সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৩৪ অপরাহ্ন

দুনিয়াতে গুনাহের শাস্তি

হাফিজ মুহাম্মাদ আইয়ুব:
  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২১

ছোট-বড় গুনাহ আমরা সবাই কোনো না কোনোভাবে করে থাকি। বহু জাতির ধ্বংস, বহু পরিবারের অধঃপতন, সর্বত্র মত ও পথের দ্বন্দ্ব, অন্তরের কঠিনতা ও বিনাশ, রিজিকের অপবিত্রতা, আল্লাহর রাগ, মানুষের মধ্যকার ভয়ভীতি ও অস্থিরতা, দুর্ভিক্ষ, মহামারী, অগ্নিকা-, পানিতে নিমজ্জিত হওয়ার ঘটনাবলি বৃদ্ধি, সব কিছু থেকে বরকত উঠে যাওয়া, উপকারী বস্তুর উপকার কম এবং ক্ষতি বেশি হয়ে যাওয়া সবই তো গুনাহের কারণে। আল্লাহ বলেন, ‘পাপ ও সীমালঙ্ঘনের কাজে পরস্পরকে সহযোগিতা করো না। আল্লাহকে ভয় করো, আল্লাহ শাস্তি দানে অত্যন্ত কঠোর’ (সূরা আল মায়িদাহ-২)। ‘আর কেউ অণু পরিমাণও অসৎ কাজ করলে সে তা দেখবে’ (সূরা আজ জিলজাল-৮)।
আনাস রা: থেকে বর্ণিতÑ তিনি বলেন, এমন সব কাজ তোমরা করে থাকো তোমাদের দৃষ্টিতে যেগুলো চুল থেকেও অধিক হালকা-পাতলা। কিন্তু আমরা সেগুলোকে রাসূলুল্লাহ সা:-এর জামানায় ধ্বংসাত্মক বলে গণ্য করতাম (বুখারি-৬৪৯২)। আবদুল্লøাহ বিন মাসউদ রা: থেকে বর্ণিতÑ তিনি বলেন, নিশ্চয়ই মুমিন গুনাহকে এমন মনে করে যে, যেন সে পাহাড়ের নিচে। ভয় পাচ্ছে পাহাড়টি কখন যে তার মাথার ওপর ভেঙে পড়ে। আর ফাসিক (আল্লাহর অবাধ্য) গুনাহকে এমন মনে করে যে, যেমন কোনো একটি মাছি তার নাকে বসল আর সে হাত দিয়ে মাছিটিকে তাড়িয়ে দিলে তা উড়ে গেল। ইমাম আওজায়ি বলেন, গুনাহ যে ছোট তা দেখো না বরং কার শানে তুমি গুনাহ করছ তাই ভেবে দেখো। ফুজাইল বিন ইয়াজ বলেন, তুমি গুনাহকে যতই ছোট মনে করবে আল্লাহ তায়ালার কাছে তা ততই বড় হয়ে দেখা দেবে। আর যতই তুমি তা বড় মনে করবে ততই তা আল্লাহ তায়ালার কাছে ছোট হয়ে দেখা দেবে।
গুনাহের কারণে দুনিয়াতে নানা ধরনের বিপদ আসে। আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের ওপর যে বিপদই উপনীত হয় তা তোমাদের হাতের উপার্জনের কারণেই, তিনি অনেক অপরাধই ক্ষমা করে দেন’ (সূরা আশশুরা-৩০)। ‘গুরুতর শাস্তির আগে আমি তাদেরকে অবশ্য অবশ্যই লঘু শাস্তি আস্বাদন করাব যাতে তারা (অনুশোচনা নিয়ে) ফিরে আসে’ (সূরা আস সাজদাহ-২১)। যে ব্যক্তি কোনো গুনাহ করে, সে সারা বিশে^র মানুষ, চতুষ্পদ জন্তু ও পশু-পক্ষীদের প্রতি অবিচার করে। কারণ, তার গুনাহর কারণে অনাবৃষ্টি ও অন্য যেসব বিপদাপদ দুনিয়াতে আসে, তাতে সব প্রাণীই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই কিয়ামতের দিন এরা সবাই গুনাহগার ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ করবে। কখনো কখনো গুনাহের প্রতিক্রিয়া দ্রুত দেখা যায় না। তখন গুনাহগার মনে করে থাকে, এর প্রতিক্রিয়া আর দেখা যাবে না। তখন সে ওই গুনাহের কথা একেবারেই ভুলে যায়। অথচ এটি একটি মারাত্মক ভুল চিন্তা। তাই এর কয়েকটি পরিণতি তুলে ধরা হলোÑ
১. যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালা ছাড়া অন্য কোনো বস্তু বা ব্যক্তিকে ভালোবাসে সে এ দুনিয়াতে তিন প্রকারের শাস্তি ভোগ করে। সে জিনিস পাওয়ার আগে তা পাচ্ছে না বলে মানসিক শাস্তি, তা পাওয়ার পর হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কাগত শাস্তি এবং তা হাতছাড়া হয়ে গেলে বিরহের শাস্তি। কবরের জীবনেও তার জন্য অনেকগুলো শাস্তি রয়েছে।
২. গুনাহের কারণে গুনাহগারের অন্তর ধীরে ধীরে অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। তখন যে বিদয়াত, শিরক, কুফর সবই করে ফেলবে অথচ যে তা একটুও টের পাবে না। আবদুুল্লাহ বিন আব্বাস রা: বলেন, কোনো নেককাজ করলে চেহারায় উজ্জ্বলতা ফুটে উঠে। অন্তরে আলো জন্ম নেয়। রিজিকে সচ্ছলতা, শরীরে শক্তি ও মানুষের ভালোবাসা অর্জন করা যায়। আর গুনাহ করলে চেহারা কালো, অন্তর অন্ধকারাচ্ছন্ন এবং শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। রিজিকে ঘাটতি আসে এবং মানুষের অন্তরে তার প্রতি এক ধরনের বিদ্বেষভাব জন্ম নেয়।
৩. একটি গুনাহ আরেকটি গুনাহর জন্ম দেয়। পরিশেষে গুনাহ করতে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে দাঁড়ায় যে, গুনাহ থেকে বের হওয়া তার পক্ষে আর সম্ভব হয় না যতক্ষণ না আল্লাহ তায়ালা তার প্রতি এ ব্যাপারে দয়া করেন।
৪. গুনাহের কারণে সাধারণ মানুষ বিশেষ করে নেককার লোকদের মাঝে ও গুনাহগারের মাঝে বিরাট এক দূরত্ব জন্ম নেয়। যার দরুন পাপী কখনো ভালো মানুষদের নিকটবর্তী হতে চায় না। বরং সর্বদা সে শয়তান প্রকৃতির লোকদের সাথেই ওঠাবসা করা পছন্দ করে।
৫. গুনাহ করতে করতে গুনাহগারের অন্তরে গুনাহের এক আস্তর পড়ে যায়। তখন বিপদের সময়ও তার অন্তর তা কাটিয়ে উঠতে তার সহযোগিতা করে না। আল্লাহ তায়ালার কাছে ফরিয়াদ করতে চায় না। জিকিরে ব্যস্ত হয় না এবং একমাত্র আল্লাহর ওপর ভরসা করতে রাজি হয় না।
৬. গুনাহের কারণে গুনাহগারের অন্তর একেবারেই অন্ধ হয়ে যায়। পুরো অন্ধ না হলেও তার অন্তরদৃষ্টি দুর্বল হয়ে পড়ে। তখন সে আর হিদায়াতের দিশা পায় না। আর পেলেও তা বাস্তবায়নের ক্ষমতা রাখে না।
৭. গুনাহগার ব্যক্তি ধর্মীয় জ্ঞান থেকে বঞ্চিত হয়। কারণ, ধর্মীয় জ্ঞান হচ্ছে নূর বা আলো যা আল্লাহ তায়ালা তাঁর ইচ্ছানুযায়ী যে কারোর অন্তরে ঢেলে দেন। আর গুনাহ সে নূরকে নিভিয়ে দেয়।
৮. গুনাহগার ব্যক্তি গুনাহের কারণে রিজিক থেকে বঞ্চিত হয়। সাউবান রা: থেকে বর্ণিতÑ তিনি বলেন, নবী সা: ইরশাদ করেনÑ ‘নিশ্চয়ই কোনো ব্যক্তি গুনাহের কারণেই রিজিক থেকে বঞ্চিত হয়’ (হাকিম, হা-১৮১৪, আহমাদ, হা-২২৪৪০, আবু ইয়ালা, হাদিস-২৮২, ইবনে মাজাহ, হা-৮৯)। ঠিক এরই বিপরীতে আল্লাহভিরুতাই রিজিক বর্ধনের কারণ হয়। সুতরাং রিজিক পেতে হলে গুনাহ অবশ্যই ছাড়তে হবে।
৯. গুনাহের কারণে গুনাহগারের অন্তরে এক ধরনের বিক্ষিপ্ত ভাব সৃষ্টি হয়। যার দরুন আল্লাহ তায়ালা ও তার অন্তরের মাঝে এমন এক দূরত্ব জন্ম নেয় যার ক্ষতিপূরণ আল্লাহ তায়ালা না চান তো কখনোই সম্ভব নয়।
১০. গুনাহের কারণে অন্তর্দৃষ্টি ও ওর বিশেষ আলোকরশ্মি নষ্ট হয়ে যায়। ১১. গুনাহ গুনাহগারের অন্তরকে হীন, লাঞ্ছিত ও কলুষিত করে দেয়। ১২. গুনাহগার সর্বদা শয়তানের ও নিজের কুপ্রবৃত্তির বেড়াজালে আবদ্ধ থাকে। ১৩. গুনাহের কারণে আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর বান্দার মধ্যকার দৃঢ় সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ১৪. গুনাহ বয়স, রিজিক, জ্ঞান, আমল ও আনুগত্যের বরকত কমিয়ে দেয়। তথা দ্বীন দুনিয়ার সব বরকতে ঘাটতি আসে।
১৫. গুনাহগার উঁচু স্থান থেকে নিচু স্থানে নেমে আসে। ১৬. গুনাহগারের ক্ষতি করতে এমন ব্যক্তিও সাহসী হবে যে ইতঃপূর্বে তা করতে সাহস পায়নি। ১৭. গুনাহের কারণে শুধু গুনাহগারই ক্ষতিগ্রস্ত হয় না বরং তাতে অন্য পশু এবং অন্য মানুষও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
মুজাহিদ রা: বলেন, যখন এলাকায় দুর্ভিক্ষ বা অনাবৃষ্টি দেখা দেয়, তখন পশুরা গুনাহগারদের প্রতি লানত করে এবং বলে, এটি আদম সন্তানের গুনাহরই অপকারিতা। গুনাহগার ব্যক্তি রাসূল সা: ও ফেরেশতাদের দোয়া থেকে বঞ্চিত হয়। তাই আমাদের উচিত আল্লাহকে ভয় করে গুনাহ বর্জন করা অন্যথায় করোনাভাইরাসের মতো বিভিন্ন আজাব-গজব এসে সব কিছু ধ্বংস করে দেবে। আল্লাহ আমাদের ক্ষমা ও হিফাজত করুন। আমীন।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com