ভুটানের চীন সীমান্তবর্তী কয়েকটি অঞ্চল নিয়ে থিম্পু ও বেইজিংয়ের মধ্যে বিরোধ দীর্ঘদিনের। দুই দেশই এখন এ বিরোধ মিটিয়ে ফেলতে চাইছে। অঞ্চলগুলো নিয়ে দুই দেশের মধ্যে সম্ভাব্য চুক্তির প্রস্তুতিও চলছে। এ নিয়ে স¤প্রতি একটি সমঝোতাও (এমওইউ) সই হয়েছে। দীর্ঘদিনের বিরোধ নিষ্পত্তির প্রয়াসের এ অগ্রগতিতে উল্লসিত চীন দাবি করছে, এর মধ্য দিয়ে ভুটানের ওপর ভারতের প্রভাব খর্ব হওয়া শুরু হলো। অন্যদিকে ভারত এ নিয়ে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। কেবল দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বিষয়টি নিয়ে সতর্ক পর্যবেক্ষণ চালাচ্ছে নয়াদিল্লি। চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদ সংস্থা সিনহুয়া জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার দুই দেশের মধ্যে এমওইউ সই হয়। চীন-ভুটান সীমান্ত আলোচনাকে চূড়ান্ত রূপ দিতে ঘোষিত তিন স্তরের রোডম্যাপের অংশ হিসেবে এটি সই হয়েছে।
বেইজিং ও থিম্পুর মধ্যে এমওইউ এমন এক সময় সই হলো যখন লাদাখ সীমান্তের নিয়ন্ত্রণরেখায় (এলএসি) চলমান অচলাবস্থা নিরসনে ভারত ও চীনের মধ্যে আলোচনা আরেকবার ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। সর্বশেষ রোববার দুই দেশের মধ্যে এ আলোচনা ভেস্তে যায়। এ আলোচনা ভেস্তে যাওয়ার পেছনে দুই দেশ একে অন্যকে দোষারোপ করছে। বেইজিংয়ের ভাষ্যমতে, ভারতের ‘অযৌক্তিক দাবির’ কারণে আলোচনা ফলপ্রসূ হয়নি। অন্যদিকে ভারত বলছে, চীন এলএসিতে সামরিক স্থিতাবস্থায় পরিবর্তন আনায় আলোচনায় সমাধান আনা সম্ভব হয়নি। লাদাখের আগে দুই দেশের মধ্যে সবচেয়ে বড় সামরিক অচলাবস্থা দেখা দিয়েছিল ভুটানের দোকলাম মালভূমি অঞ্চলে। ২০১৭ সালে ভুটানের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ দোকলাম মালভূমি অঞ্চলে চীন অবকাঠামো গড়ে তোলার উদ্যোগ নিলে ওই সংকটের শুরু হয়। ওই সময়ে ভুটানের পক্ষে সমর্থন দিয়ে অঞ্চলটিতে সেনাবাহিনী ও বুলডোজার পাঠিয়েছিল ভারত। প্রায় ৭৩ দিনের সামরিক অচলাবস্থার পর দুই দেশ সমঝোতায় পৌঁছলে তখনকার মতো সংকটের সমাপ্তি ঘটে। এর ঠিক চার বছর পর সীমান্ত বিরোধ নিরসনে চূড়ান্ত চুক্তিতে পৌঁছার অংশ হিসেবে এমওইউ সই করল ভুটান ও চীন।
শুধু দোকলাম নয়, ভুটানের সঙ্গে সীমান্তবর্তী অন্যান্য অঞ্চল নিয়েও বিরোধ রয়েছে চীনের। দেশটির সঙ্গে ভুটানের সীমান্তের দৈর্ঘ্য প্রায় ৪০০ কিলোমিটার। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিরোধপূর্ণ অঞ্চল হলো ভুটানের পশ্চিমে ভারত ও চীনের ত্রিদেশীয় সীমান্তবর্তী এলাকা দোকলাম, ইয়াক চু ও চারিথাং লু উপত্যকা, সিনচুলুংপা ও লাংমারপো উপত্যকা এবং ড্রামানা ও শাখাতোয়ে পার্বত্য অঞ্চল। এছাড়া উত্তরে বেউল খেনপাজং ও পূর্বে সাকতেং এলাকা নিয়েও চীনের সঙ্গে বিরোধ রয়েছে ভুটানের। ১৯৮৪ সাল থেকে এ বিরোধ নিষ্পত্তি নিয়ে আলোচনা চালাচ্ছে দুই দেশ। গত বৃহস্পতিবারের আগ পর্যন্ত দুই দেশের মধ্যে এ নিয়ে ২৪ দফা আলোচনা হয়েছে। এ আলোচনায় এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ অগ্রগতি হলো সর্বশেষ সই হওয়া এমওইউ।
দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর চলতি বছরের এপ্রিলে দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি আলোচনা গতি পায়। যদিও ভুটানের পররাষ্ট্রনীতিতে ভারতের প্রভাব বিবেচনায় নিয়ে সে সময় এ আলোচনার ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন কোনো কোনো পর্যবেক্ষক। তাদের এ সন্দেহকে সে সময় একেবারে উড়িয়ে দেয়ারও কোনো সুযোগ ছিল না। ১৯৪৯ সালে ভারতকে নিজস্ব প্রতিরক্ষা ও কূটনৈতিক বিষয়াদিতে ‘পরামর্শ’ দেয়ার অধিকার দিয়ে এক চুক্তি সই করে ভুটান। ২০০৭ সালের নতুন আরেক চুক্তির মাধ্যমে ভুটানের ওপর ভারতের কর্তৃত্ব আরো জোরালোভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। অন্যদিকে প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র ভুটানের সঙ্গেই কোনো ধরনের কূটনৈতিক বা বাণিজ্যিক সম্পর্ক নেই চীনের। এ দুই দিক থেকেই ভুটান অনেকটাই ভারতনির্ভর। এমন প্রেক্ষাপটে ভুটান ও চীনের মধ্যকার সর্বশেষ এমওইউকে এক ধরনের কূটনৈতিক বিজয় হিসেবেই দেখছে বেইজিং। পর্যবেক্ষকদের মধ্যেও অনেকে এখন একই মন্তব্য করছেন।
চীনের দাবি, ভুটানের সঙ্গে সীমান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির পথে সবচেয়ে বড় বাধা হলো ভারত। চীনের ক্ষমতাসীন দলের পররাষ্ট্রবিষয়ক দৈনিক ট্যাবলয়েড গ্লোবাল টাইমসে প্রকাশিত সা¤প্রতিক এক নিবন্ধে দাবি করা হয়েছে, চীন ও ভুটানের মধ্যে যে এলাকা নিয়ে বিরোধ তার আয়তন খুব একটা বড় নয়। কিন্তু তা সমাধান করা যায়নি। ভারত এ সমাধানের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঐতিহাসিকভাবেই ভুটানের ওপর দেশটির এক ধরনের সাংস্কৃতিক প্রভাব রয়েছে। একই সঙ্গে প্রভাব রয়েছে ভুটানের প্রতিরক্ষা ও কূটনীতিতেও। অন্যদিকে এমওইউ সই হওয়া নিয়ে বেশ সতর্ক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে ভারত। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচি বৃহস্পতিবার বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেন, ভুটান ও চীনের মধ্যে এমওইউ সই হওয়ার বিষয়টি আমরা নোট করেছি। আপনারা জানেন ভুটান ও চীন ১৯৮৪ সাল থেকেই সীমান্ত বিরোধ নিয়ে আলোচনা চালাচ্ছে। ভারতও একইভাবে চীনের সঙ্গে সীমান্ত নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। এ সময় বিষয়টি নিয়ে ভুটান ভারতকে আগে থেকে কিছু জানিয়েছিল কিনা, এমন প্রশ্ন করা হলে তা এড়িয়ে যান অরিন্দম বাগচি।