ইউনিয়ন পরিষদ সদস্যদের অনাস্থা, বহিষ্কারাদেশ, অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে এবার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী হবেন কিনা? এমন প্রসঙ্গ নিয়ে সাভার উপজেলার বনগাঁও ইউপি চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলামকে সংবাদকর্মীরা প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, – “আমি ভালা নাই”। এই বলে তিনি দ্রুত গাড়ীতে উঠে চলে যান। জানা গেছে, সাইফুল ইসলাম বনগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হওয়ার পর থেকেই তাঁর বিরুদ্ধে একের পর এক নানা অভিযোগ আসতে থাকে। বনগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলামের বিরুদ্ধে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও ঢাকা জেলা প্রশাসকের কাছে পৃথক দু’টি অভিযোগ দেন ইউনিয়ন পরিষদের ১২ জন সদস্যের মধ্যে ১১ জন। চেয়ারম্যানের দুর্নীতি, সন্ত্রাসী কার্যকলাপ, ইউপি সদস্যদের ক্ষমতা খর্ব করাসহ নানা প্রকার অনিয়মের কথা উল্লেখ করা হয়। এব্যাপারে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ঢাকা জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে সম্প্রতি প্রাথমিক গণশুনানী শুরু করে। গত ২০ আগস্ট ইস্যুকৃত ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ৫.৪১.২৬০০. ০০৯. ২৭.০২৩, ০০৭, ১৮-২৪০ নম্বর স্মারকের সূত্রে জানাগেছে, ২৭ জুলাই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের ইউনিয়ন পরিষদ শাখা বনগাঁও ইউপির ১১ জন সদস্যের অভিযোগ আমলে নিয়ে ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে প্রেরণ করে। এরপর পৃথক আরেকটি আবেদনে সাভার উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়ে সিংহভাগ ইউপি সদস্যরা স্বাক্ষর করে অনাস্থা প্রস্তাব পেশ করেন। এলাকাবাসী ও ভুক্তভোগীরা জানান, ঢাকার সাভারের বনগাঁও ইউনিয়ন একটি অবহেলিত জনপদ। এই জনপদে বিভিন্ন সময় জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচিত হলেও এলাকার উন্নয়নে তেমন কোন ভূমিকা রাখেনি। বর্তমানে ইউনিয়নটির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে সাইফুল ইসলাম বিভিন্ন অভিযোগে জড়িয়ে আছেন। অন্যের জমি দখল করে রাস্তা করা, ক্যাডার বাহিনী দিয়ে ভয়-ভীতি দেখানো, সাংবাদিকদের হুমকী প্রদানসহ নানা অভিযোগ রয়েছে চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে পৃথক আরেকটি সূত্র জানায়, সাভারের বনগাঁও ইউনিয়নে গড়ে উঠছে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান। রয়েছে অনেক ইটভাটা। চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম এবছর ট্যাক্সের নামে এসব ইটভাটা থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করে তা সরকারী কোষাগারে সঠিকভাবে জমা দেননি। চেয়ারম্যানের নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী দিয়ে সরকারী জমি থেকে মাটি কেটে বিক্রি করে এখান থেকেও তিনি হাতিয়ে নিচ্ছেন মোটা অংকের অর্থ। চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলামের ভাতিজা ইউনিয়ন পরিষদের গ্রাম পুলিশ ফারুক ও জাকির জড়িত ফেন্সিডিল ব্যবসার সাথে। এলাকাবাসী এদেরকে হাতেনাতে ধরলেও মারামারি করে তারা ছুঁটে যায়। এরপর লাঠি বাহিনী দিয়ে আতংক সৃষ্টি করে এলাকায় প্রভাব বিস্তার করে তারা। করোনা ভাইরাস পরিস্থিতিতে সরকারী ত্রাণ ব্যবস্থাপনায়ও অনিয়ম করেছেন চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম। এতে করে ত্রাণের খাদ্য বিতরণের সময় বঞ্চিত হয়েছেন অনেক অসহায় ও দরিদ্র পরিবার। সরকারের আড়াই হাজার টাকা করে বিতরণের প্রকল্পে চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম তাঁর নিজস্ব লোকজনকে এ টাকা বিতরণ করেন। একই মোবাইল ফোন নম্বর ব্যবহার করে এমনকি তাঁর নিজস্ব লোকজনদের মোবাইল ফোন নম্বর ব্যবহার করে তালিকায় যাদের না দেয়া হয়েছে তারা এই আড়াই হাজার টাকা পাননি বলে অভিযোগ রয়েছে। করোনাকালে সরকারী ত্রাণ সামগ্রী নিজের ব্যক্তিগত ত্রাণ বলে বিতরণেরও অভিযোগ রয়েছে চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে। চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলামের আত্মীয় পরিচয়ে ফরিদ, ফারুক, আজিজুল এলাকায় অবৈধ গ্যাস লাইন দিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। যার একটি অংশ প্রতিমাসে পেয়ে থাকেন সাইফুল ইসলাম। রিক্সা ও অটোরিক্সার লাইসেন্স বাবদ অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের অভিযোগও রয়েছে বনগাঁও ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলামের বিরুদ্ধে। তার নিজস্ব লোকজন দিয়ে চলে তার পরিষদের কার্যক্রম। ইউপি সদস্যদের অবমূল্যায়ন করে উন্নয়ন কাজে তাদের অংশ গ্রহণ করতেও বাঁধা প্রদানের অভিযোগ আছে। এলাকায় একজন হিন্দু মেয়েকে ধর্ষণ করার ঘটনা ধামাচাপা দিয়ে সেই পরিবারটিকে ভয়-ভীতি দেখানো এবং একটি মন্দির ভাংচুরের ঘটনাকে অন্যখাতে প্রবাহিত করে পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়েছেন চেয়ারম্যান সাইফুল। এমন অভিযোগও রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। বিগত দিনে কুন্ডা সরকারী রাস্তা নির্মানের নামে অন্যের জমি দখলের অভিযোগ পাওয়া গেছে চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলামের বিরুদ্ধে। জমির মালিকরা তাদের জমির উপর দিয়ে রাস্তা নিতে নিষেধ করলে চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলামের নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী দিয়ে তাদের ভয়-ভীতি দেখিয়েছেন। এ ব্যাপারে সাভার মডেল থানায় সাধারণ ডায়রী করেছেন ভুক্তভোগীরা। রাস্তা নির্মান নিয়ে অভিযোগ পেয়ে সংবাদ কর্মীরা সংবাদ সংগ্রহে যান কুন্ডা এলাকায়। এ সময় চেয়ারম্যানের ভাড়া করা সন্ত্রাসী বাহিনী সংবাদকর্মীদের উপর চড়াও হয়। এই ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ভাইরাল হয়। এ ব্যাপারে কথা বলতে পরদিন বনগাঁও ইউনিয়ন পরিষদে সংবাদ কর্মীরা সাক্ষাতকারের জন্য গেলে তাদের হুমকী-ধামকী দিয়ে পরিষদের কক্ষ থেকে বেরে করে দেন চেয়ারম্যান সাইফুল। কেন জমি দখল? সাভারের বনগাঁওয়ে চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলামের মালিকানাধীন এসএ হাউজিং প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে তিনি দখল করে নেন অন্যের জমি। ভরাট করেন জলাশয়, পুকুর। সরকারী ও ব্যক্তিমালিকানাধীন গাছ কেটে উজার করে ফেলেন এলাকা। পরিবেশের ভারসাম্যের কথা চিন্তা না করে এসব কাজ করায় এলাকাবাসী ও ভুক্তভুগীরা প্রতিবাদও করেছেন। কিন্তু এসএ হাউজিং প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম ভূমিদস্যুদের চেয়েও ভংকর হয়ে উঠেছেন। অবৈধভাবে ড্রেজার লাগিয়ে নদী থেকে মাটি ভরাট করায় ক্ষুদ্ধ পরিবেশবাদীরা। যেখানে সরকার ড্রেজার দিয়ে নদী থেকে মাটি ভরাট নিষিদ্ধ করেছেন, সেখানে চেয়ারম্যান সাইফুল নিজেই ড্রেজার লাগিয়ে এ ধরনের কাজ করে আসছেন বলে দেখাগেছে। সাভার মডেল থানা সূত্র থেকে জানা গেছে, বিভিন্ন সময় চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলামের বিরুদ্ধে জমি দখলের একাধিক অভিযোগ রয়েছে । বিভিন্ন সময় হাউজিং ব্যবসা নিয়ে প্রতিপক্ষের সাথে সংঘর্ষ হয়েছে বনগাঁও এলাকায়। এ নিয়ে পাল্টাপাল্টি মামলা, সাধারণ ডায়রী রয়েছে অনেক। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চেয়ারম্যান সাইফুলের বহিষ্কারাদেশ প্রচার হলেও তাঁকে দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে। এসব অভিযোগ নিয়ে তিনি সম্প্রতি সাভার উপজেলার বনগাঁও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি হয়েছেন। বিতর্কিত এই চেয়ারম্যান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করবেন কিনা এমন বিষয় নিয়ে সংবাদকর্মীরা সাক্ষাৎকার গ্রহণের জন্য বনগাঁও ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে যান। সাংবাদিকদের উপস্থিতি টের পেয়ে তিনি ব্যস্ততা দেখাতে থাকেন। তাঁকে এসব বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি কোন উত্তর না দিয়ে “আমি ভালা নাই” বলে দ্রুত একটি ব্যক্তিগত গাড়িতে করে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন।