বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ব্যাংক খাতের ১৩ লাখ ৬৬ হাজার কোটি টাকা আমানতের ৪৫ শতাংশই মেয়াদি আমানত। সাধারণ সঞ্চয়ী হিসাবে আমানত আছে ২২ শতাংশ। চলতি হিসাবে ৯ শতাংশ, বিশেষ নোটিস হিসাবে ১০ শতাংশ ও পেনশন স্কিমে ৮ শতাংশ আমানত রয়েছে। মহামারীকালে সবচেয়ে বেশি আমানত বেড়েছে ব্যাংকের বিশেষ সঞ্চয়ী হিসাবে। ২০২০ সালে এ ধরনের ব্যাংক হিসাবে আমানতের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৬ শতাংশ। চলতি বছরে এ প্রবৃদ্ধি ৩৫ শতাংশেরও বেশি। আমানতের বড় প্রবৃদ্ধি হয়েছে সাধারণ সঞ্চয়ী হিসাব এবং চলতি ও নগদ হিসাবেও। এ দুই ধরনের ব্যাংক হিসাবে আমানতের প্রবৃদ্ধি যথাক্রমে ২১ ও ১৮ শতাংশ। তবে আমানতের উচ্চপ্রবৃদ্ধির এ সময়েও ব্যাংকে মেয়াদি আমানতের (ফিক্সড ডিপোজিট) প্রবৃদ্ধি অনেকটাই কমেছে। ২০১৯ সালে দেশের ব্যাংকগুলোয় মেয়াদি আমানতের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১৫ শতাংশ। গত বছর তা নেমে আসে ৭ দশমিক ৪১ শতাংশে। চলতি বছরেও মেয়াদি আমানতের প্রবৃদ্ধি সীমাবদ্ধ থেকেছে ৭ শতাংশের ঘরে।
ব্যাংকাররা বলছেন, মহামারীতে উপার্জনের পথ সংকুচিত হয়ে যাওয়ায় অনেক মানুষই ব্যাংকে থাকা সঞ্চয় স্কিম ও মেয়াদি আমানত ভেঙে তুলে নিয়েছে। অন্যদিকে অর্থনৈতিক কর্মকা-ে স্থবিরতার কারণে চলতি হিসাব, বিশেষ নোটিস হিসাব ও সাধারণ সঞ্চয়ী হিসাবে আমানতের পরিমাণ অনেক বেড়েছে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাধারণ সম্পাদক ও দ্য সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন বলেন, অলস তারল্যের জোয়ার সৃষ্টি হওয়ায় ব্যাংকগুলো আমানতের সুদহার অনেক কমিয়ে দিয়েছিল। তার পরও করোনাকালে ব্যাংক খাতে আমানতের এত বড় প্রবৃদ্ধি বিস্ময়কর। মহামারীতে ব্যাংকের ঋণ বিতরণে স্থবিরতা চলছে। প্রণোদনা প্যাকেজের ঋণ বিতরণ হলেও স্বাভাবিক ঋণ প্রবৃদ্ধি নেই বললেই চলে। করোনা পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলেও এখনো বাজারে ঋণের চাহিদা তৈরি হয়নি। প্রণোদনা প্যাকেজের বিতরণকৃত ঋণের একটি অংশ ব্যাংকে আমানত হিসাবে থেকে গিয়েছে। রিটেইল, মাইক্রো ক্রেডিটসহ নতুন কিছু খাতে সিটি ব্যাংক ঋণ বিতরণে জোর দিচ্ছে বলে জানান মাসরুর আরেফিন। তিনি বলেন, বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশের ঘরে সীমাবদ্ধ হলেও সিটি ব্যাংকের ঋণ প্রবৃদ্ধি ১৫ শতাংশ। ক্রেডিট কার্ডসহ রিটেইল ব্যাংকিং স¤প্রসারণে জোর দেয়ায় ঋণ প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে।
অনেকেরই জীবন-জীবিকায় বড় বিপর্যয় নিয়ে এসেছিল করোনার প্রাদুর্ভাব। কর্মসংস্থান হারিয়েছেন অনেকেই। যাদের চাকরি টিকে ছিল, তাদের বড় অংশ গিয়েছে বেতন-ভাতা কর্তনের মধ্য দিয়ে। আয় সংকোচনের ধারাবাহিকতায় পরিবর্তন এসেছে ভোক্তার আচরণেও। মধ্যবিত্ত জীবন নির্বাহ করেছে সঞ্চয় ভেঙে। একই সময়ে আবার আমানতের সুদহারও নেমে এসেছিল ইতিহাসের সর্বনি¤েœ। এসব ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় দেশে ব্যাংক আমানতের প্রবৃদ্ধি থমকে দাঁড়ানোর জোর সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছিলেন সংশ্লিষ্টরা। যদিও শেষ পর্যন্ত দেখা গিয়েছে সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র।
২০২০ সালের মার্চ থেকে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত দেশের ব্যাংকগুলোয় আমানত বেড়েছে ২ লাখ ২৮ হাজার ৭০২ কোটি টাকা। এ সময়ে ব্যাংক খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৪ শতাংশেরও বেশি। আমানতের এ প্রবৃদ্ধি দেশের ব্যাংক খাতের সা¤প্রতিক ইতিহাসে সর্বোচ্চ। ব্যাংক আমানতের অস্বাভাবিক প্রবৃদ্ধিকে অপ্রত্যাশিত বলে মনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংকও। আমানত প্রবৃদ্ধির উৎস খুঁজে দেখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে রীতিমতো গবেষণাও হয়েছে।
গবেষণার তথ্য বলছে, আমানতের অভাবনীয় প্রবৃদ্ধির জন্য সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষিত ১ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। পাশাপাশি রেমিট্যান্সের উচ্চপ্রবৃদ্ধি, সঞ্চয়পত্রের বিক্রি কমে যাওয়া, এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের স¤প্রসারণ, ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানত কমে যাওয়া ও এমএফএস প্রতিষ্ঠানের ই-মানির স্থিতি বৃদ্ধিসহ বেশকিছু কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে বৈধ হওয়া অপ্রদর্শিত অর্থ ২০ হাজার কোটি টাকাও এ আমানত প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ‘দ্য রিসেন্ট ব্যাংকস ডিপোজিট গ্রোথ: হোয়াট আর দ্য পোটেনশিয়াল সোর্সেস?’ শীর্ষক গবেষণাটি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চিফ ইকোনমিস্টস ইউনিট।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনাকালে বৈধ হওয়া অপ্রদর্শিত অর্থের বাইরেও প্রচুর অবৈধ অর্থ ব্যাংক খাতে ঢুকেছে। এক্ষেত্রে কাজে লাগানো হয়েছে মহামারীসৃষ্ট আর্থিক স্থবিরতা ও আইন প্রয়োগে শিথিলতার সুযোগকে। তবে ব্যাংকগুলোয় আসা অর্থের বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। স্বাভাবিক সময়ে ব্যাংকের আমানত গ্রহণ ও ঋণ বিতরণ কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে মানি মাল্টিপ্লায়ার ইফেক্ট বা অর্থের বহুগুণন হয় অন্তত পাঁচ গুণ। কিন্তু করোনাকালে তা হয়েছে দুই-আড়াই গুণ। চাহিদা থাকলেও দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ও উদ্যোক্তাদের কাছে ঋণের অর্থ পৌঁছানো সম্ভব না হওয়ায় ব্যাংকে অলস তারল্যের পাহাড় তৈরি হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, দেশ-বিদেশের ব্যাংক খাতের গতিপ্রকৃতিতে নজর রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়মিতই বিভিন্ন ধরনের গবেষণা করে। করোনাকালে ব্যাংক খাতে আমানতের বড় প্রবৃদ্ধির কারণগুলো চিহ্নিত করার জন্যই ওই গবেষণা করা হয়েছিল। এতে যথাযথভাবেই যেসব উৎস থেকে আমানত এসেছে, তা চিহ্নিত করা হয়েছে।
সিরাজুল ইসলাম জানান, সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের ৯০ শতাংশ অর্থ বিতরণ করা হয়েছে। দ্বিতীয় পর্যায়ের ঋণ বিতরণ এখন চলছে। বিশ্বের অনেক দেশের অর্থনীতি নেতিবাচক ধারায় চলে গেলেও তুলনামূলকভাবে আমাদের অর্থনীতি ভালো অবস্থানে আছে। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় বেসরকারি খাত সক্রিয় হচ্ছে। এ কারণে ঋণ বিতরণের প্রবৃদ্ধিও বাড়ছে। আগামীতে এ ধারা আরো সমৃদ্ধ হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ২০২০ সালের মার্চে দেশের ব্যাংক খাতে আমানতের পরিমাণ ছিল ১১ লাখ ৩৭ হাজার ৩২০ কোটি টাকা। চলতি বছরের আগস্টে ব্যাংক খাতে আমানতের পরিমাণ ১৩ লাখ ৬৬ হাজার ২২ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। এ হিসাবে করোনাকালে দেশের ব্যাংক খাতে ২ লাখ ২৮ হাজার ৭০২ কোটি টাকার আমানত বেড়েছে। চলতি বছরে ব্যাংকগুলোতে আমানতের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৪ শতাংশের বেশি। আর ২০২০ সালে আমানতের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৩ দশমিক ৫৬ শতাংশ। অথচ করোনার আগে ২০১৯ সালে দেশের ব্যাংক খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধি ছিল ১২ দশমিক ২৯ শতাংশ। ২০১৭ ও ২০১৮ সালে ব্যাংক আমানতের প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ শতাংশের ঘরে।