ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্সে অন্তর্ভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা ৩১১টি। ডিএসইএক্স সূচক হিসাব করা হয় মোট ফ্রি ফ্লোট বাজার মূলধনের ভিত্তিতে। প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির সময় যে-সংখ্যক শেয়ার ইস্যু করা হয়, সেগুলোই ফ্রি ফ্লোট শেয়ার। প্লেসমেন্টের মাধ্যমে ইস্যু করা শেয়ারের ওপর লকইন পিরিয়ড থাকা পর্যন্ত সেগুলো ফ্রি ফ্লোট শেয়ার হিসেবে গণ্য হয় না। এর বাইরে উদ্যোক্তা-পরিচালক, সরকার ও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শেয়ারধারীর কাছে থাকা শেয়ারগুলোও ফ্রি ফ্লোট শেয়ার নয়। বাজার মূলধন নির্ধারণে ফ্রি ফ্লোট পদ্ধতিকে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লেনদেনের জন্য সক্রিয় থাকা শেয়ারগুলোর ভিত্তিতে এটি নির্ধারণ করা হয় বলে বাজারের গতিপ্রকৃতির সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য চিত্রও উঠে আসে।
তামাক খাতের বহুজাতিক ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ কোম্পানি লিমিটেডের (বিএটিবিসি) শেয়ারের দর বৃদ্ধির কারণে গত দেড় বছরে সূচক বেড়েছে ২০১ পয়েন্ট। স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস সূচকে যোগ করেছে ১২৯ পয়েন্ট। রেনাটা লিমিটেডের শেয়ারদর বাড়ার প্রভাবে সূচক বেড়েছে ১০৪ পয়েন্ট। বিকন ফার্মাসিউটিক্যালস গত দেড় বছরে সূচকে যোগ করেছে ৯৬ পয়েন্ট।
টেলিযোগাযোগ খাতের শীর্ষ কোম্পানি গ্রামীণফোন লিমিটেডের কারণে সূচকে বেড়েছে ৭১ পয়েন্ট। লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশের শেয়ার ডিএসইএক্সে ৭০ পয়েন্ট যোগ করেছে। ব্র্যাক ব্যাংকের শেয়ারের কারণে সূচক বেড়েছে ৪৮ পয়েন্ট। ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার সূচকে যোগ করেছে ৪৮ পয়েন্ট।
আইএফআইসি ব্যাংকের শেয়ারদর বৃদ্ধির কারণে ডিএসইএক্স বেড়েছে প্রায় ৪৮ পয়েন্ট। ইসলামী ব্যাংকের শেয়ার সূচকে যোগ করেছে ৪৪ পয়েন্ট। বিএসআরএম লিমিটেডের শেয়ারদর বাড়ার কারণে সূচক বেড়েছে ৪১ পয়েন্ট। ফরচুন সুজের শেয়ার সূচকে ৩৯ পয়েন্ট যোগ করেছে। লংকাবাংলা ফাইন্যান্সের শেয়ারের দাম বাড়ার প্রভাবে সূচক বেড়েছে ৩৭ পয়েন্ট।
সিটি ব্যাংকের শেয়ারের কারণে সূচক বেড়েছে ৩৭ পয়েন্ট। ইস্টার্ন ব্যাংকের শেয়ারের দর বৃদ্ধির কারণে সূচকে যোগ হয়েছে ৩৬ পয়েন্ট। ওরিয়ন ফার্মাসিউটিক্যালসের কারণে সূচক বেড়েছে ৩৩ পয়েন্ট। জিপিএইচ ইস্পাত শেয়ার সূচকে ৩২ পয়েন্ট যোগ করেছে। আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের শেয়ারদর বাড়ার প্রভাবে সূচক বেড়েছে ২৮ পয়েন্ট।
সাইফ পাওয়ারটেকের শেয়ারদর বাড়ার কারণে সূচকে যোগ হয়েছে ২৭ পয়েন্ট। বিডি ফাইন্যান্সের শেয়ারের কারণে সূচকে যোগ হয়েছে ২৫ পয়েন্ট। জেনেক্স ইনফোসিসের শেয়ার সূচকে ২৫ পয়েন্ট যোগ করেছে। এসিআই লিমিটেডের শেয়ারের প্রভাবে সূচক বেড়েছে ২৪ পয়েন্ট। পূবালী ব্যাংকের শেয়ারদর বাড়ার কারণে সূচকে যোগ হয়েছে ২২ পয়েন্ট।
প্রাইম ব্যাংকের শেয়ারদর বাড়ার কারণে সূচক বেড়েছে ২২ পয়েন্ট। ইউনাইটেড পাওয়ার জেনারেশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (ইউপিজিডিসিএল) শেয়ারের কারণে সূচকে যোগ হয়েছে ২১ পয়েন্ট। বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবল কোম্পানি লিমিটেডের (বিএসসিসিএল) শেয়ারের কারণে সূচক বেড়েছে ২০ পয়েন্ট। মার্কেন্টাইল ব্যাংকের শেয়ার সূচকে ১৯ পয়েন্ট যোগ করেছে। এবি ব্যাংকের শেয়ারদর বাড়ার কারণে সূচক বেড়েছে ১৯ পয়েন্ট।
দেশে নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর গত বছরের ১৮ মার্চ তলানিতে চলে গিয়েছিল পুঁজিবাজার। সেখান থেকে গত দেড় বছরে অনেকটাই ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাজার। অস্বাভাবিক উল্লম্ফনের কারণে এ সময়ে বেশকিছু জাঙ্ক শেয়ার (ব্যবসায়িক ও আর্থিক দিক থেকে দুর্বল অবস্থায় থাকা কোম্পানির শেয়ার) আলোচনার শীর্ষে ছিল। যদিও এসব জাঙ্ক শেয়ার সূচকের উত্থানে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। বরং এ সময় সূচকের উত্থানে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছে বাজারের ব্লু-চিপ শেয়ারগুলো (লাভজনক, সুপরিচিত ও দীর্ঘমেয়াদে আর্থিকভাবে স্থিতিশীল কোম্পানির শেয়ার)। বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। এ প্রসঙ্গে তাদের বক্তব্য হলো ব্লু-চিপ শেয়ারে ভর করে বাজার সূচক বাড়লে তা তুলনামূলক বেশি টেকসই হয়। বাজারের পরিবেশও থাকে বিনিয়োগকারীদের অনুকূলে।
গত বছরের ১৮ মার্চ ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সার্বিক সূচক ডিএসইএক্স ছিল ৩ হাজার ৬০৪ পয়েন্টে। এ বছরের ১০ অক্টোবর সূচকটি সর্বোচ্চ ৭ হাজার ৩৬৮ পয়েন্টে পৌঁছে। বাজারদর সংশোধনের প্রভাবে এর পর থেকেই সূচক নি¤œমুখী রয়েছে। গত রোববার চলতি সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবসে ডিএসইএক্স ছিল ৬ হাজার ৮৫৬ পয়েন্টে। সে হিসেবে গত বছরের ১৮ মার্চ থেকে ওই দিন পর্যন্ত ডিএসইএক্স বেড়েছে ৩ হাজার ২৫২ পয়েন্ট।
সূচকের এ উত্থানে শীর্ষ ৩০ কোম্পানির শেয়ারের অবদান ছিল ৬৫ শতাংশ। এ ৩০ কোম্পানির কারণে সূচক বেড়েছে ১ হাজার ৯৬৩ পয়েন্ট। কোম্পানিগুলোর মধ্যে ১৮টি ডিএসইর ব্লু-চিপ সূচক ডিএস-৩০-এর অন্তর্ভুক্ত। এর মধ্যে একক কোম্পানি হিসেবে সবচেয়ে বেশি অবদান ছিল বেক্সিমকো লিমিটেডের শেয়ারের। গত দেড় বছরে বেক্সিমকো লিমিটেডের শেয়ারদর বাড়ার প্রভাবে সূচক বেড়েছে ৩৮৩ পয়েন্ট। এরপর সূচকে সবচেয়ে বেশি ২১২ পয়েন্ট যোগ হয়েছে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের শেয়ারের কারণে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএসইসির কমিশনার অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, ব্লু-চিপ কোম্পানিগুলো যখন সূচকের উত্থানে অবদান রাখে তখন সেটি তুলনামূলক বেশি টেকসই হয়। আমাদের পুঁজিবাজারের গভীরতা খুব বেশি নয়। ফলে বাজারে যখন ঊর্ধ্বমুখিতা থাকে, তখন কিন্তু দুর্বল কোম্পানির শেয়ারদরও বাড়ে। এটি আমাদের পুঁজিবাজারের একটি কাঠামোগত দুর্বলতা। উত্থান-পতন বাজারের স্বাভাবিক একটি প্রবণতা। বিনিয়োগকারীরা যখন তাদের পোর্টফোলিওতে থাকা শেয়ার পুনর্বিন্যাস করে তখন সেটির প্রভাব পুঁজিবাজারে প্রতিফলিত হয়।
ফ্রি ফ্লোট শেয়ারের হিসাবে রবি আজিয়াটা ও এনআরবিসি ব্যাংকের শেয়ারের সূচকের উত্থান-পতনের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য প্রভাব রয়েছে। তবে এনআরবিসি ব্যাংক ডিএসইএক্সে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এ বছরের ১৮ জুলাই। সেই সময় থেকে গত ৭ নভেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকটির শেয়ার সূচকে ১০ পয়েন্ট যোগ করেছে। অন্যদিকে রবি আজিয়াটা গত বছরের ডিসেম্বরে ডিএসইতে লেনদেন শুরুর পর এর শেয়ারের দাম বাড়তে শুরু করে একসময় সেটি ৭০ টাকায় উঠে যায়। যদিও সেই সময় শেয়ারটি ডিএসইএক্সের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। রবি আজিয়াটা ডিএসএক্সে অন্তর্ভুক্ত হয় এ বছরের ১৮ এপ্রিল। সেই সময় থেকে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত কোম্পানিটির শেয়ারদর কমার কারণে সূচক কমেছে ১৪ পয়েন্ট। অন্যদিকে ওয়ালটন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিজ বাজার মূলধন হিসেবে অন্যতম শীর্ষ কোম্পানি হলেও এর ফ্রি ফ্লোট শেয়ার মাত্র দশমিক ৯৭ শতাংশ হওয়ার কারণে সূচকে এর প্রভাব বেশ কম। এ বছরের ২৪ জানুয়ারি ওয়ালটন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিজ ডিএসইএক্সে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর থেকে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত সূচকে মাত্র ২ পয়েন্ট যোগ করেছে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) প্রেসিডেন্ট মো. ছায়েদুর রহমান বলেন, জাঙ্ক শেয়ার মানেই ঝুঁকি। এ ধরনের শেয়ারে বিনিয়োগ করার ফলে বিনিয়োগকারী নিজে ঝুঁকিতে পড়ার পাশাপাশি বাজারেও ঝুঁকি তৈরি করেন। জাঙ্ক শেয়ার কখনই সূচকে খুব একটা প্রভাব ফেলে না। সূচকের উত্থান-পতনে মৌলভিত্তির শেয়ারই প্রধান ভূমিকা রাখে। তাই বিনিয়োগকারীদের প্রতি অনুরোধ থাকবে, তারা যেন অতি মুনাফার আশায় জাঙ্ক শেয়ারের পেছনে না ছুটে মৌলভিত্তির দীর্ঘমেয়াদে ভালো রিটার্ন দেয়, এমন শেয়ারে বিনিয়োগ করেন।