ভারতে সব ধর্মীয় গোষ্ঠীর প্রজনন হারেই বড় ধরনের হ্রাস ঘটেছে। এর ফলে ১৯৫১ সাল থেকে ভারতীয়দের ধর্মীয় গঠনে কেবল ‘পরিমিত পরিবর্তন’ ঘটেছে। ‘পিউ রিসার্চ সেন্টার’-এর একটি গবেষণায় এ তথ্য পাওয়া গেছে। ভারতের ১২০ কোটি মানুষের ৯৪ ভাগ হিন্দু ও মুসলমান, এই দুই বৃহত্তম ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর অন্তর্গত । খ্রিস্টান, শিখ, বৌদ্ধ এবং জৈন ধর্মাবলম্বীরা সবাই মিলে বাকি ৬ ভাগ জনসংখ্যা ধারন করে। ভারতের দশকভিত্তিক আদমশুমারি ও ‘ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে’ (এনএফএইচএস) থেকে প্রাপ্ত তথ্যের উপর ভিত্তি করে কিভাবে দেশটির ধর্মীয় গঠন পরিবর্তিত হয়েছে এবং পরিবর্তনের মূল কারণ কি খতিয়ে দেখেছে পিউ অনুসন্ধান।
হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারত এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পাকিস্তানে ১৯৪৭ সালের ঔপনিবেশিক রাজ্য বিভক্ত হওয়ার পর ভারতের জনসংখ্যা তিনগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। জনসংখ্যা ১৯৫১ সালে ৩৬.১ কোটি থেকে ২০১১ সালে ১১০ কোটিরও বেশি লোকের মধ্যে ।(স্বাধীন ভারতে প্রথম আদমশুমারিটি ১৯৫১ সালে এবং ২০১১ সালে সর্বশেষটি পরিচালিত হয়।) এই সময়ের মধ্যে ভারতে প্রতিটি প্রধান ধর্মের অনুসারীর সংখ্যা বেড়েছে, গবেষণায় দেখা গেছে। হিন্দুদের সংখ্যা ৩০.৪ কোটি থেকে বেড়ে ৯৬.৬ কোটি হয়েছে; মুসলমানরা ৩.৫ কোটি থেকে ১৭.২ কোটিতে উন্নীত হয়েছে; এবং ভারতীয়দের মধ্যে যারা নিজেদের খ্রিস্টান বলে পরিচয় দেয় তাদের সংখ্যা ৪০ লাখ থেকে ২.৮ কোটিতে উন্নীত হয়েছে। ভারতীয়দের ধর্মীয় গঠন: * ২০২১ সালের আদমশুমারিতে ভারতের ১২০ কোটি জনগণের ৭৯.৯% হিন্দু। বিশ্বের ৯৪% হিন্দু ভারতে বাস করে * ভারতীয়দের ১৪.২% মুসলিম। ভারত বিশ্বের অন্যতম বুহৎ মুসলিম জনসংখ্যার বাসস্থান, শুধু ইন্দোনেশিয়া দেশটিকে অতিক্রম করতে পেরেছে * খ্রিস্টান, শিখ, বৌদ্ধ এবং জৈনরা একত্রে মোট জনসংখ্যার ৬% * ২০১১ সালে মাত্র ৩০,০০০ ভারতীয় নিজেকে নাস্তিক বলে দাবি করেন * প্রায় ৪০ লাখ মানুষ যে তারা ছয়টি বৃহত্তম ধর্মীয় গোষ্ঠীর কোনটির সদস্য নন
* এখানে ৮৩ টি ক্ষুদ্র ধর্মীয় গোষ্ঠী ছিল এবং প্রত্যেকের অন্তত ১০০ অনুসারী রয়েছে * ভারত প্রতি মাসে প্রায় ১০ লাখ নতুন জনসংখ্যা করে, এটি ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ হিসেবে চীনকে ছাড়িয়ে যাওয়ার পথে। (সূত্র : ২০১১ আদমশুমারি, পিউ রিসার্চ সেন্টার)
প্রধান ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে মুসলিমদের প্রজনন হার এখনো উচ্চ (২০১৫ সালে মহিলা প্রতি ২.৬ শিশু), তারপর হিন্দুদের (২.১)। সর্বনি¤œ প্রজনন হার জৈনদের, ১.২। গবেষণায় বলা হয়, প্রজননের ধারা মূলত ১৯৯২-এর মতই আছে। সে সময়ও মুসলিমদের প্রজনন হার উচ্চ ছিল (৪.৪), এরপর হিন্দুদের (৩.৩)।
গবেষণায় বলা হয়েছে, ‘কিন্তু ভারতের ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর গর্ভধারনের মধ্যকার বিরতি সাধারণত আগের তুলনায় অনেক কম।’ পাশাপাশি ভারতের সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর মধ্যে জনসংখ্যা বৃদ্ধির ধীর গতি আরও বেশি প্রকট হয়ে উঠেছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে পূর্ববর্তী দশকগুলোতে সংখ্যালঘুরা হিন্দুদের চেয়ে এগিয়ে ছিল। জ্যেষ্ঠ পিউ গবেষক ধর্ম-বিশেষজ্ঞ স্টেফানি ক্র্যামারের মতে, লক্ষণীয় হলো মাত্র এক প্রজন্মের মধ্যে ২৫ বছরের কম বয়সী মুসলিম মহিলার প্রজনন ক্ষমতা প্রতি নারীতে প্রায় দুই সন্তান হ্রাস পেয়েছে।
১৯৯০-এর দশকের গোড়া থেকে ভারতীয় মহিলাদের মহিলা প্রতি সন্তানের গড় ৪.৪ থেকে কমে ২০১৫ -তে ২.২ নেমে এসেছে। একই সময়সীমার মধ্যে মুসলিমদের মধ্যে সন্তানের হার আরো বেশি কমে ৪.৪ থেকে ২.৬-তে নেমে এসেছে। প্রায় ৬০ বছর ধরে ভারতের জনসংখ্যায় মুসলিমদের অংশ ৪% বৃদ্ধি পেয়েছে, এবং হিন্দুদের অংশ প্রায় একই পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে। অন্যান্য গোষ্ঠীগুলোর সংখ্যা মোটামুটি স্থির রয়েছে। ‘জনসংখ্যাতাত্ত্বিক পরিবর্তনের পরিমিত পরিমাণ ব্যাখ্যা হচ্ছে, অন্তত সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত মুসলিম নারীরা অন্য ভারতীয় মহিলাদের তুলনায় গড়পড়তা বেশি বাচ্চা গ্রহণ করেছে,’ ক্র্যামার বিবিসিকে জানান। গবেষণায় বলা হয়, পরিবারের আয়তন অনেক কারণ দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে, ফলে ‘শুধুমাত্র ধর্মীয় অনুষঙ্গ সন্তান গ্রহণকে কতটা প্রভাবিত করে তা নির্ণয় করা অসম্ভব’। অন্যান্য অনেক দেশের চেয়ে ভারতে জনসংখ্যাতাত্ত্বিক পরিবর্তনে অভিবাসন বা ধর্মীয় ধর্মান্তরের প্রভাব ‘নগণ্য’। ভারতে ধর্মীয় জনসংখ্যায় পরিমিত পরিবর্তনের পিছনে এখন পর্যন্ত প্রজনেই ‘সবচেয়ে বড় নিয়ামক’।
জনসংখ্যা বৃদ্ধি আরেকটি কারণ হলো যেসব জনগোষ্ঠীতে কম বয়স্কদের সংখ্যা বেশি ‘তাদের মধ্য থেকে বেশি নারীা সন্তান জন্মদানের প্রাথমিক বয়সে প্রদার্পণ করে এবং ফলস্বরূপ তাদের সংখ্যা বেশি বয়স্ক জনগোষ্ঠীর তুলনায় দ্রুত বৃদ্ধি পায়’। ২০২০ পর্যন্ত, সমীক্ষা বলছে, হিন্দুদের জন্য গড় বয়স ২৯, মুসলিমদের জন্য ২৪ এবং খ্রিস্টানদের জন্য ৩১। ভারতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির অন্যান্য নিয়ামকগুলোর মধ্যে রয়েছে মহিলাদের শিক্ষার স্তর (উচ্চশিক্ষিত মহিলারা প্রায়শই দেরি করে বিয়ে করে এবং কম শিক্ষিত মহিলাদের তুলনায় তারা প্রথম সন্তান পরে নিয়ে থাকে) এবং সম্পদ (দরিদ্র মহিলাদের বেশি সন্তান হওয়ার প্রবণতা থাকে যেন সন্তানদের গৃহস্থালি এবং আয়-উপার্জনের কাজে লাগানো যায়)।
অনুসন্ধানে প্রাপ্ত ফলাফল পুরোপুরি বিস্ময়কর নয়, কারণ সাম্প্রতিক দশকগুলিতে ভারতের সামগ্রিক প্রজনন হার দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। একজন ভারতীয় মহিলার তার জীবদ্দশায় গড়ে ২.২ সন্তান হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই হার যুক্তরাষ্ট্রের (১.৬) চেয়ে বেশি কিন্তু ১৯৯২ (৩.৪) বা ১৯৫১ (৫.৯)-এর ভারতের তুলনায় কম। গবেষণায় উঠে আসা একটি আকর্ষণীয় তথ্য হল, মাত্র অল্প কয়েকজন ভারতীয় নিজেকে কোনও ধর্মীয় গোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে দাবি করেন না। খ্রিস্টান ও মুসলিমদের পরে বিশ্বব্যাপী তৃতীয় সর্বাধিক প্রচলিত ধর্মীয় সংশ্লিষ্টতা হলো ‘কোনটাই না’। ‘সুতরাং আকর্ষণীয় তথ্য হলো, এত বড় দেশে অসংশ্লিষ্টদের এত অল্প প্রতিনিধিত্ব রয়েছে,’ মিসেস ক্র্যামার বলেছেন।
এছাড়াও বেশ কয়েকটি ধর্মীয় গোষ্ঠী ভারতে ‘অস্বাভাবিক সংখ্যায় সন্ননিবিষ্ট রয়েছে : বিশ্বের সমস্ত হিন্দুর ৯৪ ভাগ এখানে বাস করে, সেই সাথে জৈনদের সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং ৯০ ভাগেরও বেশি শিখ জনগোষ্ঠী। বিশ্বের অধিকাংশ শিখ একটি মাত্র ভারতীয় রাজ্যে বসবাস করেন, তা হলো পাঞ্জাব।
‘চীন, যার জনসংখ্যা বৃহত্তর, সাথে তুলনা করলে দেখা যায় বিশ্বের প্রায় অর্ধেক বৌদ্ধ এবং সবচেয়ে অসংশ্লিষ্ট মানুষ রয়েছে সেখানে, কিন্তু ‘কোন বড় ধর্মীয় গোষ্ঠীর ৯০%-এর মতো একপেশে কিছু নেই।
ক্র্যামার বলেন, ‘ভারত ছাড়া এমন ধর্মীয় বৈচিত্র আর কোনো দেশে নেই ।’ সূত্র : বিবিসি