আজ ৯ ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের এইদিনে কুষ্টিয়া ও খুলনা ছাড়া পশ্চিম সেক্টরের পুরোটাই শত্রুমুক্ত হয়। বিশেষ করে ডিসেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে গোটা দেশের মানুষ চূড়ান্ত বিজয়ের জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। দেশের অধিকাংশ স্থানে উড়ানো হয় স্বাধীন বাংলার পতাকা। বাংলা, উর্দু ও ইংরেজি অনুবাদ সম্বলিত প্রচারপত্রও ফেলা হয়। এক ভাষণে পাকিস্তানী বাহিনীর অফিসারদের ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল মানেকশ স্পষ্ট জানিয়ে দেন, হয় অস্ত্র সংবরণ কর নতুবা মর। তাদের উদ্দেশে তিনি আরো বলেন, সময় থাকতে আত্মসমর্পণ করলে পাকিস্তানী বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধবন্দীর প্রচলিত বিধান অনুযায়ী ব্যবহার করা হবে।
জেনারেল মানেকশ’র এ আহ্বান পাকিস্তানী বাহিনীর মনোবল আরো ভেঙে দেয়। দিনাজপুরের কান্তানগর এলাকায় ৬ ডিসেম্বর থেকে পাকিস্তানী বাহিনীর সঙ্গে যৌথ বাহিনীর শুরু হওয়া ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ৯ ডিসেম্বর রাত পর্যন্ত অব্যাহত থাকার পর যৌথ বাহিনী এখানে শক্তি ক্ষয় না করে কান্তানগরকে পাশ কাটিয়ে দিনাজপুর শহরের দিকে অভিযান শুরু করে। হিলিতেও পাক সেনাদের সঙ্গে যৌথ বাহিনীর রক্ষক্ষয়ী যুদ্ধ অব্যাহত থাকে।
বিশেষ করে এই দিনে, কুষ্টিয়া ও খুলনা ছাড়া পশ্চিম সেক্টরের পুরোটাই শত্রুমুক্ত হয়। যৌথ বাহিনী কুমারখালিতে মধুমতি নদী অতিক্রম করার লক্ষ্যে বড় ধরনের রিভার ক্রসিং অভিযানের প্রস্তুতি শুরু করে। যৌথ বাহিনীর অপর একটি দল ঝিনাইদহ থেকে সকাল বেলা অভিযান শুরু করে বিকেল নাগাদ কুষ্টিয়া শহরে পৌঁছে যায়। এখানে শত্রু বাহিনীর সঙ্গে প্রচন্ড রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শুরুর পরদিন থেকে পাকিস্তানী সেনারা কুষ্টিয়া ছেড়ে পালাতে শুরু করে।
এদিন জামালপুর শহরকেও মুক্ত করার লড়াই অব্যাহত থাকে। যৌথবাহিনী ময়মনসিংহের দিকে অগ্রসর হয়ে ফুলপুরে পৌঁছে যায়। মৌলভীবাজার জেলা লাকসাম, চাঁদপুর, পীরগঞ্জ, পলাশবাড়ী শত্রুমুক্ত হয়। স্থলপথে ঢাকার দিকে এগিয়ে যাওয়া যৌথবাহিনীর দলটি রাতে মেঘনা নদীর পূর্ব পাড়ে লালপুর দখল করে সেখান দিয়ে নদী অতিক্রম শুরু করে।
এইদিনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহর বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. হেনরি কিসিঞ্জার তাকে পরামর্শ দিলেন বঙ্গোপসাগরের দিকে সপ্তম নৌবহরকে যাত্রা শুরু করার নির্দেশ দিতে। ইয়াহিয়া খান ও তাদের পশ্চিমা মিত্ররা ভেবেছিল এই সপ্তম নৌবহর আসার কথা শুনে যৌথবাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে যাবে। কিন্তু স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে এই কথা জেনে মুক্তিযোদ্ধারা আরো বিপুল উৎসাহে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। সেদিন বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের আরেক মিত্র, তৎকালীন পৃথিবীর অন্যতম পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন আমেরিকার সপ্তম নৌবহর পাঠানোর সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানায় এবং এর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের হুমকি দেয়। ফলে সপ্তম নৌবহরের যাত্রা শুরু হওয়ার পরই থেমে যায়।
বাংলা একাডেমি প্রকাশিত কবি আসাদ চৌধুরীর ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’ শীর্ষক গ্রন্থে এ দিনের ঘটনা প্রবাহ তুলে ধরে বলা হয়, “৯ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনী পাক বাহিনীকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। তাদের আর একত্র হওয়ার সুযোগ নেই বা ঢাকা ফেরার পথ নেই। আশুগঞ্জ, দাউদকান্দি, চাঁদপুর মিত্রবাহিনীর দখলে। আরেকটি বাহিনী কুষ্টিয়া মুক্ত করে গোয়ালন্দের দিকে। হালুয়াঘাট থেকে এগিয়ে আসা বাহিনীও ময়মনসিংহের দ্বারপ্রান্তে। নৌবাহিনীর গানবোট ঢাকার দিকে। বিমানবাহিনীর আক্রমণও সমানে চলছে।”
এইদিনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহর বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. হেনরি কিসিঞ্জার তাকে পরামর্শ দিলেন বঙ্গোপসাগরের দিকে সপ্তম নৌবহরকে যাত্রা শুরু করার নির্দেশ দিতে। ইয়াহিয়া খান ও তাদের পশ্চিমা মিত্ররা ভেবেছিল এই সপ্তম নৌবহর আসার কথা শুনে যৌথবাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে যাবে। কিন্তু স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে এই কথা জেনে মুক্তিযোদ্ধারা আরো বিপুল উৎসাহে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। সেদিন বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের আরেক মিত্র, তৎকালীন পৃথিবীর অন্যতম পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন আমেরিকার সপ্তম নৌবহর পাঠানোর সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানায় এবং এর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের হুমকি দেয়। ফলে সপ্তম নৌবহরের যাত্রা শুরু হওয়ার পরই থেমে যায়। এই শক্তিশালী নৌবহরের গঠন ছিল বঙ্গোপসাগরে ভারতের নৌ অবরোধ ব্যর্থ করা, পাকিস্তানি স্থল বাহিনীর তৎপরতায় সাহায্য করা, ভারতীয় বিমান তৎপরতা প্রতিহত করা এবং মার্কিন নৌসেনা অবতরণ করা।
একাত্তরের এই দিনে আরো শত্রুমুক্ত হয় কুষ্টিয়ার কুমারখালী, কুমিল্লার তিতাস, খুলনার পাইকগাছা, গাইবান্ধা, শেরপুরের নকলা, যশোরের অভয়নগর, ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ, গফরগাঁও ও ত্রিশাল, নেত্রকোনাসহ বিভিন্ন এলাকা। মুক্ত এলাকাগুলোতে সগৌরবে স্বাধীন দেশের পতাকা উড়ে। ( গ্রন্থনা: ইবরাহীম খলিল )