষম হবে না। এমনকি পিতা পুত্রের বা পুত্র পিতারও কোনো উপকারে আসবে না। কুরআনের ভাষায়, ‘আর ভয় করো সেদিনকে, যেদিন একজন অন্যজন থেকে একটুও উপকৃত হবে না। আর সেদিন কোনো সুপারিশ গ্রহণ করা হবে না। আর অন্য লোক থেকে কোনো বিনিময় গ্রহণযোগ্য হবে না এবং তারা কোনোরূপ সাহায্যও লাভ করবে না।’ (সূরা বাকারা : ৪৮) কিয়ামতের দিনে শুধু পিতা পুত্র দ্বারা উপকৃত হবে না তাই নয়, বরং সেই কঠিন দিনে পিতা পুত্রকে দেখে পলায়নপর হবে, ভাই ভাইকে দেখে পালিয়ে যাবে।
মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে মানবজাতি! ভয় করো তোমাদের প্রতিপালককে ভয় করো আর সেদিনকে যেদিন পিতা পুত্র দ্বারা উপকৃত হবে না, আর পুত্রও পিতা দ্বারা উপকৃত হবে না। নিশ্চিতভাবে জেনে রাখো যে, আল্লাহ পাকের ওয়াদা সত্য। অতএব দুনিয়ার এ ক্ষণস্থায়ী জিন্দেগি তোমাদেরকে যেন প্রতারিত না করে, আর আল্লাহপাক থেকে তোমাদেরকে যেন ধোঁকাবাজ শয়তান ধোঁকায় না ফেলে।’ (সূরা লোকমান : ৩৩) অর্থাৎ নিকটতম আত্মীয় হওয়া সত্ত্বেও কেউ কারো প্রতি কোনো প্রকার সহানুভূতি প্রকাশ করার সুযোগ পাবে না। এর কারণ বর্ণনা করেছে পরবর্তী আয়াতগুলো, ‘সেদিন অনেক মুখম-ল (ঈমানের বরকতে) দীপ্তিমান হবে আনন্দ উল্লাসে হাস্যোজ্জ্বল হবে। আর অনেক মুখম-লের উপর সেদিন (নাফরমানির কারণে) বিষাদের মলিনতা সমাচ্ছন্ন হবে।’ (সূরা আবাসা : ৩৮-৪১)
অবশেষে এ হতভাগ্য লোকদের সম্পর্কে পবিত্র কুরআন মন্তব্য করে, ‘এরাই কাফের এরাই দুষ্কৃতকারী লোক।’ (সূরা আবাসা : ৪২) কিয়ামতের কঠিন দিনে এই দুষ্কৃৃতকারী নাফরমানদের শাস্তির আদেশ জারি হওয়ার পর আল্লাহপাক তাদের সম্বোধন করে বলবেন, আজকের দিনের সাক্ষাৎকে (কিয়ামতের দিন) তোমরা ভুলে গিয়েছিলে অতএব তার শাস্তিভোগ করো। আজ আমি তোমাদেরকে ভুলে গেলাম, আর তোমরা চির শাস্তি ভোগ করতে থাকো তোমাদের কৃতকর্মের শোচনীয় পরিণাম স্বরূপ।’ (সূরা আস সাজদাহ : ১৪) এভাবে পবিত্র কুরআনের এক হাজার আয়াতে নেককার লোকদের জন্য তথা আখিরাতে বিশ্বাসী এবং তার জন্য যথাযথ প্রস্তুতি গ্রহণকারীদের জন্য রয়েছে খোশখবরি। পক্ষান্তরে, যারা আখিরাতে বিশ্বাস করে না, তার জন্য কোনো প্রস্তুতিও গ্রহণ করে না, এ ক্ষণস্থায়ী জীবনকেই সব কিছু মনে করে লোভ ও মোহে অন্ধ হয়ে থাকে, তাদের ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের এক হাজার আয়াতে সতর্কবাণী উচ্চারণ করা হয়েছে। আল্লাহ পাক আমাদেরকে আখিরাত বা পরকালীন চিরস্থায়ী জিন্দেগির জন্য যথাযথ প্রস্তুতি নেয়ার তাওফিক দান করুন, আমিন। – ইমাম, বারডেম জেনারেল হাসপাতাল-২, সেগুনবাগিচা, ঢাকা