‘লকডাউন’ শিথিল করে সরকার দেশকে ‘ভয়ংকর বিপদজজ্জনক’ অবস্থার দিকে নিয়ে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
মঙ্গলবার (১৯ মে) দুপুরে গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ অভিযোগ করেন। বিএনপির করোনা পর্যবেক্ষণ সেল থেকে পাওয়া সবশেষ তথ্য তুলে ধরার জন্য এ সংবাদ সম্মেলন করা হয়।
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘করোনার সংক্রমণ এখন ঊর্ধ্বমুখী। সরকার করোনা মোকাবিলায় সবদিক থেকে ব্যর্থ। সরকারি হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ ও ভেন্টিলেটর ব্যবস্থা অপ্রতুল। ৯০ ভাগ হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেনের ব্যবস্থা নেই। হাসাপাতালের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের স্বাস্থ্যসুরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়নি। নিম্নমানের মাস্ক সরবরাহ করে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের বিপদে ফেলে দিয়েছে সরকার। এখন তারা রোগীদের চিকিৎসা দিতে ভয় পাচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘সরকারের ব্যর্থতায় বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে সাধারণ মানুষ, সাংবাদিক, চিকিৎসক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। লকডাউন শিথিল করে দেশকে ভয়ংকর বিপজ্জনক অবস্থায় ফেলে দিয়েছে সরকার। দাম্ভিকতা ছাড়া তাদের আর কিছুই নেই। প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের অদূরদর্শিতা, সমন্বয়হীনতা, উদাসীনতা ও একগুয়েমি মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে। সুতরাং করোনায় মৃত্যুর দায় সরকারকেই নিতে হবে।’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘সরকারের সমন্বয়হীনতা ও উদাসীনতায় এখন প্রতিদিনই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আক্তান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা। মানুষের জীবন বাঁচাতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। চীনে যখন করোনা মহামারি শুরু হয়, তখন সরকার যথাযথ পদক্ষেপ নেয়নি। তখন থেকে তারা যথাযথ পদক্ষেপ নিলে আজ লাশের সারি দীর্ঘ হতো না। জনগণের কাছে জবাবদিহি না থাকায় সরকার এমন আচরণ করেছে। মানুষকে বাঁচাতে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি তারা। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হলে তাদের বাঁচানোর ব্যবস্থা নিত সরকার।’
কোভিড-১৯ এ মৃত্যুবরণ করা চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, সাংবাদিক, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্য, ব্যাংকার, পেশাজীবী, শ্রমজীবী মানুষের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেন বিএনপির মহাসচিব।
তিনি বলেন, ‘সরকারি হিসাবে এখন পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ৩৪৯ জনের, আক্রান্ত হয়েছেন ২৩ হাজার ৮৭০ জন। কিন্তু জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, এ সংখ্যা আরও ৪০ গুণ বেশি হবে। গণমাধ্যমের তথ্যমতে করোনা উপসর্গে এখন পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করেছে প্রায় ১,১০০ জন।’
বিএনপির পর্যবেক্ষণ সেল থেকে পাওয়া তথ্য তুলে ধরে মির্জা ফখরুল জানান, এখন পর্যন্ত ৭৮০ জন চিকিৎসক, ৬০০ জন নার্স ও ৫৫০জন স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হয়েছেন। তাদের মধ্যে মৃত্যুবরণ করেছেন পাঁচজন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য আক্রান্ত হয়েছেন ২২ শ’র অধিক। অন্যান্য বাহিনীর আরও ৬ শতাধিক সদস্য আক্রান্ত হয়েছেন। তাদের মধ্যে মৃত্যুবরণ করেছেন প্রায় ১৫ জন। গণমাধ্যমকর্মী আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ১৩৫ জন। ৩ জন মৃত্যুবরণ করেছেন। প্রশাসনেরও বেশকিছু সদস্য আক্রান্ত হয়েছেন, মৃত্যুবরণ করেছেন।
দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘পর্যাপ্ত চিকিৎসা পাচ্ছে না করোনা আক্রান্তরা। অন্যান্য রোগে আক্রান্তরাও যথাযথ চিকিৎসা পাচ্ছে না। পথে, ঘাটে, বাসে, ফুটপাতে লাশ পড়ে থাকার খবর বের হচ্ছে। শাহবাগে লম্বা লাইন ধরে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করেও করোনা টেস্ট করাতে না পেরে সড়কেই ছেলে-মেয়ের চোখের সামনে প্রাণ হারিয়েছেন বৃদ্ধ।’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘সরকারঘোষিত ৪২টি সেন্টারের বেশ কয়েকটি সেন্টার কার্যকর নয়। যেসব সেন্টারে টেস্ট হচ্ছে তাও অপর্যাপ্ত। বিএসএমএমইউ হাসপাতালের সামনের সড়কে আগের রাতে লাইন ধরে রোগীরা শুয়ে আছে। তারপরও টেস্টের সিরিয়াল পাচ্ছে না। অন্যান্য হাসপাতালগুলোতেও একই অবস্থা। যে পরিমাণ টেস্ট হচ্ছে এর মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা ১৬ শতাংশ উঠেছে। যদি বেশি টেস্ট হতো তাহলে আক্রান্তের সংখ্যা আরও অনেক বেশি বেড়ে যেত।’
করোনা আক্রান্ত রোগীরা হাসপাতালে ঘুরেও ভর্তি হতে পাচ্ছে না অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার মৃত্যু হয়েছে বিনা চিকিৎসায়। তাহলে সাধারণ মানুষের অবস্থা কী হতে পারে? শুধু কিটের অভাবে করোনার টেস্ট করাতে পারছেন না আক্রান্ত রোগীরা। অথচ ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর কিট অনুমোদন নিয়ে কত টালবাহানা চলছে।’
ত্রাণ বিতরণের দায়িত্ব সেনা বাহিনীকে প্রদানের দাবি আবারো জানান ফখরুল।
বিএনপির ত্রাণ কার্যক্রম তুলে ধরে তিনি বলেন, আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সাহেবের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধায়নে দলের ত্রাণ কাজ পরিচালিত হচ্ছে। গত ১৭ মে পর্যন্ত সারাদেশে ৩১ লক্ষ ২৭ হাজার ৬৯৩টি পরিবারের মাঝে ত্রাণ সামগ্রি বিতরণ করেছে বিএনপি ও তার অঙ্গসংগঠনসমূহ। এতে করে এক কোটি ২৫ লক্ষ ১০ হাজার ৭৭২ মানুষ এই সুবিধাটা পৌঁছাচ্ছে। এছাড়া ড্যাব ও জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশন যৌথভাবে প্রায় ৭৫টি বেসরকারিন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রায় ২ হাজার পূর্ণাঙ্গ পিপিই সরবারহ করেছে এবং অনলাইনে ড্যাব সদস্যরা দেশের সাধারণ মানুষের চিকিৎসা প্রদান করছে।
সিলেট কারাগারে একজন বন্দি করোনাভাইরাস সংক্রামণে মৃত্যু ও বিভিন্ন কারাগারে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা নেয়ার কথা উল্লেখ করে অবিলম্বে রাজনৈতিক কারণে বন্দিদের মুক্তি ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা প্রত্যাহারের দাবিও জানান বিএনপি মহাসচিব।
কৃষকরা যাতে পণ্যের ন্যায্যমূল্য পায় বিশেষ করে আমের মৌসুমে আম-লিচু চাষীদের পণ্য বিক্রির যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহনের দাবিও জানান তিনি।
ত্রাণ চুরি ও ভুয়া তালিকা প্রনয়ন সম্পর্কে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ও সিপিডির বক্তব্যের সাথে একমত পোষণ করেন ফখরুল।
সংবাদ সম্মেলনে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ও করোনা জাতীয় পর্যবেক্ষন সেলের আহবায়ক ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, আমরা যে সেলটা করেছি সেটা একেবারে ইউনিয়ন লেভেল পর্যন্ত কাজ শুরু করেছি। প্রতিদিনই বিভিন্ন বিভাগ ও বিভিন্ন জেলা থেকে আমরা রিপোর্ট পাচ্ছি যে ইউনিয়ন লেভেলে কী অবস্থা মানুষের। রক্তপরীক্ষা কিন্তু তৃণমূল পর্যায় হচ্ছে না। জাতি হিসেবে আমরা এদেশের মানুষ একটা ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে আছি। আর যারা রক্ত পরীক্ষার সুযোগ পাচ্ছে তাদের রিপোর্টও পাওয়া যায় না। যেমন অধ্যাপক এজেডএম জাহিদ সাহেব ১০ দিন আগে রক্ত দিয়েছেন। উনি ডাক্তার উনার রিপোর্ট উনি এ্রখনো পান নাই। তাহলে সাধারণ মানুষদের কি অবস্থা হবে। সরকার কোনো আইনি ব্যবস্থা না দিয়ে মানুষকে ঘরে রাখার ব্যবস্থা করে নাই একমাত্র কারণে যে তাদেরকে খাবার দিতে পারবে না।
গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এই সংবাদ সম্মেলন হয়।
সংবাদ সম্মেলনে দলের ভাইস চেয়ারম্যান ও সেলের সমন্বয়ক অধ্যাপক এজেডএম জাহিদ হোসেন, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক রিয়াজ উদ্দিন নসু, সহ দপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু ও চেয়ারপারসনের কার্যালয়ের প্রেস উইংয়ের সদস্য শায়রুল কবির খান উপস্থিত ছিলেন।
এমআর/প্রিন্স