অমর একুশে আমাদের জীবনে অনির্বাণ একটি চেতনা। এই চেতনায় ১৯৫২ থেকে আমাদের সংগ্রামী পথচলা। একুশ বাঙালির জাতিসত্তার জাগরণের প্রথম প্রণোদনা। একুশের চেতনা ১৯৭১-এ পরিণত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়। তারই অসামান্য ফসল আমাদের গৌরবময় স্বাধীনতা। এ আমাদের ঐতিহাসিক অর্জন। একুশ কেবল আমাদের মুখের ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করেনি, দিয়েছে দেশপ্রেমের মহান আবেগ, দিয়েছে অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী জীবনবোধ, দিয়েছে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে এগিয়ে চলার প্রাণশক্তি। আমাদের সাহিত্য-সাংস্কৃতিক চেতনার বিকাশে একুশে ফেব্রুয়ারি যেন হাজার তারের এক বীণা। তাতে সৃষ্টি হয়েছে অনেক সুর, অনেক ঝংকার! একুশের বীণায় ঝংকৃত হয়েছে আমাদের ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির বিচিত্র সুর। একুশের সাহিত্য-সাংস্কৃতিক অগ্রগতিতে একুশের সংকলনগুলির রয়েছে অনন্য ভূমিকা। এরই প্রথম মাইলফলক হাসান হাফিজুর রহমান-সম্পাদিত একুশের প্রথম সংকলন একুশে ফেব্রুয়ারী। এটি প্রকাশিত হয়েছিল একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনার পরের বছর- ১৯৫৩ সালে। সংকলনটিতে প্রকাশিত হয় একুশের কবিতা, প্রবন্ধ, গল্প, গান ইত্যাদি। একুশে ফেব্রুয়ারী সংকলনের সূচিপত্র দেখলে এতে সংকলিত সাহিত্যের বৈচিত্রময় প্রকৃতি ও প্রতিবাদী বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ধারণা করা যায়। এই ঐতিহাসিক ও চিরভাস্বর সংকলনটি আমাদের জাতীয় সচেতনতার উদ্বোধনের প্রথম সাহিত্যিক দলিল। এর মাধ্যমে একুশের সংকলন প্রকাশের গৌরবময় ঐতিহ্য সৃষ্টি হয়েছিল। সংকলনটি প্রকাশের পর থেকে প্রতি বছর একুশে উপলক্ষে প্রকাশিত হয়েছে কত না সংকলন, কত না সাময়িকী। ১৯৯১-এর ডিসেম্বরে আমিরুল মোমেনীনের সম্পাদনায় যে একুশের সংকলন গ্রন্থপঞ্জি প্রকাশিত হয়েছে তাতে দুই হাজার ২৮২টি সংকলনের উল্লেখ আছে। এর বাইরেও অনেক সংকলন থেকে থাকবে। এর পরেও প্রকাশিত হয়েছে প্রচুর। তাছাড়া একুশে উপলক্ষে প্রতি বছর প্রকাশিত হয়েছে পত্রপত্রিকার বিশেষ সংখ্যা। আমাদের সাহিত্য-সৃষ্টির ইতিহাসে এসব সংকলন ও বিশেষ সংখ্যার ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও ভূমিকা রয়েছে। শোক ও বেদনার একুশ যে জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে, সৃজনের প্রেরণা হয়েছে, তার পেছনেও রয়েছে এসব সংকলন ও একুশের সংখ্যার অসামান্য অবদান।
একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের সাহিত্যাঙ্গনে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছে। বর্তমান প্রবন্ধে তারই সংক্ষিপ্ত রূপরেখা তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। সাহিত্যের উৎকর্ষ বিচার এ-প্রবন্ধের লক্ষ্য নয়।
দুই
একুশের প্রেরণার প্রথম সাহিত্যপ্রসূন একটি কবিতা। তা লেখা হয়েছিল চট্টগ্রামে। চট্টগ্রামের সর্বদলীয় ভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক এবং সীমান্ত পত্রিকার সম্পাদক মাহবুল উল আলম চৌধুরী। একুশের ঘটনার কথা শুনে সেদিনই লিখেছিলেন সেই কবিতাটি : ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসীর দাবী নিয়ে এসেছি’। কবিতাটি সে-রাতেই চট্টগ্রামের কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেসে গোপনে ছাপানো হয় এবং পরদিন লালদিঘি মাঠে অনুষ্ঠিত জনসভায় পঠিত ও বিলি হয়। প্রকাশের পরপরই মুসলিম লীগ সরকার কবিতাটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। একুশের ঘটনার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া যে কতটা বেদনার, কতটা যন্ত্রণার, কতটা ক্ষোভের, কতটা নিন্দার তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল এই প্রতিবাদী কবিতাটিতে। এ-কবিতায় প্রতিশোধের আগুনের উত্তাপ নিয়ে উচ্চারিত হয়েছিল সর্বস্তরের বাঙালির দাবি : ‘জালিমের গুলিতে যারা প্রাণ দিল / সেই সব মৃতদের নামে/ আমি ফাঁসী দাবী করছি।/যারা আমার মাতৃভাষাকে নিবর্বাসন দিতে চেয়েছে তাদের জন্যে/আমি ফাঁসী দাবী করছি/ যাদের আদেশে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে তাদের জন্যে/ ফাঁসী দাবী করছি যারা এই মৃতদেহের উপর দিয়ে/ ক্ষমতার আসনে আরোহণ করেছে/ সেই বিশ্বাসঘাতকদের জন্যে।/ আমি তাদের বিচার দেখতে চাই।/ এরপর বিগত ছয়টি দশক ধরে অসংখ্য সৃষ্টিতে ভরে গেছে একুশের সাহিত্যের ডালি।’
একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে লেখা প্রথম একটি গানটি হচ্ছে : ‘ভুলব না ভুলব না এই একুশে ফেব্রুয়ারি।’ রচনা করেছিলেন ভাষাসংগ্রামী গাজীউল হক। একুশের অন্যতম ফসল আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর লেখা অসাধারণ গান : ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী, আমি কি ভুলিতে পারি?’ এ-গান আমাদের সাংস্কৃতিক চেতনার বিকাশে উজ্জীবনীমন্ত্রের মতো প্রেরণাময়। এ-গান আজ আমাদের কাছে এক প্রতীকী তাৎপর্যে উজ্জ্বল। একুশ পালন, শহিদ স্মরণে, প্রভাত ফেরিতে, শহিদ মিনারে এ-গান আমাদের চেতনার এক দীপ্র মশাল। এই মশালের আলোতেই পরবর্তীকালে আমরা পেয়েছি আরো অনেক দেশাত্মবোধক গান, অসংখ্য গণসংগীত।
একুশের ঘটনা বাংলা কবিতায় কী ধরনের পরিবর্তন এনেছিল তা বোঝা যাবে একুশের আগে ও পরে প্রকাশিত দুটি সংকলনের কবিতা তুলনা করলে। ১৯৫০ সালে প্রকাশিত নতুন কবিতা সংকলনের কবিতাগুলি ছিল স্বপ্নিল মাধুর্য ও স্নিগ্ধ প্রশান্তিতে ভরা। আর ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত একুশে ফেব্রুয়ারী সংকলনের কবিতা হয়ে উঠেছিল শোকাবহ বেদনা ও ক্ষুব্ধ অঙ্গীকারে উচ্চকিত ও দৃপ্ত। ১৯৫০ সালে প্রকাশিত নতুন কবিতা সংকলনে শামসুর রাহমান লিখেছিলেন : ‘চাঁদ ফুল পাখি মেঘ নক্ষত্র শিশির / আর নারীর প্রণয়/ আজো মিথ্যা নয়।’ ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত হাসান হাফিজুর রহমান-সম্পাদিত একুশে ফেব্রুয়ারী সংকলনে তিনি লেখেন : আর যেন না দেখি কার্তিকের চাঁদ/কিংবা পৃথিবীর কোনো হীরার সকাল/কোনোদিন আর যেন আমার চোখের কিনারে/আকাশের প্রতিভা সন্ধ্যানদীর অভিজ্ঞান/আর রাত্রির রহস্যের গাঢ় ভাষা কেঁপে না ওঠে।
সৌন্দর্য-সমর্পিত কবিকণ্ঠে এভাবে প্রভাব পড়েছিল বেদনা, ক্ষোভ ও যন্ত্রণার। এভাবেই একুশের চেতনা বাংলা কবিতার অঙ্গনে জন্ম দিয়েছিল সমাজ-সচেতন, দায়বদ্ধ অনেক নতুন কবির, যাঁরা নারী ও নিসর্গকে নিয়ে রোমান্টিক ভাবালুতায় নিমগ্ন হওয়ার পথ থেকে সরে এলেন। তাঁরা তাঁদের কবিতায় লিখলেন রক্ত আর অশ্রুর কথা, শোষণ ও বঞ্চনার কথা। ভাবিত হলেন সমাজ ও মানুষ, স্বদেশ ও বিশ্বকে নিয়ে, স্বপ্ন দেখলেন মানব-মুক্তির। তাঁদের কবিতায় ফুটে উঠল স্বদেশের রক্তাক্ত ছবি। কবিতা তাঁদের হাতে হয়ে উঠল সংগ্রামের অন্যতম হাতিয়ার।
হাসান হাফিজুর রহমান-সম্পাদিত একুশে ফেব্রুয়ারী সংকলনে একুশের কবিতা শিরোনামে সংকলিত হয়েছিল একগুচ্ছ কবিতা। তাতে শামসুর রাহমান, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, আবদুল গণি হাজারী, ফজলে লোহানী, আলাউদ্দিন আল আজাদ, আনিস চৌধুরী, আবুজাফর ওবায়দুলস্নাহ, জামালুদ্দিন, আতাউর রহমান, সৈয়দ শামসুল হক, হাসান হাফিজুর রহমানের কবিতা সংকলিত হয়। সেসব কবিতায় বাঙ্ময় হয়ে উঠেছিল মাতৃভাষার জন্যে আবেগময় আকুলতা, শহিদদের জন্যে গভীর বেদনা, হিংস্র শাসকদের বিরুদ্ধে ক্রোধের আগুন। একুশের শোকাবহ ঘটনা কীভাবে দেশের সাধারণ মানুষকে বেদনা-বিহবল করেছিল তার আভাস পাওয়া যায় ফজলে লোহানীর কবিতায় : ‘মৃত্যুকে যারা ভয় করেনি,/মৃত্যু তাদের বরণ করেছে,/এ খবর গিয়ে গাঁয়ে পৌঁছেছে/সবার মুখেই বজ্রশপথ :/হাতুড়ি আমরা নামিয়ে নিলাম/কাসেত্ম-কোদাল থামিয়ে দিলাম/কাঁচা শহীদের স্মৃতির ভারে।’
একুশের মহান শহিদদের স্মৃতিতে ছাত্রজনতা বায়ান্নর ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে তাৎক্ষণিকভাবে যে শহিদ মিনার গড়ে তুলেছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তা গুঁড়িয়ে দিয়েছিল রাতের আঁধারে। কিন্তু ইটের মিনার ভাঙতে পারলেও বাঙালির হৃদয় জুড়ে গড়ে-ওঠা মিনার যে,ভাঙা যাবে না, সে-কথাই দৃঢ়তার সঙ্গে উচ্চারিত হয়েছে আলাউদ্দিন আল আজাদের কবিতায়। বাঙালির রক্ত ও অশ্র¤œমথিত আত্মদানের প্রতীক শহিদ মিনারকে তিনি অভিষিক্ত করেছেন হৃদয়-মহিমায় : স্মৃতির মিনার ভেঙেছে তোমার ভয় কি বন্ধু আমরা এখনো/চার কোটি পরিবার/খাড়া রয়েছি তো। /ইটের মিনার ভেঙেছে ভাঙুক। ভয় কি বন্ধু, দেখ একবার আমরা জাগরী / চার কোটি পরিবার।’ হাসান হাফিজুর রহমান অনুভব করেছেন, ভাষার জন্যে আত্মদানের ভেতর দিয়ে সালাম, বরকত, রফিক, জববার দেশের মানুষের ভেতরে সজীব হয়ে উঠছে নতুন প্রাণের দীপ্তি নিয়ে : ‘কি আশ্চর্য প্রাণ ছড়িয়েছে- একটি দিন আগেও বুঝতে পারি নি,/ কি আশ্চর্য দীপ্তিতে তোমার কোটি সন্তানের প্রবাহে-প্রবাহে / সংক্রমিত হয়েছে – / একটি দিন আগেও তো বুঝতে পারি নি দেশ আমার। / শহিদের আত্মাহুতি বাঙালির জীবনে সঞ্চারিত করেছে এক অদম্য শক্তি : / তাদের একজন আজ নেই; / না, তারা পঞ্চাশজন আজ নেই। / আর আমরা সেই অমর শহীদদের জন্যে, / তাঁদের প্রিয় মুখের ভাষা বাংলার জন্যে একচাপ পাথরের মতো / এক হয়ে গেছি/ হিমালয়ের মতো অভেদ্য বিশাল হয়ে গেছি।’ সিকান্দার আবু জাফর তাঁর তিমিরান্তিক (১৯৬৫) কাব্যগ্রন্থের ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ কবিতায় (রচনাকাল ১৯৫৪) যুগ-যুগান্তের ইতিহাস পরিক্রমায় যেসব অবিনশ্বর স্মৃতিস্তম্ভ দেখেছেন তারই ধারাবাহিকতায় অমর স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে দেখেছেন একুশের ‘শহিদমিনারকে : /আমার কালে/ ইতিহাসের সর্বশেষ পথের বাঁকে/এসে দেখলাম :/অকস্মাৎ জমাট বেঁধে যাওয়া/ পুঞ্জীভূত প্রতিবাদে তৈরি/আর একটি স্মৃতিস্তম্ভ। / চতুর্দিকে তার/ জমাট রক্তের পুরু আচ্ছাদন।
পরিচয়হীন ফলকে লিপিবদ্ধ :‘২১শে ফেব্রুয়ারী।’
পাকিস্তানি আজাদিকে যারা ‘জিন্দেগানির দূত’ হিসেবে দেখেছেন সেই পাকিস্তানের যাত্রাপথকে ‘নমরুদের পথ’ হিসেবে চিত্রিত করে পাকিস্তানবাদের বিরোধিতা করে কবিতা লেখার সূচনা করেছিলেন আবদুল গণি হাজারী (১৯২১-৭৬)। নমরুদের সেই পথ থেকে উত্তরণের প্রেরণা হিসেবে তিনি গ্রহণ করেছেন একুশের চেতনাকে। তাঁর সামান্য ধন (১৯৫৯) কাব্যগ্রন্থের ‘ভালোবাসি বলেই’ কবিতার অংশবিশেষ এ-প্রসঙ্গে স্মরণীয় : ‘অনেক মৃত্যুকে বুকে করে আমাদের বেঁচে থাকা/ অনেক ঝড়ের পীড়ন পাঁজরার তলে/../ বরকতের মায়ের কান্না/ কতবার পৃথিবীর বুক চিরে/ কতবার নিস্তব্ধ হলো। / এত মৃত্যুর কথা স্মরণ করেই আমাদের আয়ু মৃত্যুহীন/ আর তোমায় ভালোবাসি বলেই/জীবন আমার/এত সহজে প্রাণ দিয়ে যাই। ঐতিহ্য-অন্বেষী কবি হাসান হাফিজুর রহমানের ‘অমর একুশে’ কবিতায় স্বদেশভূমি মাতৃচেতনার নতুন মাত্রায় উদ্ভাসিত : বস্তিবাসিনী মা অকস্মাৎ স্বাস্থ্যবান সন্তানকে বুকের কাছে/ ধরতে পারলে যেমন করে আহত দিনের অসংখ্য মৃত্যুকে ভুলে থাকতে পারে/ তেমনি পঞ্চাশটি শহিদ ভাইয়ের অকাল মৃত্যুকে ভুলেছি/ মা, তোমাকে পেয়েছি বলে।/ আজ তো জানতে এতটুকু বাকি নেই মাগো,/ তুমি কি চাও, তুমি কি চাও, তুমি কি চাও (‘অমর একুশে’, বিমুখ প্রান্তর)
একুশের রক্তাক্ত দিনটি বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের কবিতা রচনার প্রেরণা হয়ে আছে। একুশের চেতনা অভিব্যক্তি পায় তাঁর কবিতায় এভাবে : ‘বাতাসের সোহাগে রাত এলো বুনো,/কারা জানি ছাত্রাবাসে মারা গেছে, ‘শোনো/শোনো’, তারপর গলি, ঘর, হ্যারিকেন আলো/মুহূর্তের মতো চুলে হাত বুলালো,/বই মেলে থেমে গিয়ে হৃদয়ের আওয়াজে,/আর্তিতে হাড়-ভরা ছায়া কাঁপে লাজে/চুন ওঠা দেওয়ালে,/মনে মনে বলে, ‘বরকতের চোখে বুঝি ভবিষ্যৎ বুঁজে আছে।
এভাবে একুশের চেতনা তাঁর কবিতায় ভবিষ্যৎমুখী সম্প্রসারণ পায়। দিলওয়ারের কবিতায়ও একুশের চেতনা অনির্বাণ :‘ নদী ও বৃষ্টির জলে যে-দেশে শস্যেরা অফুরান/ দ্বৈমাতৃক সেই দেশে সাহসী একুশে অফুরান।/ তাঁর কবিতায় একুশে হয়ে উঠেছে মায়ের প্রতীক :/ মা আমার বসে আছে রাত্রির নদীর তীরে একা/ আমি যাবো তার কাছে। কে তুমি কঠিন বাহু মেলে/ আমাকে ঠেকিয়ে রাখো।’ (‘রাত্রির নদীর তীরে মা আমার’) একুশের চেতনার অন্যতম প্রধান আশ্রয় বাংলা ভাষা। কিন্তু বাংলা ভাষাকে উপেক্ষা করে এই ভাষার বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র দেখে ক্ষুব্ধ কবি শামসুর রাহমান পরবর্তীকালে লিখেছেন অসাধারণ কবিতা : ‘আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’ : তোমাকে উপড়ে নিলে, বলো, কী থাকে আমার?/ উনিশ শো বায়ান্নর দারুণ রক্তিম পুষ্পাঞ্জলি/ বুকে নিয়ে আছো সগৌরবে মহীয়সী।/ সে-ফুলের একটি পাপড়ি ছিন্ন হলে/ আমার সত্তার দিকে/কত নোংরা হাতের হিংস্রতা ধেয়ে আসে। / .. /তোমার মুখের দিকে আজ আর যায় না তাকানো, / বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা।’ কিন্তু তাঁর ‘ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯’ কবিতায় নতুনভাবে উদ্ভাসিত হয় একুশের চেতনা : আবার ফুটেছে দ্যাখো কৃষ্ণচূড়া থরে থরে শহরের পথে/ কেমন নিবিড় হয়ে। কখনো মিছিলে কখনো বা/ একা হেঁটে যেতে যেতে মনে হয়-/ ফুল নয়, ওরা/ শহীদের ঝলকিত রক্তের বুদ্বুদ, স্মৃতিগন্ধে ভরপুর। / একুশের কৃষ্ণচূড়া আমাদের চেতনারই রঙ।/ সে-চেতনা ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের দৃপ্ত আবেগময়তায় ভাস্বর : আবার সালাম নামে রাজপথে শূন্যে তোলে ফ্ল্যাগ/ বরকত বুক পাতে ঘাতকের থাবার সম্মুখে।/ সালামের বুকে আজ উন্মথিত মেঘনা/ সালামের চোখ আজ আলোকিত ঢাকা/ সালামের মুখ আজ তরুণ, শ্যামল পূর্ব বাংলা।’ এভাবে ভাষা-আন্দোলনের রক্ত আর অশ্রু-ঝরা সংগ্রামী ইতিহাস একাত্তরের সংগ্রামী ইতিহাসের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায়। যেমন, সৈয়দ শামসুল হকের কবিতা ‘আর কত রক্তের দরকার হবে’র কয়েকটি পঙ্ক্তি : মা তুই এবার নিজেই তবে বলে দে/ এই একটি শব্দ।/উচ্চারিত এই একটি শব্দ লিখতে কতখানি রক্তের দরকার হয়?/আমার এ দেহের আর কতটুকু রক্তের দরকার হবে?/যখন এ শব্দ আর এই বড় রক্তাক্ত স্বদেশ/কেউ মুছে ফেলতে পারবে না। /মা; বরকত লিখেছে মা/ সালাম লিখেছে- মা/ জববার লিখেছে- মা/ মতিউর-আসাদ ওরা লক্ষ লক্ষ লিখে গেছে / মা।
এ-প্রসঙ্গে একুশের কবিতার আরেকটি বিশিষ্ট সংকলনের কথা উল্লেখ করতে হয়। এটি হচ্ছে বাংলা একাডেমি-প্রকাশিত একুশের কবিতা। একাডেমি ১৯৮৩ সালে এটি প্রকাশ করে। ১৯৫৩ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত একুশ নিয়ে লেখা ১১৫ জন কবির ১৩২টি কবিতা এতে সংকলিত হয়। সংকলিত কবিতাগুলি বাংলা ও ইংরেজি- এই দুই ভাষায় প্রকাশিত হয়। কবিতাগুলির মধ্যে রয়েছে : জসীমউদ্দীনের ‘একুশের গান’, সুফিয়া কামালের ‘এমন আশ্চর্য দিন’, আহসান হাবীবের ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’, ফররুখ আহমদের ‘ভাষা আন্দোলনের নিহত আত্মার প্রতি’, সিকান্দার আবু জাফরের ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’, আবদুল গণি হাজারীর ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’, আবুল হোসেনের ‘তোমাকে নিয়ে যত খেলা’, সানাউল হকের ‘অমর একুশে’, আবদুল লতিফের ‘একুশের গান’, শামসুর রাহমানের ‘বর্ণমালা আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’, আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘স্মৃতিস্তম্ভ’, হাসান হাফিজুর রহমানের ‘অমর একুশে’, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর ‘কোনো এক মাকে’, সৈয়দ শামসুল হকের ‘একুশের কবিতা’, মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহর ‘একুশের গাথা’, ফজল শাহাবুদ্দীনের ‘আত্মা থেকে একটি দিন’, আল মাহমুদের ‘একুশের কবিতা’, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের ‘কৃষ্ণচূড়ার মেঘ’, দিলওয়ারের ‘একুশের কবিতা’, আবু হেনা মোস্তফা কামালের ‘একুশের কবিতা’, বেলাল চৌধুরীর ‘বর্ণমালার নিরস্ত্র সাহস’, হায়াৎ মামুদের ‘ঘুরে ফিরে ফাল্গুন’, শহীদ কাদরীর ‘একুশের স্বীকারোক্তি’, রফিক আজাদের ‘পঞ্চানন কর্মকার’, আসাদ চৌধুরীর ‘ফাল্গুন এলেই’, আবদুল মান্নান সৈয়দের ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’, মোহাম্মদ রফিকের ‘মহান একুশে’, মহাদেব সাহার ‘তোমরা কী জান’, নির্মলেন্দু গুণের ‘আমাকে কী মাল্য দেবে দাও’, হুমায়ুন আজাদের ‘বাংলা ভাষা’, আবুল হাসানের ‘মাতৃভাষা’, মাহবুব সাদিকের ‘অবিনাশী বাংলা’, আবুল মোমেনের ‘আমি কি ভুলিতে পারি’, অসীম সাহার ‘মধ্যরাতের প্রতিধ্বনি’, মুহম্মদ নূরুল হুদার ‘মাতৃভাষা’ ইত্যাদি। একুশ-পরবর্তী অর্ধশত বছরে এদেশের কবিদের সত্তায় প্রবহমান একুশের চেতনার প্রতিফলন ঘটেছে এসব কবিতায়।
তিন
একুশের গল্প-রচনার সূত্রপাত হাসান হাফিজুর রহমান-সম্পাদিত একুশের প্রথম সংকলন একুশে ফেব্রুয়ারীকে কেন্দ্র করে। এ-সংকলনে প্রকাশিত একুশের গল্পগুলি হচ্ছে : শওকত ওসমানের ‘মৌন নয়’, সাইয়িদ আতীকুল্লাহর ‘হাসি’, আনিসুজ্জামানের ‘দৃষ্টি’, সিরাজুল ইসলামের ‘পলিমাটি’, আতোয়ার রহমানের ‘অগ্নিবাক’। শওকত ওসমানের ‘মৌন নয়’ গল্পটি ভাষা-আন্দোলন নিয়ে লেখা প্রথম একুশের গল্প। একুশের প্রথম কবিতার মতো এটি লেখা হয় চট্টগ্রামে। গল্পটি যেমন চলচ্চিত্রধর্মী, তেমন নাটকীয়। গল্পে একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনার রূপক উপস্থাপন করেছেন লেখক। একটি চলন্ত বাসের সমস্ত যাত্রীর নিস্তব্ধতার ভেতর দিয়ে একুশের মর্মান্তিক শোকাবহ ঘটনার মানস প্রতিক্রিয়াকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এ-গল্পে। গল্পের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন পুত্রশোকে স্তব্ধ এক বৃদ্ধ যাত্রী। কিন্তু এক সময় পুত্রশোককাতর বৃদ্ধ পিতার আর্তনাদে সে-স্তব্ধতা খান-খান হয়ে ভেঙে যায় : ‘কী দোষ করেছিল আমার ছেলে? ওরা কেন তাকে গুলি করে মারল?’ সব যাত্রী এমনকি ড্রাইভারও তার দিকে সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দেয়। বৃদ্ধের ক্ষোভ নিমেষেই সঞ্চারিত হয় সবার মধ্যে।
সাইয়িদ আতীকুল্লাহর ‘হাসি’ গল্পে দেখা যায়, আবু
ভাষা-আন্দোলনে সক্রিয় হলে আবুর নীহার খালাও তার সঙ্গে একাত্ম হয়ে যান। একুশে ফেব্রুয়ারি গুলি চললে অন্য কয়েকজনের সঙ্গে আবুও গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। তার লাশ বাসায় আনা হলে প্রচ- শোকে নীহার খালা ভেঙে পড়েন। আনিসুজ্জামানের ‘দৃষ্টি’ গল্পে একুশে ফেব্রুয়ারির হৃদয়বিদারক ঘটনা চিত্রিত হয়েছে একটি দরিদ্র পরিবারকে ঘিরে। পেনশনভোগী কেরানি সাদত সাহেবের চশমা ভেঙে গেলেও অভাবের কারণে নতুন চশমা কেনা হয় না। তাঁর চাকরিজীবী পুত্র আসাদ একুশে ফেব্রুয়ারির মিছিলে যোগ দিয়ে পুলিশের গুলিতে নিহত হলে পরিবারটিতে বিপর্যয় নেমে আসে। বৃদ্ধ কেরানি অন্ধদৃষ্টিতে মনে-মনে আঁকেন আসাদের জন্ম-আসন্ন সন্তানের ছবি।
আতোয়ার রহমানের ‘অগ্নিবাক’ গল্পের নায়ক মনি।
দেশবিভাগের সময় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মুখে বাবা, মা, ভাই-বোনের সঙ্গে মনি পশ্চিমবঙ্গ থেকে চলে আসে ঢাকায়। এখানে স্থিতু হতে না হতেই শুরু হয় ভাষা-আন্দোলন। মনি সে-আন্দোলনে যোগ দেয় এবং পুলিশের গুলিতে শহিদ হয়। একুশের গল্পের প্রথম ও একমাত্র উল্লেখযোগ্য সংকলন রশীদ হায়দার-সম্পাদিত একুশের গল্প। ১৯৮৪ সালে বাংলা একাডেমি থেকে এটি প্রকাশিত হয়। এতে একুশ নিয়ে লেখা তিন দশকের প্রতিনিধিত্বশীল কিছু গল্প স্থান পায়। হাসান হাফিজুর রহমান-সম্পাদিত একুশে ফেব্রুয়ারী সংকলনে অন্তর্ভুক্ত সাইয়িদ আতীকুল্লাহর ‘হাসি’ গল্পটি ছাড়া অন্য গল্পগুলি অন্তর্ভুক্ত হয় এতে। এর বাইরে এই নতুন গল্পগুলি এতে স্থান পায় : সত্যেন সেনের ‘ভাষা আন্দোলনের প্রথম সংগ্রামী’, রণেশ দাশগুপ্তের ‘কাঁথা সেলাই হইছে নিশ্চিন্ত’, অজিতকুমার গুহের ‘বুলু’, সরদার জয়েনউদ্দীনের ‘খরস্রোত’, মির্জা আবদুল হাইয়ের ‘আমরা ফুল দিতে যাব’, আবু ইসহাকের ‘প-শ্রম’, শহীদুলস্না কায়সারের ‘এমনি করেই গড়ে উঠবে’, মঈদ-উর
রহমানের ‘সিঁড়ি’, আনিস চৌধুরীর ‘চেতনার চোখ’, মিন্নাত আলীর
‘রুম বদলের ইতিকথা’, আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘হস্তান্তর’, মুর্তজা বশীরের ‘কয়েকটি রজনীগন্ধা’, মাফরুহা চৌধুরীর ‘সেদিনের এক লগ্ন’, শহীদ আকন্দের ‘যখন পারি না’, জহির রায়হানের ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’, সৈয়দ শামসুল হকের ‘সম্রাট’, রাবেয়া খাতুনের ‘প্রথম বধ্যভূমি’, রশীদ আল হেলালের ‘বরকত যখন জানত না সে শহিদ হবে’, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের ‘আমি খুনি হতে চাই না’, শওকত আলীর ‘অবেলায় পুনর্বার’, রাজিয়া খানের ‘শহীদ মিনার’, আবুল হাসানাতের ‘আরও কিছু রক্ত’, নূর-উল আলমের ‘একালের রূপকথা’, মকবুলা মনজুরের ‘শপথের সূর্য’, খালেদা এদিব চৌধুরীর ‘বাইশ বছর পরে’, রিজিয়া রহমানের ‘জ্যোৎস্নার পোস্টার’, জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের ‘স্মৃতিময়’, মাহমুদুল হকের ‘ছেঁড়া তার’, আনোয়ারা সৈয়দ হকের ‘দাগ’, রশীদ হায়দারের ‘সুদূরের শহীদ’, জুলফিকার মতিনের ‘জাতিস্মরেরা’, হরিপদ দত্তের ‘তার ফিরে আসা’, সেলিনা হোসেনের ‘ফিরে দেখা’, হারুন হাবিবের ‘শিকড়’, পূরবী বসুর ‘মায়ের দ্বিতীয় বিবাহ’, তাপস মজুমদারের ‘কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার সম্পর্কিত একটি গল্পকরী খসড়া-সম্পর্ক : ১৯৫২-২০৫২’, মুহম্মদ জাফর ইকবালের ‘সংকোচ’ এবং আহমদ বশীরের ‘উনিশ শ তিয়াত্তরের একটি সকাল’, মইনুল আহসান সাবেরের ‘মরে যাওয়ার সময় হয়েছে’। এসব গল্পের কয়েকটি সম্পর্কে সংক্ষিপে আলোকপাত করছি।
সরদার জয়েনউদ্দীনের ‘খরস্রোত’ গল্পে ১৯৫০-এর দশকে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ভাষা-আন্দোলনের যে-প্রভাব পড়েছিল সে-দিকটি ফুটে উঠেছে। অবসরপ্রাপ্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছেলে মুনিরের জন্যে চাকরি ঠিক করে রেখেছিলেন। কিন্তু সে ব্যস্ত একুশে ফেব্রুয়ারি পালনের প্রস্ত্ততি নিয়ে। এজন্যে তার ওপর অসন্তুষ্ট তিনি। তিনি ছেলেকে বাইরে যেতে নিষেধ করেন। কিন্তু মুনির জানায়, দেশের জন্যে তার কিছু করার আছে। সেদিন সে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়। পরদিন অন্য ছেলেরা আসে মুনিরের খোঁজে। আপস্নুত হন তিনি। একাত্ম হয়ে যান ছেলেদের সঙ্গে।
মির্জা আবদুল হাইয়ের ‘আমরা ফুল দিতে যাবো’ গল্পে
ভাষা-আন্দোলনকে ব্যক্তিগত স্বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়েছে। ভাষা-আন্দোলনের পক্ষাবলম্বন করায় ম্যাজিস্ট্রেট আফসার উদ্দিন পাকিস্তান সরকারের নির্যাতনের শিকার হন ও হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান। শাসকগোষ্ঠীর মন রক্ষা করতে গিয়ে কফিল উদ্দিন হাওলাদার ম্যাজিস্ট্রেট আফসার উদ্দিনের বিরুদ্ধে ইন্ধন জুগিয়ে প্রকারান্তরে তার মৃত্যুর কারণ হন। হাওলাদার সাহেব এজন্য শেষ বয়সে অনুতপ্ত হন এবং একুশের বিশেষ সংখ্যায় এই মর্মে বিজ্ঞাপন দেন যে, আফসার সাহেবের পুত্র যেন অবশ্যই তার সঙ্গে দেখা করে। এই বিজ্ঞপ্তি দেখে আফসার সাহেবের পুত্র মুরাদ তার সঙ্গে দেখা করতে যায়। হাওলাদার সাহেব তার কাছে দোষ স্বীকার করে ক্ষমা চান। ঘটনা শুনে মুরাদ অচেতন হয়ে পড়ে।
মঈদ-উর-রহমানের ময়ূরের পা (১৯৫৮) গ্রন্থের ‘সিঁড়ি’ গল্পে বর্ণিত হয়েছে ভাষা-আন্দোলনের দুর্দমনীয় প্রভাবে ভীত পাকিস্তান সরকারের দমন-নীতির দিক। ভাষা-আন্দোলনের কর্মী সিরাজকে কারাবন্দি করা হলে পরিবারে তৈরি হয় সংকট। দুবছর পর তার মুক্তির দিন ঘনিয়ে এলে পরিবারটি নতুন আশায় বুক বাঁধে। কিন্তু নতুন করে আবার তাকে নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হয়।
আনিস চৌধুরীর ‘চেতনার চোখ’ গল্পে দেখানো হয়েছে সত্য প্রকাশের ক্ষেত্রে কায়েমি স্বার্থ যেভাবে বাধা হয়ে দাঁড়ায় তার স্বরূপ। মানুষের সত্যিকারের আশা-আকাঙক্ষার চিত্র তুলে ধরবে বলে শাহেদ শিক্ষকতা ছেড়ে সাংবাদিকতার পেশা বেছে নেয়। কিন্তু একুশের ঘটনার প্রকৃত প্রতিবেদন লিখতে গিয়ে সে দেখে, তার দরকারি অংশ বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। সে সাংবাদিকতা ছেড়ে আবার পুরনো পেশায় ফিরে যায়।
মিন্নাত আলীর ‘রুম বদলের ইতিকথা’ গল্পটি গড়ে উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসের একটি কক্ষকে কেন্দ্র করে। কক্ষটি যার নামে বরাদ্দ ছিল সেই আনিস ভাষা-আন্দোলনে নিহত হয়। এরপর সেই ঘরে আসে নতুন ছাত্র। সে-ই এ-গল্পের কথক। ঘটনাচক্রে সে জানতে পারে আনিসের মৃত্যুর ঘটনা। বিজ্ঞানের ছাত্র আনিস মিছিলে যোগ দিয়েছিল। গুলিতে আহত হয়ে পরদিন সে হাসপাতালে মারা যায়। এ-ঘটনা শোনার পর রুমে এলেই নতুন ছাত্রটির মনে জাগে আনিসের দুর্বিষহ মৃত্যুর ঘটনা। রাতে তার ঘুম হয় না। শেষ পর্যন্ত সে রুম বদল করতে বাধ্য হয়।
জহির রায়হানের ‘একুশের গল্প’ প্রতীকী তাৎপর্য-মত। গল্পের কাহিনি এরকম : রাহাতের বন্ধু মেডিক্যালের ছাত্র তপুর এক পা খাটো ছিল। সে স্ত্রীর বাধা না মেনে একুশের মিছিলে যোগ দেয়। পুলিশ গুলি চালালে গুলি তার কপালে লাগে। তার লাশ আর পাওয়া যায়নি। ছাত্রাবাসে চার বছর তার সিট খালি পড়ে ছিল। নতুন রুমমেট অ্যানাটমি পড়ছিল। একটা কঙ্কালের মাথার খুলির সঙ্গে পড়া মেলাতে গিয়ে সে হঠাৎ লক্ষ করে খুলির মাঝখানে গর্ত। কথাটা জেনেই রাহাত কঙ্কালের জন্য হাড়গুলো পরীক্ষা করে। দেখে
বাঁ-পায়ের হাড় দুই ইঞ্চি ছোট। রাহাত অবাক বিস্ময়ে নিশ্চিত হয়, এ-কঙ্কাল তপুর। গল্পটি এভাবে নাটকীয়তার মধ্যে শেষ হয়।
রাবেয়া খাতুনের ‘প্রথম বধ্যভূমি’ গল্পে স্কুলশিক্ষক সাবেরের চরিত্রকে কেন্দ্র করে ১৯৫২ সালের একুশের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। এ-ঘটনায় তার পুত্র সাহেদ মারা যায়। পুলিশ তার লাশ গুম করে। শহিদদের স্মরণে তৈরি হয় শহিদমিনার। রশীদ আল হেলালের ‘বরকত যখন জানত না সে শহীদ হবে’ গল্পটি শহিদ বরকতের সঙ্গে লেখকের ব্যক্তিগত পরিচয়ের আলোকে লেখা বর্ণনাসমৃদ্ধ স্মৃতি-আলেখ্য।
নূর-উল আলমের পুতুলের কান্না (১৯৫৭) গ্রন্থের ‘একালের রূপকথা’ গল্পটি গড়ে উঠেছে ১৯৫৫ সালের একুশে ফেব্র¤œয়ারির ঘটনা অবলম্বনে। একুশ উদ্যাপনে বাধা দিতে গিয়ে পুলিশি নির্যাতনের ঘটনা এ-গল্পের উপজীব্য।
মাহমুদুল হকের ‘ছেঁড়া তার’ দুই বন্ধুর কাহিনি। দুজনই
ভাষা-আন্দোলনের কর্মী। আন্দোলনের পোস্টার লাগাতে গিয়ে সরকার সমর্থক গুন্ডাদের হামলায় আহত হয়ে এদের একজন চিরতরে পঙ্গু হয়ে যায়।
সেলিনা হোসেনের উৎস থেকে ফেরা গ্রন্থের ‘দীপান্বিতা’ গল্পে একুশের দিনের ঘটনাকে তুলে ধরা হয়েছে একজন পুলিশের চরিত্রকে কেন্দ্র করে। পুলিশ বিভাগের চাকুরে সাদৎ আলী কর্তব্যপরায়ণতার জন্যে তিন-তিনবার পুরস্কার পেয়েছেন। তার পুত্র মবিন ভাষা-আন্দোলনে যুক্ত থাকায় তিনি খুব চিন্তিত। একুশ তারিখে বিশ্ববিদ্যালয় গেটে তার দায়িত্ব পড়ে। দায়িত্বজ্ঞান ও কর্তব্যনিষ্ঠা থেকে তিনি মিছিলের দিকে রাইফেল তাক করেন। কিন্তু অন্য পুলিশ গুলি চালালেও শেষ পর্যন্ত তিনি গুলি চালাতে পারেন না। চাকরি যাওয়া ও শাস্তি পাওয়ার ভয় সত্ত্বেও তিনি ঝুঁকে পড়েন ভাষা-আন্দোলনের সমর্থকদের পক্ষে।
১৯৮০ সালে লেখা ‘মীর আজিমের দুর্দিন’ গল্পে সেলিনা হোসেন একুশের ঘটনাকে উপস্থাপন করেছেন ষাট বছরের বৃদ্ধ মীর আজিমের বিষণ্ণ স্মৃতিভারাতুর চোখে। তাঁর জীবনে ভাষা-আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার স্মৃতি সজীব। কিন্তু তাঁর দুঃখ তাঁর সন্তান মাসুদের কাছে একুশের আত্মত্যাগ গুরুত্ব পায় না।
আহমদ বশীরের ‘উনিশ শ তিয়াত্তরের একটি সকাল’ গল্পে ফুটে উঠেছে আমাদের স্বপ্ন-প্রত্যাশার প্রতিবন্ধকতা। এ-গল্পেও এসেছে স্বাধীনতা-পরবর্তী নতুন প্রজন্মের প্রসঙ্গ। একুশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ নতুন প্রজন্মের কিছু যুবক স্বাধীনতার চেতনা প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় উদ্যোগী হয়। কিন্তু তারা শিকার হয় প্রতিপক্ষের আক্রমণের।
এভাবে একুশের গল্পগুলির ভেতর দিয়ে ফুটে উঠেছে
ভাষা-আন্দোলনের ঘটনাধারা, পুলিশের বর্বরতা, ভাষা-আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের প্রতি সরকারের নিষ্ঠুর মনোভাব, তাদের বিরুদ্ধে ধরপাকড়, গ্রেফতার, হুলিয়া ইত্যাদি পুলিশি তৎপরতা, শহিদদের আত্মদান, সারা দেশে ঘটনার খবরের দ্রুত বিস্তার, একুশের ঘটনাকে ঘিরে সর্বস্তরের মানুষের আবেগ-উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, আন্দোলনে যোগ দেওয়া না-দেওয়া নিয়ে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব, পাকিস্তানি স্বাধীনতা সম্পর্কে মোহমুক্তি, ভাষা-আন্দোলনের যুগান্তকারী প্রভাব ইত্যাদি।
একুশের পটভূমিতে যে-অসাম্প্রদায়িক মানবিক চেতনার জাগরণ ঘটেছিল তা আলোড়ন তুলেছিল নতুন প্রজন্মের লেখকদের সৃজনে ও মননে। একুশের চেতনা থেকেই জন্ম নিয়েছিলেন বেশ কয়েকজন শক্তিশালী ছোটগল্পকার। এঁদের মধ্যে রয়েছেন আলাউদ্দিন আল আজাদ, মুর্তজা বশীর, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, জহির রায়হান, সৈয়দ শামসুল হক, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, রাবেয়া খাতুন প্রমুখ।
চার
নাট্য ও থিয়েটারের ক্ষেত্রে আমাদের যে বর্তমান অগ্রগতি তার পেছনেও একুশের চেতনা ফেলেছে অসামান্য প্রভাব। ভাষা-আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠার সময়েই এ-নিয়ে নাটক লেখা হয়েছে। ১৯৫১ সালে লেখা আসকার ইবনে শাইখের নাটকটির নাম দুর্যোগ। এটি তাঁর দুরন্ত ঢেউ (১৯৫১-৫৩) নাট্যগ্রন্থে সংকলিত। আসকার ইবনে শাইখ ভাষা-আন্দোলনের সহযোদ্ধাদের নিয়ে লিখেছেন আর একটি নাটক। নাটকটির নাম যাত্রী (১৯৫৪)। ১৯৫৩ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে অর্থাৎ একুশে ফেব্রুয়ারির প্রথম বার্ষিকীতে মুনীর চৌধুরীর লেখা বিখ্যাত কবর নাটকের প্রথম অভিনয় হয়েছিল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। কারান্তরালেই এ-নাটক লিখেছিলেন মুনীর চৌধুরী। অভিনয় করেছিলেন কারাবন্দিরাই। পরের বছর কার্জন হলে অনুষ্ঠিত সাহিত্য সম্মেলনে নাটকটি অভিনীত হয়। একুশের অনির্বাণ চেতনা ও অপরিমেয় আত্মত্যাগের কাহিনি শৈল্পিক উৎকর্ষে প্রতিভাসিত হয়েছে কবর নাটকে। এই নাটকে উঠে এসেছে সেইসব মৃত্যুঞ্জয়ী শহিদ চরিত্র, যাঁদের গুলি করে হত্যা করা যায়; কিন্তু তাঁরা তাঁদের সংকল্পে থাকেন অটুট। এ-নাটক আমাদের নাট্যসাহিত্যে নতুন দ্যুতিতে ভাস্বর। এভাবে একুশের চেতনা বাংলাদেশের নাট্য-আন্দোলনে বাঙালির জাতীয় চেতনাকে পরিব্যাপ্ত করেছিল। পরবর্তীকালে এই ধারায় কয়েকটি নাটক রচিত হয়েছে, হয়েছে নাটকের অভিনয়। ভাষা-আন্দোলন নিয়ে লেখা মমতাজ উদদীনের নাটক হচ্ছে বিবাহ।
মিলন চৌধুরীর পথনাটক যায় দিন ফাগুনের দিনে
ভাষা-আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ প্রতিফলিত হয়েছে। শোভাময় ভট্টাচার্যের নাটক একুশের ইতিবৃত্তও এ-প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। গ্রন্থাকারে প্রকাশিত না হলেও অভিনীত হয়েছে এমন নাটকও রয়েছে।
যেমন : রেজ্জাকুল হায়দারের হরমুজ আলীর একুশ, আলী আনোয়ারের বোবা মিনার, রফিউল কাদের রুবেলের ভাষা বদল ইত্যাদি।
পাঁচ
ভাষা-আন্দোলনের চেতনার প্রভাব লক্ষ করা যায় সাহিত্যের অন্যান্য শাখার মতো উপন্যাসেও। কিন্তু তা তেমন গভীর বা ব্যাপক নয়। একুশের পটভূমিতে তাৎক্ষণিকভাবে কবিতা, গল্প ও নাটক রচনার সূচনা হলেও একুশের উপন্যাস পাওয়ার জন্যে কিছুটা সময় আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে। ভাষা-আন্দোলন বা একুশের ঘটনাভিত্তিক না-হলেও অনুষঙ্গ হিসেবে কিংবা কোনো চরিত্রের স্মৃতিতে
ভাষা-আন্দোলনের প্রসঙ্গ এসেছে কোনো-কোনো উপন্যাসে। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য আতহার আহমেদের উন্মোচন (১৯৫৬) ও পিপাসা (১৯৫৮), দিলারা হাশেমের ঘর মন জানালা (১৯৬৫), বাঙ্গাল আবু সাঈদের ব্যতিক্রম (১৯৬৫), আবু রুশদের নোঙর (১৯৬৭), আনিস সিদ্দিকীর মন না মতি (১৯৬৮), রাবেয়া খাতুনের রাজাবাগ শালিমার বাগ (১৯৬৯) ও আবদার রশীদের লঘুমেঘ (১৯৭০)। উন্মোচন ও ব্যতিক্রম উপন্যাসে ভাষা-আন্দোলনের প্রতিফলন তাৎপর্যময় হয়ে ওঠেনি। পিপাসার নায়ক একুশের স্মৃতিচারণ করে। কিন্তু উপন্যাসের কাহিনির সঙ্গে তার কোনো প্রত্যক্ষ যোগসূত্র লক্ষ করা যায় না। ঘর মন জানালা উপন্যাসে শহিদ দিবস পালনের বর্ণনা আছে। তবে চরিত্রহীন আকতারকে এখানে নেতৃত্বের ভূমিকায় আনা হয়েছে। তা একুশের চেতনার সঙ্গে সংগতি রক্ষা করে না। মন না মতি উপন্যাসের নায়ক রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে মুসলিম লীগের নেতাদের ভূমিকার বিরূপ সমালোচনা করলেও কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলি জিন্নাহকে বাংলা ভাষাবিরোধী ভূমিকার ঊর্ধ্বে রাখতে প্রয়াসী হয়। রাজাবাগ শালিমার বাগ উপন্যাসের প্রধান শিক্ষয়িত্রী পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নেকনজরে থাকতে আগ্রহী। নিজের চাকরির স্বার্থে এবং প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব বজায় রাখার প্রচেষ্টায় তিনি একুশের শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনে দ্বিধাগ্রস্ত। লঘুমেঘ উপন্যাসে একুশের শহিদদের প্রতি মনোভাবের ক্ষেত্রে নায়কের মধ্যে দোলাচল মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। এ-উপন্যাসের নায়ক আন্দোলনের দিন ঘুমিয়ে কাটায়। তবে আন্দোলনে যোগ না দেওয়ায় তার অনুশোচনা হলে পরদিন সে আন্দোলনে যোগ দেয়। এসব উপন্যাসে প্রাসঙ্গিকভাবে একুশের চিত্র এসেছে, কিন্তু সেগুলিতে একুশের চেতনার সার্থক রূপায়ণ ঘটেনি। তাছাড়া মূল কাহিনির সঙ্গে সেগুলির যথাযথ মেলবন্ধনও ঘটেনি। এদিক থেকে বিচ্ছিন্নভাবে হলেও আবু রুশদের নোঙরে ভাষা-আন্দোলনের যৌক্তিক উপস্থাপন লক্ষ করা যায়। এ-উপন্যাসের এক পর্যায়ে ভাষা-আন্দোলনের প্রেক্ষাপট বাস্তবসম্মতভাবে ফুটে উঠেছে। রবীন্দ্রনাথ ও বাংলা ভাষা সম্পর্কে একজন অবাঙালি বিদ্রূপাত্মক মন্তব্য করলে তার বিরুদ্ধে একজন বাঙালি তরুণের তীব্র প্রতিবাদের ঘটনা এখানে বর্ণিত হয়েছে। তবে পাশাপাশি চাকরিচ্যুতির আশঙ্কায় অন্য একজন বাঙালি তরুণের আপসকামী ভূমিকাও স্থান পেয়েছে। বোঝা যায়, এ-উপন্যাসে লেখক রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে সমকালের পরস্পরবিরোধী নানা দৃষ্টিভঙ্গির বাস্তবতাকেই চিত্রিত করতে চেয়েছেন। একুশের ঘটনানির্ভর প্রথম উপন্যাস বা উপন্যাসোপম বড় গল্প সম্ভবত তা সেন-রচিত ‘লাল রং পলাশ’। এটি চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত দ্বিমাসিক কলরোল পত্রিকায় (১৯৬৫) প্রকাশিত হয়। একুশের ঘটনা নিয়ে লেখা জহির রায়হানের আরেক ফাল্গুন উপন্যাসের আগে এটি রচিত ও প্রকাশিত। ভাষা-আন্দোলনের পটভূমিতে এবং এ-আন্দোলনকে বিষয় করে লেখা প্রথম গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস জহির রায়হানের আরেক ফাল্গুন (১৯৬৯)। এটিই একুশের প্রথম সার্থক উপন্যাস যেখানে একুশের চেতনা শৈল্পিক উৎকর্ষে উজ্জ্বল। এ-উপন্যাসে বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতিসত্তার মর্মচেতনাকে এক বিশেষ সময়ের প্রেক্ষাপটে ধারণ করা হয়েছে। এ-উপন্যাস রচনার প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে
ভাষা-আন্দোলনে জহির রায়হানের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ। এ-উপন্যাসের কাহিনির ব্যাপ্তিকাল মাত্র তিন দিন, দুরাত। কিন্তু এই সীমিত পরিসরেই নানা ঘটনা-উপঘটনার মধ্য দিয়ে ১৯৫৫ সালে একুশ উদ্যাপনের উদ্যোগ, পরিস্থিতিগত উত্তেজনা, একুশের অনুষ্ঠান উদ্যাপন বানচালে সরকারি তৎপরতা ইত্যাদি সুবিন্যস্তভাবে চিত্রিত হয়েছে। কাহিনির ফাঁকে-ফাঁকে ফ্ল্যাশব্যাকে বর্ণিত হয়েছে বায়ান্নর একুশের ঘটনা। উপন্যাস শেষ হয়েছে একুশের চেতনাকে হৃদয় থেকে হৃদয়ে সঞ্চারিত করার প্রয়াসের মাধ্যমে।
সেলিনা হোসেনের যাপিত জীবন (১৯৮১) একুশের ঘটনাভিত্তিক উল্লেখযোগ্য আরেকটি উপন্যাস। দেশবিভাগ থেকে ভাষা-আন্দোলন এই কালপর্বে এ-উপন্যাসের কাহিনি বিসত্মৃত। বৃক্ষপ্রেমিক বোটানির শিক্ষক সোহরাব আলি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বীভৎস স্মৃতি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বহরমপুর ছেড়ে সপরিবারে ঢাকায় আসেন। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি ধ্বংস করার চক্রান্তে লিপ্ত হলে তাঁর বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ আন্দোলনে অংশ নিতে শুরু করে তাঁর মেজ ছেলে জাফর। সে ভাষাভিত্তিক স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখে। ভাষা-আন্দোলন নস্যাৎ করার জন্যে পাকিস্তান সরকার নানা অপপ্রচারে লিপ্ত হয়। আন্দোলনকারীদের সভা-সমাবেশ প- করার জন্যে গুন্ডা লেলিয়ে দেয়। কিন্তু আন্দোলন ক্রমেই জোরদার হতে থাকে। জাফরের প্রেমিকা আঞ্জুমও জাফরের সঙ্গে আন্দোলনে শামিল হয়। একুশে ফেব্রুয়ারির মিছিলে আঞ্জুম-জাফর একসঙ্গে মিছিল করে। পরে জাফর চলে যায় আরেক মিছিলে। পুলিশের গুলিতে জাফর শহিদ হয়। মিছিলে দেখা যায় তার রক্তমাখা জামা। এরপর সে মিছিল আরো বড় হয়। তাতে যোগ দেয় জাফরের পিতা সোহরাব আলি, ভাই দীপু। আর আঞ্জুমের চোখে সে মিছিল হয়ে ওঠে জাফরের প্রতীক। আঞ্জুম বিশ্বাস করতে পারে না যে, জাফর নেই। সে বিড়বিড় করে বলে, ‘তোমাকে আমি কিছুতেই মরতে দেব না।’ উপন্যাসের শেষে এই ইঙ্গিত স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, চরম বর্বরতা সত্ত্বেও বাঙালির মিছিল দমানো অসম্ভব। বরং তা দিনে-দিনে আরো শক্তি অর্জন করবে।
সেলিনা হোসেনের নিরন্তন ঘণ্টাধ্বনি (১৯৮৭) উপন্যাসেও ভাষা-আন্দোলনের নানা প্রসঙ্গ এসেছে। দেশবিভাগের পরবর্তী রাজনৈতিক ঘটনাবলির ধারায় ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনাবলির সঙ্গে পূর্বে রচিত যাপিত জীবন উপন্যাসের ঘটনাবলির সাদৃশ্য এখানে লক্ষণীয়। যাপিত জীবন উপন্যাসের মতোই এ-উপন্যাসে বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ও তার এদেশীয় দোসরদের ষড়যন্ত্র, এবং এর বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজের প্রতিবাদ-প্রতিরোধ আন্দোলন বর্ণিত হয়েছে। তবে এ-উপন্যাসে ভাষা-আন্দোলন এসেছে পূর্ববর্তী ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন ও পরবর্তীকালীন সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী আন্দোলনের মধ্যেকার যোগসূত্র হিসেবে। শওকত ওসমানের আর্তনাদ (১৯৯৫) তাঁর ‘মৌন নয়’ গল্পের সম্প্রসারিত রূপ। এ-উপন্যাসে একুশের পটভূমিতে বাঙালি জাতির শোকাবহ আর্তনাদ ও সংগ্রামী চেতনাকে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার নিরিখে উপস্থাপন করা হয়েছে। ভাষাসংগ্রামে নিহত পুত্র আলি জাফরের শোকবিহবল পিতার আর্তনাদ এ-উপন্যাসের উপজীব্য। ভাষা-আন্দোলনকারীদের পাকিস্তান ধ্বংসের জন্য চিহ্নিত ও দায়ী করে এবং তাদের হত্যাকে ন্যায়সংগত বলে প্রতীয়মান করার জন্যে পাকিস্তানি শাসকচক্র ও তাদের এদেশীয় দালালরা যে খোঁড়া যুক্তি তুলেছিল তার বিরুদ্ধে ভাষা-আন্দোলনকারীদের উপযুক্ত জবাবদান এবং মাতৃভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ এ-উপন্যাসের মূল বিষয়। এ-উপন্যাসে দেশবিভাগোত্তর নানা পরিস্থিতি ও নানা রাজনৈতিক-সামাজিক ঘটনা উপস্থাপিত হয়েছে কাহিনির বিভিন্ন অংশে। এভাবে উপন্যাসে ভাষা-আন্দোলনের সঙ্গে বাঙালির প্রাণসত্তার মেলবন্ধন ঘটানো হয়েছে।
ছয়
একুশের নানা প্রসঙ্গ নিয়ে এদেশে কত যে প্রবন্ধ লেখা হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। বর্তমান প্রবন্ধে সেগুলি নিয়ে আলোচনার সুযোগ তেমন নেই। এখানে কেবল একুশে ও ভাষা-আন্দোলন বিষয়ক গ্রন্থগুলির কথা উল্লেখ করা হচ্ছে। আবদুল হকের ভাষা আন্দোলনের আদিপর্ব (১৯৭৬) পরিসরে ছোট হলেও ভাষা-আন্দোলন নিয়ে লেখা মূল্যবান গ্রন্থ। ভাষা-আন্দোলন নিয়ে লেখা অন্যান্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে : বদরুদ্দীন উমরের ভাষা আন্দোলন ও অন্যান্য প্রসঙ্গ (১৯৮০), বশীর আল হেলালের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস (১৯৮৫), রফিকুল ইসলামের শহীদ মিনার (১৯৮৫) ও বাংলা ভাষা সাহিত্য ও
সংস্কৃতিক আন্দোলন (২০০৬), হায়াৎ মামুদের অমর একুশে (১৯৮৫), মুস্তাফা নূরউল ইসলামের মাতৃভাষা চেতনা ও ভাষা আন্দোলন, হুমায়ুন আজাদের ভাষা আন্দোলন সাহিত্যিক পটভূমি (১৯৯০), আহমদ রফিকের ভাষা আন্দোলন : ইতিহাস ও তাৎপর্য (১৯৯১) এবং ভাষা আন্দোলনের কিছু স্মৃতি ও কিছু জিজ্ঞাসা (১৯৯৩), শামসুল আলম সাঈদের বাঙালি জীবনে একুশ (১৯৯৪), আবুল আহসান চৌধুরীর বাংলাদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতি ও ভাষা আন্দোলন (১৯৯৭), বশীর আল হেলালের ভাষা আন্দোলনের এই মোহনায় (২০০৩) ইত্যাদি।
প্রসঙ্গত, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, সেলিনা হোসেন, নূরুল ইসলাম ও মোবারক হোসেনের সম্পাদনায় ২০০০ সালে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত অমর একুশে প্রবন্ধ গ্রন্থটিও স্মরণীয়। এটি একুশের প্রবন্ধের একটি প্রতিনিধিত্বশীল সংকলন। এতে পাঁচ দশকের প্রবন্ধ সংকলিত হয়েছে। অন্তর্ভুক্ত প্রবন্ধগুলির মধ্যে
রয়েছে : মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’, কাজী মোতাহার হোসেনের ‘একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে কয়েকটি বিক্ষিপ্ত চিন্তা’, জীবনানন্দ দাশের ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ভবিষ্যৎ’, মুহাম্মদ
কুদরত-এ-খুদার ‘ওদের স্মরণে’, আবুল ফজলের ‘একুশ মানে মাথা নত না করা’, সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’, আবুল হাশিমের ‘ভাষা-আন্দোলনের স্মৃতি বিজড়িত দিনগুলি’, মুহম্মদ এনামুল হকের ‘পূর্ব-পাকিস্তানের রাষ্ট্র-ভাষার পরিপ্রেক্ষিতে উর্দু ও বাংলা’, সত্যেন সেনের ‘ধন্য একুশে ফেব্রুয়ারী’, আবু জাফর শামসুদ্দীনের ‘একুশে ফেব্রুয়ারী : পুনর্মূল্যায়ন’, অজিত কুমার গুহের ‘ভাষা-আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’, আবদুল হকের ‘ভাষা-আন্দোলনের পটভূমি,’ মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের ‘আমাদের ভাষা ও সাহিত্য’, আহমদ শরীফের ‘ভাষা প্রসঙ্গে বিতর্কের অন্তরালে’, মুনীর চৌধুরীর ‘মাতৃভাষা’, শহীদুল্লা কায়সারের ‘একুশের পর’, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর ‘ভাষা ও সংস্কৃতি’, জিলস্নুর রহমান সিদ্দিকীর ‘ভাষা প্রসঙ্গে ভিন্ন ভাবনা’, আহমদ রফিকের ‘স্মৃতি একুশ : বর্তমানের আলোয়’, বদরুদ্দীন উমরের ‘জাতীয় গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও একুশে ফেব্রুয়ারী’, আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘ভাষা আন্দোলন অর্ধশতাব্দী পরেও’, রফিকুল ইসলামের ‘শহীদ মিনারের ইতিহাস’, আনিসুজ্জামানের ‘একুশে ফেব্রুয়ারী ও আমাদের সাংস্কৃতিক চেতনা’, হাসান আজিজুল হকের ‘একুশের আন্দোলন’, আবুল কাসেম ফজলুল হকের ‘একুশে ফেব্রুয়ারি আন্দোলনের মর্মকথা’, সেলিনা হোসেনের ‘সংস্কৃতি ও অমর একুশে’ ইত্যাদি।
সাত
একুশের সাহিত্যে উঠে এসেছে ভাষা-আন্দোলনের ঘটনাবলি। সেইসঙ্গে তাতে যুক্ত হয়েছে এদেশের কবি, গল্পকার, নাট্যকার ও প্রাবন্ধিকের নবতর জীবনবোধ। পাকিস্তান আমলের সাম্প্রদায়িক, ধর্মীয় জজবা থেকে বাঙালি জাতিসত্তায় উত্তরণের ক্ষেত্রে বাঙালির জীবনে যে অসাম্প্রদায়িক, মানবতাবাদী, ভাষাভিত্তিক জাতীয়তার উন্মেষ ঘটেছিল তার প্রভাব পড়েছে একুশের সাহিত্যে। বাঙালি ভাষা ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ প্রতিবাদের ভাষা হয়েছে একুশের সাহিত্য। বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও জাতিসত্তার প্রতি গভীর মমতার উন্মেষ ঘটিয়েছে তা। একুশের সাহিত্যের মাধ্যমেই ফুটে উঠেছে আমাদের জাতিসত্তার পরিচয়, লিপিবদ্ধ হয়েছে আমাদের ইতিহাসের গৌরবগাথা।
একুশের সাহিত্যই নতুন কালে, নতুন পরিবেশে আমাদের সাহিত্যের মূলধারা হয়ে অর্জন করেছে নব-নব মাত্রা। সূত্র; কালি ও কলম