একুশে পদকপ্রাপ্ত লোকসংগীত শিল্পী শ্রীমতি সুষমা দাশ,গানের স¤্রাট বাউল কামাল পাশা (কামাল উদ্দিন) কে স্বীকৃতি দানের জন্য সরকারের প্রতি আহবাণ জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আমি যখন ৮/৯ বছরের কিশোরী তখন শীত মৌসুমে ফাল্গুন মাসে আমাদের গ্রামের বাড়ী সুনামগঞ্জের শাল্লা থানার পুটকা গ্রামে একটি পালাগানের আসরে আসেন বাউল কামাল পাশা কামাল ভাই। তখন এলাকার লোকজন কামাল সাব আইছন, কামাল সাব আইছন বলে দলে দলে আমাদের বাড়ির দিকে ছুটে আসেন। সকলের উদ্দেশ্য একটাই এতবড় একজন গুনীশিল্পীকে হাতের কাছে পেয়ে একনজর দেখবেন। ঐসময় কামাল ভাইর প্রচুর নামডাক ছিল। তিনি আমার বাবার সাথে আমাদের ঘরে বসলেন। সংগীতের বিভিন্ন বিষয়াদি নিয়ে আলাপ আলোচনা করলেন। তাঁর চেহারাটা এখনও আমার মনে আছে। আমি তাকে চা-পানি ও নাস্তা পরিবেশন করেছি। সেইদিন থেকেই আমি তার গানের ভক্ত ছিলাম এখনও আছি। ৩০ অক্টোবর শনিবার বিকেল ৫টায় সিলেটের বাগবাড়ী এলাকাধীন নিজ বাসভবনে এ প্রতিবেদকের সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন। কথা বলার সাথে সাথেই স্বকন্ঠে তিনি পরিবেশন করেন বাউল কামাল পাশার “অতি যতেœর পোষা পাখি হারিয়ে গেল নগরবাসীলো তোমাদের ঘরেনি আইলো ”শিরোনামের সেই বিখ্যাত গানটি। দেখতে কেমন লোক ছিলেন কামাল পাশা জানতে চাইলে বৃদ্ধা সুষমা দাশ বলেন, অনেক সুন্দর সুদর্শন ছিলেন তিনি। সুন্দর ছিল তার বাবরী চুল। কথাবার্তায় পান্ডিত্য ও মাধুর্য্য ছিল তার মধ্যে। খুব ফুর্তিবাজ ও ভাবিক মানুষ ছিলেন তিনি। বাবারে কাকা বলে সম্বোধন করতেন। শিক্ষিত বাউল শিল্পী হিসেবে তিনি খুব অহংকারী ছিলেন এমন অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, কামাল ভাই অহংকারী ছিলেন এটা কখনও আমার মনে হয়নি। আচার আচরনে আমার মনে হয়েছে তিনি খুব অমায়িক ও সদালাপী। ব্যক্তি হিসেবে কেমন ছিলেন বাউল কামাল পাশা এ প্রশ্নের উত্তরে সুষমা দাশ বলেন, ব্যক্তি হিসেবে তিনি খুবই ভালো, সৎ সহজ সরল ছিলেন। আমার খুবই ভাল লাগতো তাকে। আমাকে তিনি বোন কইয়্যা ডাক দিতেন। উনি আমাদের বাড়ীতে আসলেই লোকজন ভীড় করতো। বলতো বড় বাউল, কামাল পাশা আইছন। কামাল পাশার গান অন্যের নামে গাওয়া ও লেখা হচ্ছে এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটা ঠিকনা। একজনের গান অন্যজনে নিয়ে যাচ্ছে এটা আমি পছন্দ করিনা। যারা এগুলো করছে তারা ভূল করতেছে। আমি বলি তারা শুদ্ধপথে চলে আসুক। যার গান তার নামে গাওয়ার রীতি চালু করুন। দিরাই থানার সিরারচর গ্রামের কামিনী মোহন দাস, দূর্গাপুরের হরিচরন দাস সরকার ও বাউশি গ্রামের অধর চন্দ্র ঠাকুর,বাউল কামাল পাশার সাথে কবিগান গেয়েছেন উল্লেখ করে সুষমা দাশ বলেন, পুটকা গ্রামে কবিগানের আসরের পাশাপাশি পালাগানের আসর বসতো। ঐসব আসরে বাউল কামাল ভাইর সাথে,করিম ভাই ও আলী হোসেন সরকারকে গান গাইতে আমি দেখেছি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে বাংলাদেশে প্রথম গানের গীতিকার সুরকার বাউল কামাল পাশা কিনা? এ প্রশ্নের উত্তরে সুষমা দাশ বলেন, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বর্তমানে অর্থাৎ তাঁর শহীদ হওয়ার পরে এখন অনেকেই গান লিখছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর জীবদ্ধশায় তাঁকে নিয়ে সবচেয়ে বেশী গান লিখেছেন বাউল কামাল পাশা। আমি যতদূর জেনেছি তৎকালীন পূর্ববঙ্গে ১৯৫২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি দিরাই থানার রাজানগর হাইস্কুল মাঠে ঢাকায় ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ সভায় সর্বপ্রথম “ঢাকার বুকে গুলি কেন, নুরুল আমিন জবাব চাই। শেখ মুজিব কারাগারে আন্দোলন কেউ নাহি ছাড়ে,সত্যাগ্রহে এক কাতারে সামনে আছেন সামাদ ভাই” এই দেশাত্ববোধক গানটিতে বাউল কামাল পাশাই সর্বপ্রথম বঙ্গবন্ধুকে স্বমহীমায় উপস্থাপন করেন। যা বাংলা একাডেমির গবেষক ড. সাইমন জাকারিয়ার লেখায়ও প্রমাণ হিসেবে পাওয়া গেছে। সাক্ষাৎকার গ্রহনের সময় ভাটিপাড়া গ্রামের বাউল শিল্পী ছালেহ আহমদ উপস্থিত ছিলেন। কামাল পাশার আর কোন গান জানেন কিনা? এ প্রশ্নের উত্তরে সুষমা দাশ বলেন, আমি ডায়রিতে গান লিখে রাখিনা। কোন গান লিখে রাখার অভ্যাস আমার নাই। মুখস্থ থেকেই গান গাই। কামাল ভাইর আরেকটি গান, “জান্নাতেরি সেরা ফুল নেমে এল দুনিয়ায় নীরস বালি সরস হইলো পবিত্র পদের ছায়ায়” এ মূল্যবান নবীতত্ত্ব গানটি মাঝে মাঝে আমার স্মৃতির জানালায় নাড়া দিয়ে যায়। এছাড়া আরো অনেক কামালগীতি আছে যখন গানের ভাবনায় পুরোপুরি মনোনিবেশ করি তখন হয়তো মনে আসতে পারে। ১৯৭৩ সালের ৩রা মার্চ দিরাই উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে নৌকা প্রতীকে আওয়ামীলীগ মনোনিত প্রার্থী সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদের সর্বশেষ নির্বাচনী জনসভায় প্রধানমন্ত্রী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাগত জানিয়ে গ্রাম এলাকা থেকে মহিলাদেরকে সভাস্থলে নিয়ে এসেছিলেন উল্লেখ করে গণসংগীত শিল্পী সুষমা দাশ বলেন, ঐ সময়ে বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানিয়ে নির্বাচনী সভামঞ্চে সংগীত পরিবেশন করেছেন কামাল ভাই ও করিম ভাই। কিন্তু শিল্পী হলেও সেই সময় আমরা গান শুনার তালে ছিলামনা। আমাদের মূল আকর্ষনটা ছিলেন বঙ্গবন্ধু। আমরা বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা শুনে নৌকার পক্ষে শ্লোগান দেই। আলোচনার মধ্যেই তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে পরিবেশন করেন তার রচিত “দেশে হাহাকার ধ্বনীরে, এমন সোনার বাংলায় কি হইলো না জানিরে”নামের একটি মুজিব বিচ্ছেদ গান। বাউল কামাল পাশা স্মৃতি সংসদের প্রতিষ্ঠাতা সাধারন সম্পাদক শিল্পী আবুল কাশেম চৌধুরী বলেন,আমাদের ভাটি অঞ্চলের সংস্কৃতি জগতের গৌরব ও ঐতিহ্যের ধারক বাহক হচ্ছেন পন্ডিত রামকানাই দাশ ও তার বড় বোন সুষমা দাশ। জীবদ্ধশায় ২০০৯ সালে সিলেটের করেরপাড়া ও এর আগে মীরের ময়দান আবাসিক এলাকায় পন্ডিত রামকানাই দাশের বাসায় দুইবার যাওয়ার সৌভাগ্য হয় আমার। শুধু আমি একাই যাইনি। আমার সাথে ছিলেন সাংবাদিক আল-হেলালসহ আরো কয়েকজন শিল্পীবৃন্দ। ২ বারের সৌজন্য সাক্ষাতে পন্ডিত রামকানাই দাশ, বাউল কামাল পাশার নামে সংগঠন করায় আমাদেরকে স্বাগত জানিয়ে বলেছিলেন, “বাউল কামাল পাশার মতো বড় সাধক মহাজনকে যারা দেখেনি সংস্কৃতি জগতে তাদের মতো দূর্ভাগা আর কে হতে পারে”। তিনি বলেছিলেন, “আমি বাউল কামাল পাশাকে কাছে থেকে দেখেছি।
কি পান্ডিত্য ছিল তার গানে। সংগীত জগতের সকল শাখা প্রশাখায় দূর্দন্ড প্রতাপের সাথে অবাধে বিচরন করেছেন তিনি। পালাগানে তাকে কেউ হারাতে পেরেছে এমন কোন শিল্পী আমি কখনও দেখিনি। একসময় বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের বাউলরা মালজুড়া গানে শ্রেষ্টত্ব প্রদর্শন করতেন। কিন্তু বৃহত্তর সিলেটে একমাত্র অপ্রতিদ্বন্দ্বি বাউল কামাল পাশাই ছিলেন যিনি ময়মনসিংহ অঞ্চলের বাউলদের সাথে পালাগানে পাল্লা দিয়ে একে একে সবাইকে হারিয়ে সিলেটের শ্রেষ্টত্বকে অক্ষুন্ন রেখে চলেছিলেন ”। ওস্তাদ রামকানাই দাশ নিজেও বাউল কামাল পাশার সাথে পাগলা ও শ্যামারচরে কবিগান গেয়েছেন বলে দাবী করেছিলেন। উল্লেখ্য সুষমা দাশ ১৯৩০ সালের ১লা মে শাল্লা থানার পুটকা গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। তবে তার পৈত্রিক নিবাস দিরাই থানার চরনারচর ইউনিয়নের পেরুয়া গ্রামে। তার পিতা রসিকলাল দাশ ছিলেন একজন বিখ্যাত কবিগায়ক। মা দিব্যময়ী দাশ একজন ধামাইল ও সূর্যব্রত গানের সংগীতশিল্পী ছিলেন। তার আপন ছোট ভাই পন্ডিত রামকানাই দাশও সংগীতে অনন্য অবদানের জন্য একুশে পদকে ভূষিত হন। ছোই ভাই রামকানাই দাশের পর বড়বোন সুষমা দাশ ২০১৭ সালে একুশে পদক লাভ করেন। কর্মজীবনে তিনি যেমন একজন প্রখ্যাত লোকসংগীত শিল্পী,বাংলাদেশ বেতারের তালিকাভুক্ত শিল্পী ঠিক তেমনি সফল গৃহিণী। প্রাচীন লোককবিদের মধ্যে যেমন, সৈয়দ শাহনূর, শিতালং ফকির, দ্বীন ভবানন্দ, কালা শাহ, লালন সাই, আরকুম শাহ, হাসন রাজা, রাধারমন, মদন মোহন, উকিল মুন্সী, জালাল খাঁ, দ্বীনহীন, অধরচান ঠাকুর, রামজয় সরকার, শ্যামসুন্দর, দুর্গাপ্রসাদ, রসিক লাল দাশ, কামাল পাশা, দুর্বিন শাহ, শাহ আবদুল করিমসহ বিভিন্ন গীতিকারদের প্রায় ২ হাজারের অধিক গান তাঁর সংগ্রহে আছে তবে তা কোন ডায়রী বা বইয়ে লিপিবদ্ধ না করে সব গানই মনের ডায়রিতে লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন তিনি। সর্বশেষ তাঁর গাওয়া প্রাচীন ২২৯টি গান, জীবনী, স্বাক্ষাৎকার নিয়ে আজিমুল রাজা চৌধুরী’ সুষমা দাশ ও প্রাচীন লোকগীতি’নামে একটি বই ২০২০ সালের মার্চে প্রকাশ করেন। এটিই তাঁকে এবং তাঁর গান নিয়ে রচিত প্রথম বই। কোন বই বা পান্ডুলিপির সাহায্য ছাড়াই তিনি ৯০ বছর বয়সেও শুদ্ধ বাণীতে গান পরিবেশন করে থাকেন। তিনি নিজেও কয়েকটি গান লিখেছেন তবে সেগুলো সংখ্যায় কম। পল্লীগান, কবিগান, লোকগান, হোরিগান, ঘাটুগান, ধামাইল, সূর্যব্রত, পালাগান, কীর্তন, মনসা, গোষ্ঠলীলা, সুবল মিলন, বাউলা, ভাটিয়ালী, পীর মুর্শিদি ইত্যাদি অনেক তত্ত্বের উপর তিনি গান পরিবেশন করেন। পারিবারিক জীবনে সুষমা দাস চার ছেলে ও দুই মেয়ের জননী।