দেশের নিত্যপণ্যের বাজার আবারো অস্থির হয়ে উঠেছে। কয়েকদিনের ব্যবধানে বেড়েছে ভোজ্যতেল, গম ও ডালের দাম। এর আগে হঠাৎ বেড়ে যায় চিনি ও পেঁয়াজের দাম। তবে সরকার এ দুটি পণ্যের আমদানি শুল্ক কমিয়ে আনার ঘোষণা দেয়ার পর দাম কমতে শুরু করে। কিন্তু অন্য পণ্যগুলোর বিষয়ে সরকারি কোনো ঘোষণা না আসায় এক ধরনের লাগামহীন হয়ে পড়েছে বাজার। প্রসঙ্গত, ১৫ অক্টোবর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুরোধের পর পেঁয়াজ ও চিনির দাম নিয়ন্ত্রণে শুল্ক কমায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। পেঁয়াজ আমদানির ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার ছাড়াও চিনির নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক (আরডি) ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ করা হয়। এনবিআর থেকে এ-সংক্রান্ত দুটি প্রজ্ঞাপনও জারি করা হয়। এর আগে ১১ অক্টোবর পেঁয়াজের শুল্ক প্রত্যাহার ও অপরিশোধিত সয়াবিন তেল, পাম অয়েল ও চিনির শুল্ক কমাতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে অনুরোধ জানায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ওইদিন দুপুরে সচিবালয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে নিত্যপণ্যের মজুদ, সরবরাহ, আমদানি, মূল্য পরিস্থিতি স্বাভাবিক ও স্থিতিশীল রাখার লক্ষ্যে আয়োজিত সভায় এ অনুরোধ জানানো হয়। এর মধ্যে চিনি ও পেঁয়াজের নতুন শুল্কহার কার্যকর হয়েছে। চিনির নতুন শুল্কহার কার্যকর থাকবে আগামী বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এবং পেঁয়াজের নতুন শুল্কহার কার্যকর থাকবে আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। তবে ভোজ্যতেলের শুল্কহার কমানোর বিষয়ে এনবিআর কোনো সিদ্ধান্ত না দেয়ায় পণ্যটির দাম বাড়ছে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।
তবে চালের বাজারের লাগাম টানতে সরকারের নেয়া উদ্যোগ এখনো বহাল। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে গত আগস্টে চাল আমদানির শুল্ক কমিয়ে ৬২ দশমিক ৫ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এ সুবিধা বাড়িয়ে ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত করা হয়েছে। বেসরকারিভাবে চাল আমদানির জন্য বরাদ্দপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে যেসব আমদানিকারক এলসি খুলেছেন কিন্তু এখনো চাল বাজারজাত করতে পারেননি, তাদের এলসিকৃত চাল বাজারজাত করার লক্ষ্যেই সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে। প্রায় সব দেশেই বাজার নিয়ন্ত্রণে শুল্ক কমিয়ে দ্রব্যমূল্য সহনীয় রাখতে উদ্যোগ নেয়া হয়। স¤প্রতি ভারতেও ভোজ্যতেলের দামে লাগাম দিতে আমদানি শুল্ক উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কমানো হয়। কিন্তু দেড় বছর ধরে ক্রমাগত দামের ঊর্ধ্বগতি সত্ত্বেও বাংলাদেশে ভোজ্যতেলের আমদানি শুল্ক কমানো হয়নি। অন্যদিকে কভিড-১৯ পরিস্থিতিতে শ্রমিক সংকট, উৎপাদন হ্রাস ছাড়াও বিভিন্ন কারণে অভ্যন্তরীণ ভোগ বেড়ে যাওয়ায় দেশের সবচেয়ে বেশি ব্যবহূত ভোজ্যতেল পাম অয়েলের বুকিং দর অতীতের প্রায় সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। স¤প্রতি বাংলাদেশের বাজারে পাম অয়েলের পাইকারি দাম মণপ্রতি (৩৭ দশমিক ৩২ কেজি) ৫ হাজার টাকা ছাড়িয়ে যায়। ফের বেড়েছে সয়াবিন তেলের দাম। অতি নিত্যপণ্য গম ও ডালজাতীয় সব ধরনের পণ্যের দামও বাড়তি।
দেশে ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জের তথ্য বলছে, সরকারি ঘোষণার পর কেবল কমেছে চিনি ও পেঁয়াজের দাম। গত কয়েকদিনের ব্যবধানে মণপ্রতি চিনির পাইকারি দাম কমেছে ১০০ থেকে ১২০ টাকা। অন্যদিকে পেঁয়াজের কেজিপ্রতি পাইকারি দামও কমেছে প্রায় ১০ টাকা। যদিও একই সময়ে পাম অয়েলের মণপ্রতি দাম বেড়েছে ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা, সয়াবিনের দাম বেড়েছে মণে ১০০ টাকা, গমের দাম বেড়েছে মণে ২০ থেকে ৩০ টাকা ও সব ধরনের ডালের দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি ৩ থেকে ৫ টাকা।
এ বিষয়ে খাতুনগঞ্জের মেসার্স ইরা ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ ফারুক বলেন, সরকার পেঁয়াজ আমদানিতে শুল্ক প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়ার পর বাজার কিছুটা সহনীয় পর্যায়ে নেমেছে। তাছাড়া মিয়ানমার থেকে আমদানি হওয়া পেঁয়াজের দাম ভারতীয় পেঁয়াজের তুলনায় কম। সেটিও পেঁয়াজের দাম কমার কারণ। মিয়ানমার থেকে আমদানি স্বাভাবিক থাকলে দেশে পেঁয়াজের দাম আরো কমে যেতে পারে বলে প্রত্যাশা করেন তিনি।
বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভারতে পেঁয়াজের দাম বেড়ে যাওয়ায় গত ১০ দিন আগে বাংলাদেশে সরবরাহ কমে যায়। ফলে দেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম সর্বোচ্চ ৫৮ টাকা পর্যন্ত উঠে যায়। সেই সময় দেশী পেঁয়াজের দামও বেড়ে মণপ্রতি সর্বোচ্চ আড়াই হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে। পাইকারি বাজারে দাম বাড়লে স্বাভাবিকভাবেই তার প্রভাব খুচরা বাজারেও পড়ে। পরে মিয়ানমার থেকে পেঁয়াজ আমদানি বাড়লে ভারতীয় পেঁয়াজের চাহিদা কমতে থাকে। বর্তমানে ভারতের নাসিক জাতের পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৫২ থেকে ৫৩ টাকা, মিয়ানমারের পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৩৫ টাকায়। এছাড়া দেশী পেঁয়াজের দাম কমে মণপ্রতি ১ হাজার ৬০০ থেকে ১ হাজার ৭০০ টাকায় নেমে এসেছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আমদানি শুল্ক প্রত্যাহারের ঘোষণার পর চিনির দামও কমতে শুরু করেছে। গতকাল পাইকারি পর্যায়ে মণপ্রতি চিনি বিক্রি হয়েছে ২ হাজার ৭৩০ টাকায়, যা এক সপ্তাহ আগেও ছিল ২ হাজার ৮৫০ টাকা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, সাধারণত শীত মৌসুমে চিনির চাহিদা কম থাকে। পাশাপাশি শুল্কও কমানো হয়েছে। এখন ধীরে ধীরে চিনির বাজার সহনীয় পর্যায়ে নেমে আসবে বলে তাদের প্রত্যাশা।
অন্যদিকে দেড় বছর ধরে দেশের বাজারে ঊর্ধ্বমুখী ভোজ্যতেলের দাম। অতি নিত্য এ পণ্যটির প্রায় ৯০ শতাংশই আমদানিনির্ভর হওয়ায় বৈশ্বিক দাম বৃদ্ধি, শিপিং চার্জ বেড়ে যাওয়া ও টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ভোজ্যতেলের দাম ক্রমেই বাড়ছে। কয়েকদিন আগেই মণপ্রতি পাম অয়েলের পাইকারি দাম ৫ হাজার টাকা ছাড়িয়ে যায়। ব্যবসায়ীরা ভোজ্যতেল আমদানিতে শুল্ক কমানোর দাবি জানালেও সরকার এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত না নেয়ায় এরই মধ্যে পাম অয়েলের দাম রেকর্ড ৫ হাজার ১৪০ টাকায় উঠে গেছে। অর্থাৎ কয়েকদিনের ব্যবধানে দেশের সবচেয়ে বেশি বিক্রীত পাম অয়েলের দাম বেড়েছে মণে ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা। পাম অয়েলের দাম বৃদ্ধিতে সুপার পাম অয়েল ও সয়াবিনের দামও দেশের ইতিহাসে রেকর্ড পর্যায়ে লেনদেন হচ্ছে।
খাতসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা বলছেন, পাম অয়েল সরবরাহকারী দেশ ইন্দোনেশিয়ায় তেলের দাম বেড়ে যাওয়া, শ্রমিক সংকটের কারণে উৎপাদন কমে যাওয়া ও জ্বালানির দাম বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে বায়োডিজেল তৈরির কারণে বিশ্বব্যাপী পাম অয়েলের বাজার অস্থিতিশীল। যার কারণে দেশের বাজারে পণ্যটির দাম ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া থেকে সবচেয়ে বেশি পাম অয়েল রফতানি হওয়ায় এ দুটি দেশের সংকট বাংলাদেশসহ পাম অয়েল আমদানিকারক প্রতিটি দেশে ভোজ্যতেলের বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে। এ অবস্থায় নিত্যপণ্য হিসেবে আমদানিতে শুল্ক কমানো না হলে দেশের বাজারে ভোজ্যতেলের দাম আরো বাড়বে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন ব্যবসায়ীরা।
পাইকারি বাজারের বিভিন্ন ট্রেডিং প্রতিষ্ঠানের দেয়া তথ্যে দেখা গেছে, কয়েক মাস আগেও মণপ্রতি কানাডিয়ান গম ছিল ১ হাজার টাকার মধ্যে। স¤প্রতি গমের দাম বেড়ে মণপ্রতি লেনদেন হচ্ছে ১ হাজার ৫২০ থেকে ১ হাজার ৫৩০ টাকায়। অন্যদিকে রাশিয়া কিংবা ভারত থেকে আমদানি হওয়া গমের দামও মণপ্রতি ৩০ থেকে ৪০ টাকা বেড়ে ১ হাজার ৫০ টাকায় লেনদেন হচ্ছে পাইকারি বাজারে। এছাড়া মসুরসহ প্রায় সব ধরনের ডালের দাম কেজিপ্রতি ৩ থেকে ৫ টাকা বেড়ে গেছে গত কয়েকদিনে। এর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় আমদানীকৃত মোটা মসুর ডাল বিক্রি হচ্ছে ৮৫ থেকে ১০০ (মানভেদে) টাকা কেজি দরে। এছাড়া দেশীয় মুগ ডাল বিক্রি হচ্ছে ১২০ থেকে ১৩০ টাকায়। তাছাড়া বাজারের সবচেয়ে কম দামের ডাবলি ডাল বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৪৫ টাকার মধ্যে।
খাতুনগঞ্জের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান এ বি জামান ট্রেডিংয়ের স্বত্বাধিকারী মো. নুর আলম বলেন, নিত্য ভোগ্যপণ্যের বৈশ্বিক দাম বৃদ্ধির কারণে সাধারণ মানুষের কথা বিবেচনায় নিয়ে শুল্ক কমানো ছাড়া উপায় নেই। ব্যবসায়ীরা লোকসান দিয়ে পণ্য বিক্রি করবেন না। ভোগ্যপণ্যের বুকিং দর যে হারে বাড়ছে, সেখানে বাজার সহনীয় রাখতে সরকারকে আপৎকাল বিবেচনায় শুল্ক কাঠামোর পরিবর্তন করে বাজার স্থিতিশীল রাখতে সহায়তা করতে হবে। তাহলেই সাধারণ মানুষ উপকৃত হবে। আবার দামের অস্বাভাবিক বৃদ্ধির পর হঠাৎ পতনের কারণে অনেক ব্যবসায়ী আমদানির পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছেন। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে সরকারকেও আমদানি কিংবা ব্যবসায়ীদের আমদানিতে উৎসাহী করতে উদ্যোগ নিতে হবে বলে মনে করেন তিনি।