অপারেশন টেবিলে ছুরির ব্যবহার খুবই স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু এবার সেই ছুরি ছাড়াই সফল অপারেশন করে রোগীর জীবন বাঁচিয়েছেন একদল চিকিৎসক। এই চিকিৎসক দলের নেতৃত্বে ছিলেন জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. প্রদীপ কুমার কর্মকার। দেশে এ পর্যন্ত বুক না কেটে শরীরে অ্যাওরটিক ভালভ প্রতিস্থাপন করা হয়েছে পাঁচ জনের। এরমধ্যে তিনটিই হয়েছে ডা. প্রদীপ কুমার কর্মকারের নেতৃত্বে হৃদরোগ হাসপাতালে, বাকি দুটি বেসরকারি দুই হাসপাতালে।
গত ২৫ এবং ২৬ অক্টোবর জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ৬৫ বছর বয়সী একজন পুরুষ ও ৮০ বছর বয়সী এক নারীর শরীরে টিভিএআর (ট্রান্স-ক্যাথেটার অ্যাওরটিক ভালব রিপ্লেসমেন্ট) পদ্ধতিতে অ্যাওরটিক প্রতিস্থাপন করা হয়েছে এবং দুজনেই বর্তমানে সুস্থ আছেন। ডা. প্রদীপ জানান, হৃৎপি- মানুষের শরীরে রক্ত সঞ্চালন করে, এই রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন ধরনের ভালভ থাকে। এরমধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে অ্যাওরটিক ভালভ। এই অ্যাওরটিক ভালভ হৃৎপি- থেকে শরীরে রক্ত সঞ্চালন করে। অ্যাওরটিক ভালভ সরু হয়ে গেলে হৃৎপি- থেকে রক্ত সঞ্চালন করতে পারে না এবং এর ফলে রোগীর শ্বাসকষ্ট, বুকে ব্যথা ও অজ্ঞান হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, হাঁটলে হাঁপিয়ে যান। এসব উপসর্গ দেখা দিলে দুই বছরের মধ্যে বেশিরভাগ রোগী মারা যান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন স্টাডিতে পাওয়া গেছে, অ্যাওরটিক ভালভ সরু হয়ে যাওয়া ওভারিয়ান ক্যানসার, প্রোস্টেট ক্যানসার, কোলন ক্যানসার এমনকি ফুসফুসের ক্যানসারের চেয়েও ভয়াবহ। শতকরা ৮০ শতাংশ রোগীর লক্ষণ বা উপসর্গ দেখা দেওয়ার দুই বছরের মধ্যে মারা যান।’
আর দেশে ৭০ থেকে ৮০ হাজার মানুষ ‘সিভিয়ার অ্যাওরটিক স্ট্যানোসিস’ রোগে ভুগছেন বলেও জানান তিনি। কিন্তু এই অপারেশনে বুক কাটতে হয়, সাত থেকে আট ঘণ্টার অপারেশন, ষাটোর্ধ্ব মানুষের জন্য এই অপারেশন খুবই ঝুঁকিপূর্ণ এবং সুস্থ হতেও কয়েক সপ্তাহ লেগে যায়। সাধারণত এই ভয়ে অনেক রোগীই চিকিৎসার বাইরে থেকে যান। অথচ তাদের চিকিৎসা নেওয়া দরকার বলে জানান তিনি।
ডা. প্রদীপ বলেন, ‘এই রোগের দুই ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি রয়েছে। একটি হচ্ছেÍবুক কেটে অ্যাওরটিক ভালভ প্রতিস্থাপন করা। এই অস্ত্রোপচারে রোগীকে সম্পূর্ণ অজ্ঞান করে বুকের হাড় কাটতে হয়, যেটা ঝুঁকিপূর্ণ ও রোগীর সুস্থ হতে কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত সময় লেগে যায়।’ তিনি বলেন, ‘আর আধুনিক এই অপারেশনে বুক না কেটে, সম্পূর্ণ অজ্ঞান না করে অ্যাওরটিক ভালভ প্রতিস্থাপন করা হয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হয় টিভিএআর (ট্রান্স ক্যাথেটার অ্যাওরটিক ভালভ রিপ্লেসমেন্ট)। এ পদ্ধতিতে কাটাছেঁড়ার বালাই নেই। কেবল শরীরের কুঁচকিতে একটা ছিদ্র করে পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করা যায়।’
ডা. প্রদীপ কুমার কর্মকার বলেন, ‘আমাদের অপারেশন টেবিলে সেদিন কোনও নাইফ (ছুরি) ছিল না। নাইফের কোনও ব্যবহার ছিল না। বলতে পারেন ছুরি ছাড়া অপারেশন করেছি আমরা।’ ‘এখানে বুক কাটা লাগে না, পাঁজরের হাড় কাটতে হয় না, সম্পূর্ণ অজ্ঞান হয় না, কেবল একটা লোকাল অ্যানেস্থেশিয়া দেওয়া হয়। কাটাছেঁড়া নাই, কেবল একটি ছিদ্র করে এই কাজটা করা হয়।’ ডা. প্রদীপ জানান, ২০১৯ সালে প্রথম এ পদ্ধতিতে তিনি এই হাসপাতালেই প্রথমবারের মতো এই চিকিৎসা পদ্ধতি দিয়ে এক নারীর শরীরে ভালভ প্রতিস্থাপন করেন। কিন্তু তখন এটা খুবই চ্যালেঞ্জিং একটা বিষয় ছিল। তিনি বলেন, ‘তবে আমি যেহেতু এই বিষয়ে বিশেষ ট্রেনিং নিয়েছিলাম, তাই আমার আত্মবিশ্বাস ছিল।’
এরপর গত ২৫ এবং ২৬ অক্টোবর পর পর দুই দিন তিনি দুই জন রোগীর অ্যাওরটিক ভালভ প্রতিস্থাপন করেন এই পদ্ধতিতে। তাদের মধ্যে ৬৫ বছরের মনিরুজ্জামান চৌধুরী শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। তাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা যায়, তিনি অ্যাওরটিক স্ট্যানোসিস রোগে ভুগছেন। পরে তার পরিবারের সঙ্গে কথা বলেন ডা. প্রদীপ কুমার কর্মকার। পরিবারের সদস্যরা তাকে অনুমতি দিলে তিনি এ পদ্ধতিতে রোগীর ভালভ প্রতিস্থাপন করেন। অপারেশনের পর বর্তমানে সুস্থ মনিরুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ‘ঘণ্টা দেড়েকের মতো সময় লেগেছিল। অপারেশন টেবিলে যাওয়ার পর একটা ইনজেকশন দিলো। এরপর ঘুম ভেঙে দেখি অপারেশন শেষ। এত কম সময়ে এটা হতে পারে চিন্তাও করিনি আমি।’ রোগীর ছেলে রাশিক রায়হান চৌধুরী বলেন, ‘অপারেশনের এক থেকে দেড়ঘণ্টা পর থেকেই বাবাকে সুস্থ দেখাচ্ছে, ডিজিনেস ছিল না। আর পরদিন থেকে হাঁটাহাঁটি করছেন একেবারে সুস্থ মানুষের মতো। অপ্রচলিত এমন একটি অপারেশনে কেন রাজি হলেন জানতে চাইলে রাশিক রায়হান চৌধুরী বলেন, ‘স্যার (ডা. প্রদীপ কুমার কর্মকার) বলার পর নিজেরাও গুগল করে দেখলাম, পদ্ধতি সম্পর্কে জানলাম। এরপর ভরসা পাই, রাজি হয়ে যাই। এখন বুঝতে পারছি সিদ্ধান্তটা সঠিক ছিল।’ এছাড়া একই পদ্ধতিতে চিকিৎসা হয়েছে ৮০ বছরের উম্মে হানির। তার সন্তানদের মধ্যেও চিকিৎসক রয়েছেন। তারা বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত থাকায় সিদ্ধান্ত নিতে চিকিৎসক দলের বেগ পেতে হয়নি।
হাসপাতালের কেবিনে গিয়ে দেখা মেলে বৃদ্ধা উম্মে হানির। তিনি দিব্যি কক্ষের সোফায় বসে পান খাচ্ছিলেন। দেখে বোঝার উপায় নেই তার ভালভ প্রতিস্থাপনের মতো বড় ধরনের অপারেশন হয়েছে। উম্মে হানির মেয়ে নুরুন্নাহার লিপি বলেন, ‘৮০ বছর বয়সী মা কয়েক বছর ধরেই সিভিয়ার অ্যাওরটিক স্ট্যানোসিস রোগে ভুগছিলেন। কিন্তু অপারেশনের পর কথা বলতে পারছেন। শ্বাসকষ্ট কমে গেছে। গত ২৫ অক্টোবর অপারেশন হওয়ার পর দুই দিন পর থেকেই তিনি হাঁটা শুরু করেন। এরপর থেকে তার শারীরিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে। অনর্গল কথা বলতে পারছেন। কথা জড়ায়ে যাচ্ছে না।’ আমি তো মনে করছি, আমার মা সেই আগের মতো হয়ে গেছেন, বলেন নুরুন্নাহার। তবে নতুন এই অপারেশন পদ্ধতি নিয়ে সরকারের সহযোগিতা চান ডা. প্রদীপ কুমার কর্মকার। ‘এর খরচ অনেক বেশি, সরকার যদি সহযোগিতা করে আমি এটা রেন্ডমলি করতে পারি’, বলেন তিনি।
এই চিকিৎসায় ভারতে দরকার হয় ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকা, সিঙ্গাপুরে প্রায় এক কোটি টাকা, কিন্তু দেশে ২০১৯ সালের অস্ত্রোপচারে লেগেছিল পাঁচ লাখ টাকার মতো, আর এখন লাগছে ১০ লাখের মতো। টোটাল সেটআপ খরচ জানিয়ে ডা. প্রদীপ বলেন, ‘কিন্তু এটা যখন আরও মানুষ জানতে পারবে, বেশি ব্যবহৃত হবে, তখন এর দাম কমে আসবে আরও। কারণ, এর সঙ্গে এক্সেসরিজ অনেক দরকার হয়, যেগুলো দেশের বাইরে থেকে আসে।’
সরকার থেকে যদি সহযোগিতা করা হয়, তাহলে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালেই দরিদ্র রোগীদের চিকিৎসা করানো সম্ভব হবে। কত বিষয়ে সরকার ভর্তুকি দেয়, চিকিৎসার জন্য এই ভর্তুকি দেওয়া হলে দেশের গরিব মানুষ বেঁচে যাবে, দেশের মানুষের উপকার হবে, বলেন তিনি। ডা. প্রদীপ কুমার কর্মকার জানালেন, তার সঙ্গে দুটি অস্ত্রোপচার টিমেই ছিলেনÍডা. ফারহানা, ডা. পিনাকী, ডা. সাইদুর রহমান, ডা. আরিফ হোসেন, ডা. সুফিয়া জিন্নাত, ড. অভিজিৎ, ডা. দোলন, ডা. মহিউদ্দিন, ডা. বাদল ও ডা. হিমেল। সবার সমন্বিত প্রচেষ্টায় তিনি নতুন এই চিকিৎসা পদ্ধতিকে সফল করতে পেরেছেন।